বাঙালি পাঠকের কাছে বড় জায়গা জুড়ে আছে বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ বই। গল্প, উপন্যাস আর কবিতার বইয়ের পাশাপাশি বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ বইয়ের প্রতি পাঠকের চাহিদা উল্লেখযোগ্য। ফলে অনুবাদ বইয়ের প্রকাশনা সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কিছু কিছু প্রকাশনা সংস্থা শুধুমাত্র অনুবাদকেন্দ্রিক বই নিয়ে মেলায় হাজির হয়। দেশের প্রকাশনা জগতে অনুবাদ সাহিত্য ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করেছে বলে মনে করেন অনুবাদক, পাঠক ও প্রকাশকরা। তবে পাঠকরা বলছেন, বইমেলায় প্রকাশিত বেশিরভাগ অনুবাদের বই সম্পাদনাহীন। বইয়ের মান নিয়েও তারা সন্তুষ্ট নন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাফসান প্রতিবার বইমেলা থেকে অনুবাদের বই কেনেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বইয়ের মান নিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে অনুবাদের যে বইগুলো বের হচ্ছে সেগুলোর সব যে মানসম্মত তা নয়। কিছু বইয়ের মান আছে। অনুবাদ লেখনিও সুন্দর। তবে একটা সমস্যা আছে এক্ষেত্রে। ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষার কোনো লেখকের বই কিন্তু সরাসরি অনুবাদ করা হয় না। এতে করে ভাষা পরিবর্তন হয়ে যায়। এছাড়া অনেক বই আছে যেগুলো পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয় না। মনে হয়, কী যেন নেই? গুগল ট্রান্সেলেটে অনুবাদ করলে যেমন হয়, তেমন।”
জনপ্রিয় কবি ও অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন মনে করেন, “শুধু অনুবাদের বই বের করলে হবে না। সেগুলোতে সাহিত্যমান অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। তিনি বলেন, “দুই-একটি প্রকাশনা ছাড়া কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সম্পাদনা বিভাগ নেই। তাদের যুক্তি হচ্ছে, সম্পাদনা বিভাগ করতে গেলে খরচ বাড়বে। এতে করে বইয়ের দামও বেড়ে যাবে। ফলে পাঠক বেশি দাম দিয়ে বই কিনবেন না। সম্পাদনা বিভাগ না থাকায় বইয়ের মান কমে যায়।”
এই অনুবাদকের ভাষ্য, “অনুবাদ বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। দেখা গেল কেউ ইতিবাচক বাক্যটিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করছে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো যত দিন সম্পাদনা বিভাগ না করবে, ততদিন এরকম ভুল অনুবাদ বের হতে থাকবে।”
রাজু আলাউদ্দিন আরো বলেন, “প্রতি বছর প্রচুর অনুবাদের বই বের হয়। এসব বইয়ের চাহিদা অনেক। মানুষ আসলে বিশ্ব সাহিত্য সম্পর্কে জানতে চায়। পাঠকের এই চাহিদা মেটানোর জন্য লেখকরা দ্রুত গতিতে অনুবাদ করেন। আবার এমনও শুনেছি গুগল ট্রান্সেলেটেও অনেক লেখক অনুবাদ করেন। অনুবাদ কখনো প্রযুক্তি দিয়ে মানসম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এটা পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা করা। এগুলো থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।”
গল্পকার ও অনুবাদক মোজাফফর হোসেন বলেন, “আমাদের দেশে মানহীন অনুবাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এটা খুব উদ্বেগের ব্যাপার। এর একমাত্র কারণ এডিটিং প্যানেল বা সম্পাদনা বিভাগ না থাকা। অনেক সময় লেখক যে লেখাটা জমা দেন, সেটাই ছাপা হয়। মূল যে ভাষার বই থেকে অনুবাদ করা হচ্ছে, সেটা প্রকাশক দেখছেন না। এতে করে সঠিক অনুবাদ হচ্ছে কিনা—সেটা সম্পর্কে প্রকাশক অজ্ঞাত থেকে যাচ্ছেন।”
কীভাবে পাঠক ভালো অনুবাদের বই চিনবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পাঠক যদি পাঠের সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে তৈরি হন তাহলে তারাই সঠিক বই খুঁজে বের করে নিতে পারবেন। পাঠক তো আবার সব অনুবাদ পড়বেন না। তাদের নিজস্ব পছন্দের লেখক আছে। এর বাইরে যারা বই কিনতে চান তারা যদি আগে থেকেই নতুন আসা অনুবাদের বই, লেখক সম্পর্কে জেনে যান তাহলে সঠিক অনুবাদের বইটি কিনতে পারবেন।”
এছাড়া অন্য অনুবাদকেরা বলছেন, অনুবাদের বই সম্পাদনা খুব জরুরি। এ জন্য ভাষা জানা-বোঝা মানুষের সময় নিয়ে মূল বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে কাজটি করা দরকার। যার কোনোটাই করা হয় না।
বইমেলায় অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থা থেকেই বের হয়েছে অনুবাদের বই। সন্দেশ, নালন্দা, ঐতিহ্য, ইউপিএল, প্রথমা, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স, সেবা প্রকাশনীসহ অনেক প্রকাশনী সংস্থার স্টল ও প্যাভিলিয়নে দেখা গেছে নানা ধরনের অনুবাদ বই।