সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে খুন করার ৪৬ বছর পর কথা বলছি বঙ্গবন্ধু অভিধান নিয়ে। বাংলাদেশের যখন ৫০ এবং বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষে। অভিধান-অভিজ্ঞতায় প্রবেশ করার আগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার লেখালেখির গোড়ায় যেতে চাই। ঘটনাটি অনেক পেছনের। লেখার শুরুটা ১৯৯৫ সালে। বলে রাখা ভালো যে তাঁকে নিয়ে লেখার ইচ্ছাটাই ছিল না। প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁকে নিয়ে বেশি বেশি পড়তে। জানতে। এখনো বঙ্গবন্ধুর জীবন-ঘটনা নিয়ে যে বই-পুস্তিকা এবং সংবাদপত্রে যে লেখাটি ছাপা হয়, সেটা হাতে ধরি। পাতা ওল্টাই। নিষ্ঠ পাঠকের চোখ পড়তে থাকে। পড়ি। জানি। এভাবে জানতে জানতেই বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে লেখার শুরু।
যে সময়ে লেখার ইচ্ছাটা জাগে সেই সময় বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে বাজারে বিশেষ কোনো বই ছিল না। বঙ্গবন্ধুর শ্রমে-মেধায় জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগ তখন ঘোর বিপদে। এই সময়ের কিছু আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে নৃশংস গ্রেনেড হামলার পর মনে হয় এ জীবনে আর যা-ই করি, আর যা কিছু লিখি বঙ্গবন্ধুর জীবন-ঘটনা নিয়ে লিখতেই হবে। এই লেখার প্রতিটি অক্ষর দিয়ে আমি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করব। যাঁকে এই দেশের কিছু মানুষ সপরিবার খুন করেছে। অক্ষরে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে আমার অন্তরের সমর্থন জানাব বঙ্গবন্ধুকন্যার সব কাজে। শুরু করলাম সহজ ভাষায় সহজ কথায় বঙ্গবন্ধুর জীবন-ঘটনা সব মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
এভাবেই শুরু। সেই থেকে ২০২১। প্রায় ২৫ বছর ধরে বছরের অন্তত ছয় মাস চলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখালেখি। বাকি সময়টা অন্য বিষয়ে জন্য রেখে দেওয়া। লেখা ও জানার সূত্রে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে নিঃশব্দে হাঁটাচলা।
১৯৯৫ সালের প্রথম দিন লেখা শুরু হলেও টেলিভিশন সাংবাদিকতা ছেড়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে ফুলটাইম লেখা শুরু ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই। এরপর জীবিকায় টান পড়ায় পরপর দুই প্রতিষ্ঠানে জড়াতে হয়েছিল। তবে বেশি দিন চাকরিটা টানা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর জীবন-ঘটনা এতটাই কৌতূহলী করে রাখে যে একসঙ্গে দুই কাজ করা গেল না। পারলাম না।
বন্ধুজনেরা বলতে থাকল তোমাকে ভূতে ধরেছে! মাথা থেকে লেখার রোগ নামাও! সত্যিই ভূতে ধরার মতোই ব্যাপারটা! টানাটানির জীবনে এবং বাংলাদেশের মতো দেশে লিখে জীবন চালানোর কথাটা মাখায় এলেই বুঝতে হবে ‘ভূতে-ধরা’ রোগে পেয়েছে। যে দেশে পাঠকসংখ্যা প্রায় হাতে গোনা, সে দেশে এমন রোগটি সত্যিই ভয়ংকর। লিখে তো চলা যায় না! চালানো যায় না প্রতিদিনের যাপিত জীবনের খরচ। সে জন্য পার্টটাইম এটা-সেটা করতে হয়েছে। এমনকি মাছ-মুরগির খুচরো ব্যবসার কাজ করতে হয়েছে শুধু লেখার কারণে। ঝরনা কলমের প্রতি ভালোবাসায়।
কথাগুলো বললাম, পাঠকের জেনে রাখা ভালো যে একটি বই লেখা শৌখিনতা নয়। লেখকের হাড়ে হাড়ে থাকে যন্ত্রণা। পরে বইটি যখন বের হয় তখন সেটি তো সন্তান ভূমিষ্ঠের মতো। ছাপা বইটি দেখলে দেহ-মনের সব ধুলাবালি ঝরে যায়। সরে যায় পেছনের দিনে জীবনের সঙ্গে এঁটুলির মতো লেগে থাকা বিষ-ব্যথা।
বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে লেখা আমার প্রথম বই শেখ মুজিব দ্য গ্রেট। বইটার পাণ্ডুলিপি চুরি হয়ে যায়। হঠাৎ ক্ষমতাবান হয়ে যাওয়া একজন শেখ মুজিব দ্য গ্রেট ইংরেজি ভাষায় ঘটা করে ছাপতে চেয়েছিলেন। যাকে ইংরেজি করতে দেওয়া হয়েছিল সে আমার পাণ্ডুলিপি খাবলে নিয়ে নিজ নামে প্রকাশ করে দেশের বাইরে থেকে। সে বড়ই কষ্টের ঘটনা। বড়ই বেদনার। মনে হলেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে প্রশ্বাস।
