করোনা মহামারিতে সারাদেশে বিধিনিষেধে অনেক কিছু বন্ধ থাকলেও চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। আজ (সোমবার) দুপুর ১২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বইমেলার কার্যক্রম চলে। কিন্তু এসময় সরকারি ও বেসকারি অনেক অফিস খোলা থাকায় প্রায় ক্রেতাশূন্য ছিলো বইমেলা।
বিকেল তিনটার দিকে মেলায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন ক্রেতা-বিক্রেতা ছাড়া মেলা প্রাঙ্গণ প্রায় শূন্য। স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোতে ক্রেতার অপেক্ষায় অলস সময় কাটাচ্ছেন বিক্রেতারা। দীর্ঘসময় পরপর দু-একজন দর্শনার্থী এলেও তারা এসেছেন আশপাশের এলাকা থেকে। মেলায় অবশ্য তাদের অনেকেই এসেছেন আড্ডা দিতে, বই কিনতে নয়।
একদিকে বইমেলা বারোটা থেকে পাঁচটা, অন্যদিকে গণপরিবহন বন্ধ—এ বিষয়টিকে সাংঘর্ষিক বলছেন বিক্রেতা ও প্রকাশকরা। বিক্রেতারা বলছেন, “বইমেলা নিয়ে বাংলা একাডেমি নাটকের জন্ম দিয়েছেন। বইমেলা নিয়ে চলছে খেলা।”
বিধিনিষেধের সময় বইমেলা এবং সময় নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন পাঞ্জেরী প্রকাশনীর স্টল ইনচার্জ মো. নুরুজ্জামান। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার দৃষ্টিতে বইমেলা নিয়ে চলছে খেলা। একদিকে লকডাউন চলছে, গণপরিবহন বন্ধ, দোকানপাটসহ সবকিছু বন্ধ। অন্যদিকে বইমেলা চালু। আমার মনে হয় বইমেলা নিয়ে খেলা হচ্ছে। এভাবে বইমেলা যতদিন চালু রাখা হবে প্রকাশকদের তত ক্ষতি। আমি মনে করি এই পরিস্থিতিতে বইমেলা বন্ধ করেও দেওয়াই ভালো।”
আদর্শলিপি প্রকাশনীর প্রকাশক জিয়াউল হক জুয়েল বলেন, “বইমেলাটা একটা হাস্যকর মেলায় পরিণত হয়েছে। একদিকে সরকার বিধিনিষেধ দিচ্ছে, সকল প্রকার গণপরিবহন বন্ধ, সেখানে বইমেলা কিভাবে হয়? অন্যদিকে এই গরমের মধ্যে ১২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বইমেলা আমার কছে হাস্যকর মনে হচ্ছে। প্রকাশক হিসেবে বইমেলায় ঢুকে আমার খারাপ লাগছে।”
জিয়াউল হক আরো বলেন, “আমার মনে হয় সরকার যদি বলে যে বইমেলা বন্ধ তাহলে একটা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সরকার চাচ্ছে যে প্রকাশকরা ইচ্ছে করেই চলে যাক। তো, এভাবে বইমেলা হওয়ার কোনো দরকারই ছিলো। বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিলো। শুধু শুধু মানুষকে কষ্ট দেওয়া।”
পুঁথিনিলয় প্রকাশনীর ম্যানেজার আলমগীর অরণ্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “লকডাউনে আমরাই আসতে পারি না, ক্রেতা-পাঠকেরা কিভাবে আসবেন? আমরা একজন ক্রেতার কাছে বই বিক্রি করতে পেরেছি। এটাই মনে হচ্ছে অনেক বেশি বিক্রি করে ফেলেছি। এটাই আমাদের শুরু এবং শেষ।”
এমন পরিস্থিতিতে সমাধান কী হতে পারে জানতে চাইলে আলমগীর অরণ্য বলেন, “এর কোনো সমাধান নেই। মেলা যত দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হবে, ততই সবার জন্য মঙ্গল।”
অন্য প্রকাশের স্টল ম্যানেজার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “গণপরিবহন বন্ধ, কারা আসবে মেলায়? বইমেলায় অনেক ধরনের পাঠক আসে—স্কুলকেন্দ্রিক, পরিবারকেন্দ্রিক, বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসে। যদি আমাদের গণপরিবহন খোলাই না থাকে তাহলে তারা কিভাবে মেলায় আসবে?”
তৌহিদুল আরো বলেন, “লকডাউনের মধ্যে বইমেলা খোলা রাখাটা স্টলকর্মী ও পাঠকদের জন্য একটা ঝামেলার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সময় বইমেলা খোলা রাখা কোনভাবেই সম্ভব না। কোনো বেচাবিক্রি নেই। শুধু শুধু আসা হচ্ছে। আমাদের স্টল খরচ আছে, যাতায়তের খরচ আছে। আমি মনে করি সরকার এবং বাংলা একাডেমি একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত দেবেন।”
দেশজ প্রকাশনীর বিক্রেতা মনিরুল ইসলাম বলেন, “আজকে বেচাবিক্রি বলতে কিছুই নেই। শুধু ভর্তুকি দিয়েই যাচ্ছি। যারা মেলায় আসছেন তারা আশপাশের মানুষ, তারা হয়তো রিল্যাক্স করার জন্য আসছেন। আমার মনে হয় মেলার জন্য যদি কিছু পরিবহন চালু করা যেত, তাহলে পাঠকরা আসতে পারতো। আমি উত্তরা থেকে সিএনজি ভাড়া করে এসেছি। সে টাকাটাও উঠবে না।”
বইঘর প্রকাশনীর বিক্রেতা আবদুর রহমান ভাসানী বলেন, “কেউতো ঘর থেকে বের হচ্ছেনা। একদমই বেচাকেনা নেই। কোম্পানীর শুধু খরচ বাড়ছে। যেমন ধরেন, আমি যাত্রাবাড়ি থেকে এসেছি। আরো দুজন আসছেন। আমাদের আসতে ৫০০ টাকা খরচ হয়েছে, অথচ আজ চার-পাঁচশ’ টাকাও বিক্রি করতে পারছিনা।”
ঢাকা টাইমস প্রকাশনীর স্টল ইনচার্জ আসাদুজ্জামান লিমন মনে করছেন বিধিনিষেধ থাকায় ভালোই হয়েছে। তিনি বলেন, “এটার অবশ্য ভালো দিক আছে। লকডাউনের মধ্যে বইপ্রেমীরা আসছেন। বইও কিনছেন। যদিও সেটা সংখ্যায় কম। যারা আসছেন তারা আসলে প্রকৃত বইপ্রেমিক।”
বইমেলায় কথা হয় আমিনুল ইসলাম নামে একজন পাঠকের সঙ্গে। তিনি বলেন, “যারা বইকে ভালোবাসেন তারা আসলে সব বাধা অতিক্রম করে চলে আসবেন। পাঠক যদি বই না পড়ে আসলে বইয়ের কোনো অর্থ থাকে না। সে কারণে বইমেলায় আসলাম, ঘুরলাম, বই কিনলাম।”
বইমেলার ১৯তম দিনে মেলা শুরু হয় ১২ টা থেকে। শেষ হয় বিকেল ৫টায়। বইমেলায় আজ ২৮টি নতুন বই এসেছে ২৮টি। উপন্যাস ১টি, প্রবন্ধ-৫ টি, কবিতা-১০টি, ছড়া-১ টি, শিশুসাহিত্য ১টি, জীবনী ২টি, মুক্তিযুদ্ধ ১টি, নাটক ১টি, ভ্রমণ ১ টি, ইতিহাস ৩ টি, বঙ্গবন্ধু ১ টি, অন্যান্য ১টি বই।