আজ থাক। নিশ্চয়ই কোনো একদিন এ বিষয়ে বিস্তারিত বলব। ২০১২ সালে প্রথম প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধু ভাষা ও মনোজগৎ। দুই বছর পর ২০১৪ সালে নতুনরূপে আরও কিছু যোগ-বিয়োগে ছাপা হয় বঙ্গবন্ধু ভাষা ও মন নামের বইটি। পরের বছর ২০১৫ সালে ছাপা হয় বঙ্গবন্ধু পূর্ণ জীবন । ২০১৬ সালে ১৫ আগস্টের ১০০ মিনিট। ২০১৭ সালে রাসেলের মা । ২০১৮ সালে হাসুর আকাশে। আর ২০২০ সালে ছাপা হলো বঙ্গবন্ধু অভিধান। এই মুহূর্তে যে বইটা নিয়ে কথা বলছি।
কথা বলছি বঙ্গবন্ধু অভিধান নিয়ে। অভিধান করতে গিয়ে প্রথম এবং সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা ছিল একজন মানুষকে নিয়ে একটা অভিধান কেমন হতে পারে? কেমন হবে অভিধানের বিষয়ক্রম। মোটকথা কীভাবে সাজিয়ে গড়ে তুলব অভিধান নামের ভারি বইটি? প্রশ্নগুলো মাথার ভেতর দৌড়াতে থাকে। কামড়ায়। প্রশ্নের দৌড়াদৌড়ি শান্ত করতে খুঁজতে থাকি অভিধানের রূপ-গঠন চূড়ান্ত করার কৌশল। পাশাপাশি চলতে থাকে প্রায় ২৫ বছর ধরে সংগ্রহ করা তথ্য যাচাই-বাছাই করে লেখার কাজ। যেন এক মলাটে বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবকিছু পাওয়া যায়। ওই সময়ে আবার প্রশ্ন জাগল কেবল বঙ্গবন্ধুর জীবন-ঘটনা রাখলেই চলবে না।
এমনভাবে এই জনপদের রাজনীতির আকাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সাজাতে হবে যেন ঘটনা-সূত্রে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর চলাফেরা। যে জীবনের ভেতর দিয়ে একজন শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন। এবং বঙ্গবন্ধু থেকে হয়ে উঠলেন জাতির জনক।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৯৪৭ সালের মর্মান্তিক দেশভাগ। ভাষা আন্দোলন। ছয় দফা সংগ্রাম। গণ-অভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ। এবং মুক্তিযুদ্ধের পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের উদ্যোগ। বাকশাল। দেশে ও দেশের বাইরে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং নৃশংস ১৫ আগস্ট।
বিস্তর-বহুরূপ ঘটনা জটলা তৈরি করে মনের মধ্যে। জটলা তৈরি হয় ঘরের মেঝের ওপর। যে মেঝের ওপর বসে আমার লেখা চলে। মনে হয় অনেকগুলো বড় ঘটনার ভেতর দিয়ে না দেখতে পারলে একজন বঙ্গবন্ধুকে চেনা যাবে না। বোঝাও যাবে না তিনি কোনো উত্তপ্ত সময়ের ভেতর দিয়ে বাংলার হৃদয় আকাশে ভালোবাসার বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন! হয়ে উঠলেন শ্রদ্ধার জাতির জনক।
এই কাজটা অনেক বড়। লম্বা সময়ে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনার সন্ধান। কাজটা একজনের না। অনেকের যৌথ কর্ম। তবে একটা টিম তৈরির সক্ষমতা আমার ছিল না। টিম মানেই তো টাকা! টিমের খরচ। সেই সাধ্য না থাকায় একলা আমাকেই চলতে হয়। চলতে হয় জটিল সময়ের ইতিহাসের সন্ধানে। একলা চলার পথটি সহজ ছিল না। ছাপা হওয়া বই যেগুলো পাওয়া গেল, তাতে খুব একটা সুবিধা হলো না। কিছু বইয়ের নাম জানলাম। কিন্তু সেগুলো ছাপা নেই। না পাওয়া বইটিকে সবচেয়ে দরকারি মনে হয় সব পাঠকের। আর আমার মতো নিষ্ঠ গবেষকদের তো ঘুমটাই চলে যায়। যতক্ষণ না ওই বইটি হাতে আসছে ততক্ষণ একে-ওকে-তাকে বলতেই হয় বইটার খবর জানাতে। এ রকম অন্তত একশ বইয়ের সন্ধান শুরু হয়। দু-এক দিন পরপর শুরু হলো নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানে যাতায়াত।
কথা বলছি বঙ্গবন্ধু অভিধান নিয়ে। কেবল নীলক্ষেত পুরোনো বইয়ের দোকান নয়, যাতায়াত শুরু হলো ন্যাশনাল আর্কাইভসহ অনেকের বাসায়। ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে খুঁজতে থাকলাম পুরোনো বই-পুস্তিকা-নথি। এমনকি তথ্য সংগ্রহের কাজে নামতে হলো কলকাতায়। লাইব্রেরিতে। বইয়ের দোকানে। ফুটপাতে। সবখানে যা পেলাম সেসব তথ্য খুঁটে খুঁটে বেছে বেছে সাজিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয় বছর তিনেক আগে।
একটু আগেই কথা হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু অভিধানের রূপ-গঠন নিয়ে। অভিধানের পাতায় তথ্য-ঘটনা সাজানোর জট খুলছেই না। কেমন হবে তথ্যক্রম? একসময় মনে হলো জীবন-ঘটনা ধরে এগিয়ে যাই। যেমন জন্ম। শৈশব। শিক্ষাজীবন। কারাজীবন। আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের কারাগারে। এ রকম শিরোনামে সাজিয়ে লেখাটা তৈরি হলো অনেকটাই। কিছুদিন পর নিজের লেখার কাঠামো নিয়ে একটুও খুশি হতে পারলাম না। এভাবে অধ্যায় সাজিয়ে তুললে তা থেকে শেখ মুজিব থেকে একজন বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পথটি ঠিকঠাক চেনা যাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু অভিধান নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। পরামর্শ চাইলাম। না, কোনো সুপথ বের হলো না। সে এক ছটফটানির সময়। চলতে চলতে একসময় চিন্তার দৌড়টা থামল। সিদ্ধান্ত নিলাম বঙ্গবন্ধু জীবনের উজ্জ্বল ৫৫ বছর জীবনের বছর ধরে সাজিয়ে তৈরি করি অভিধান। ১৯২০ থেকে ১৯৭৫। ৫৫ বছর। ৫৫টি অধ্যায়। সময়রেখায় বঙ্গবন্ধুর জীবনের পাশাপাশি রাখলাম জনপদে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা। যেন একজন পাঠক খুব সহজেই ওই বছরটা যেমন দেখতে পারেন। আবার একই সঙ্গে ঘটনার ভেতর দিয়ে দেখা যায় মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার দিনগুলো কেমন ছিল। এভাবে শুরু হলো বঙ্গবন্ধু অভিধান লেখার কাজ। এগোতে থাকল একটু একটু করে।
৫৫ বছরের জীবন এবং জনপদের ঘটনা লিখতে যেয়ে বহু বই-নথির সাহায্য নিতে হয়েছে। একটু বলে নিতে চাই বঙ্গবন্ধুর জীবনে এমনকি সব মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা থাকে, যে ঘটনা জানে শুধুই পরিবারের সদস্য। যেমন আমরা আজও জানি না কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে পিতা শেখ মুজিবের শেষ কথা হয় কোন দিন? কী কথা হয়েছিল দুজনের? টেবিলে কোন খাবার পেলে খুশি হতেন? এ রকম অনেক ঘটনা জানতে চেষ্টা করি। চেনাজানা দু-চারজনকে বললাম। যারা বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার কাছে সহজেই যেতে পারেন তাদের সঙ্গে। যদি তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া যায়, এই ভেবে। সেটা হলো না। এটা সম্ভব হলে বঙ্গবন্ধু অভিধান আরও সুন্দর হতো। গত বছর ২০২০ বইমেলার মাঝামাঝি সময়ে পাঠকের হাতে আসে বইটা।
বইটায় যা লিখতে চেয়েছি প্রকাশিত বইটায় আছে তার ৫০ ভাগ। এরপর থেমে থাকেনি আমার কাজ। চলতে থাকে তথ্য সংগ্রহ। এবং সেগুলো বঙ্গবন্ধু অভিধানে যুক্ত করি। এবার মানে ২০২১ সালে পাওয়া যাবে দ্বিতীয় সংস্করণ। যে সংস্করণে আরও ৩০ ভাগ যুক্ত হয়েছে। মানে এখনো বাকি রয়ে গেল ২০ ভাগ। আশা করছি তৃতীয় সংস্করণটি হবে প্রায় শতভাগ। তবে সেটিকেও পুরোপুরি শতভাগ বলা যাবে না। অনেক কিছুই থাকবে জানার বাইরে। যা হয়তো আমার পক্ষে কোনো দিনই সম্ভব হবে না। একটু বলেই রাখি কেন সেটা হবে না?
বঙ্গবন্ধুর জীবনের অনেক বড় এবং বেদনার ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টায় পাকিস্তানের কারাগারের দিনগুলো। এ বিষয়ে বিশেষ কোনো তথ্যসমৃদ্ধ বই নেই। পাকিস্তানের লয়ালপুর, মিয়ানওয়ালি কারাগারে নথি থেকে অনেক কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব। কাজটি অনেক খরচের। একই সঙ্গে সে দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের সাহায্য অত্যন্ত জরুরি, যা আমার পক্ষে আকাশ-কুসুম।
কুসুম আকাশেই থাকুক। আমার লেখা চলছে। চলবে। এখন প্রিয় ঝরনা কলমটি এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা শেখ হাসিনার জীবন নিয়ে বড় ক্যানভাসে বড় লেখার কাজে। এভাবেই দিন যাচ্ছে।