আত্মজৈবনিক উপন্যাস 'অতলের কথকতা'র কথাকার বুলবুল চৌধুরীর সময় এখন থেমে আছে বিছানায়। লড়ছেন ক্যান্সারের সঙ্গে। ফুসফুসের ক্যান্সার ছড়িয়ে পরেছে রক্ত ও মস্তিষ্কে। শারীরিক অক্ষমতার কারণে দেয়া যাচ্ছে না কেমোথেরাপি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সারওয়ার আলমের তত্ত্বাবধানে চলছে তাঁর চিকিৎসা। চলছে রেডিওথেরাপি। এরমধ্যেই ব্যয় হয়েছে প্রচুর অর্থ। এ বছরেই একুশে পদক পাওয়া বুলবুল চৌধুরী ‘টুকা কাহিনী’, ‘মাছের রাত’, ‘এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে’, ‘জলঢুঙ্গী’সহ নানা গ্রন্থের লেখক।
ক্যান্সারের সাথে বসবাস করা এই কথাসাহিত্যিক বিছানায় শুয়ে শোনালেন ‘মেঘবেলার ছেলেবেলা’র গল্পের মতো আরো অনেক গল্প। শোনালেন আক্ষেপ।
যে শিল্পের ঘোর আর উদ্যোমে তিনি সবার প্রিয় বুলবুল চৌধুরী, তা যেন অনেকটাই ম্লান ক্যান্সারের দাপটে। লম্বা চুলের মাথা প্রায় চুলহীন। শরীরটা আরো শীর্ণ। চোখদুটো যেন বেরিয়ে আসতে চায় অক্ষিগহ্বর থেকে। বিছানায় শুয়ে তাঁর মৃত্যু চিন্তা পেরিয়ে আকুতি, শিল্পের কাছে ফিরতে চান তিনি।
বুলবুল চৌধুরী বললেন, “শামসুর রাহমানকে দেখতাম তাঁকে মৃত্যু চিন্তা নিয়ে প্রশ্ন করলে খুব রেগে যেতেন। আমিও রেগে যেতাম। ভাবতাম মৃত্যুটা কেমন? কিন্তু এখন দেখছি, বেঁচে থাকার তৃষ্ণা। মরে গেলে তো গেলামই। এখন মনে হয় যে কিছু কাজ আছে। কাজের সম্ভাবনা আছে। বেঁচে থাকলে কাজগুলো করতে পারি। আমি এ পর্যন্ত যা লিখেছি, কিছু কাজ হয়ে গেছে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে। সে জন্য তৃষ্ণা হয় যে, এগুলো পূর্ণ করবো।”
“আমার পরিচিতি ‘টুকা কাহিনী’ দিয়ে। এটি দিয়ে আমি নাম কামাই করে ফেলেছিলাম। এখন আমার হাতে কাজ আছে। একটা হচ্ছে 'মেঘমেদুর ছেলেবেলা'। মিষ্টি মধুর ছেলেবেলা, যে ছেলেবেলাটা গ্রামের, যে ছেলেবেলাটা শুধু আমার গ্রামের নয়, পুরো মাটি, আমি, আমার বিবর্তন-এই কাজটা চলছে এখন। আমি মনে করছি, এটা আমি লিখতে পারলে, এটা শুধু আমার আত্মজীবনী নয়, এটা বাংলাদেশেরও একটা আত্মজীবনী হবে।”
“আর দ্বিতীয় একটি কাজ, আপনি তো জানেন, আমার জন্ম ভাওয়াল অঞ্চলে। বাড়িতে একটি তেতুল গাছ ছিল। বিশাল। সেই তেতুল গাছে উঠতে গেলে মানুষ ভয় পেতো। তাদের কাছে আমি ভাওয়ালের গল্প শুনতাম। গল্প শুনতে শুনতে তেতুল গাছে উঠে গেছি। বাঁশ দিয়ে। বুঝতে পারছেন! পরে ভাওয়াল রাজার সন্ধানে বের হয়েছি। কিছু লোকজন ছিল, যারা জানতেন এই সম্পর্কে কিছু। আমি পড়া যে বিশাল করেছি, তা নয়। যেটা হয়েছে, ভারত থেকে কিছু বই জোগাড় করেছি। সে বইগুলোতে ইতিহাসটা আছে। উপন্যাস হয় নাই। আর আছে নাটক। ভারত-বাংলাদেশে ফিল্ম হয়েছে। আমি দেখলাম এগুলো উল্টেপাল্টে, আসলে ঠিকভাবে ভাওয়াল রাজা হয়ে ওঠে নাই। ভাওয়াল আসলে অনেক ব্যপ্ত। এটার ভেতর যে জীবনযাপন—চমকে যাওয়ার মতো। এতো চিরায়ত। রাজা বলেন, রানী বলেন, তাদের পরকীয়া বলেন, তুলনাবিহীন। মানে, এটা ঠিকভাবে লেখা হলে, থরহরিকম্প হয়ে যেতো। যা চিরকাল টিকে যাবার মতো। ফলে এটার দিকে আমি ঝুঁকে আছি। ভালোকাহিনী পাওয়া মুশকিল। আর ঐতিহাসিক কাহিনী নিয়ে তো অনেকেই কাজ করেছেন। আমি এখন এই দুইটা কাজ নিয়ে চাঞ্চল্য বোধ করছি। আর লেখার তেষ্টা তো আছেই।”
“এটা বুঝি যে, আমি বেশ বড় লেখক। নিজেরটা নিজে বলছি। কিন্তু রাস্তায় বের হলে সবাই বলে, বিরাট লেখক। সবাই ওস্তাদ বলেই ডাকে। কে না আদর দিয়েছে। শুরু করেছেন মান্নান সৈয়দ। টুকা কাহিনী বের হবার পর পুরো বাংলাদেশের চোখ পড়েছিল আমার ওপর। এর মধ্যে মান্নান সৈয়দ বেশী ঝুঁকে পড়েছিলেন। এই বইটাতে মান্নান সৈয়দের ভূমিকা দেখলেই বুঝবেন, আমার যাত্রাটা ছিল বড়। মান্নান সৈয়দই আমাকে আবিষ্কার করেছেন। আরেকজন বড় মানুষের কথা বলব, শামসুজ্জামান খান। এরা আমাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। লালন-পালন বলতে যা বোঝায়, তা করেছে।”
“আমি জুবিলী স্কুলের ছাত্র ছিলাম। লেখার ইচ্ছেটা হয় নাই। ইচ্ছে ছিল সিনেমা বানানোর। এর মধ্যে আমার বন্ধু কায়েস আহমেদ বলল, তুই গল্প লেখ। একদিন সে আমাকে বিউটিতে নিয়ে গেলো। বিউটি বোর্ডিং তখন কবিদের আড্ডা। আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, কায়েস আহমেদের দলে ভিড়ে গেলাম। আর আমার তখন পয়সা ছিল। একটা চাকরি ছিল। ৩১২ টাকা বেতন। চাকরির পয়সা আর বাড়ির ধানের পয়সা—এগুলো দিয়ে বেশ ভালোই চলত। হঠাৎ মনে হলো, আমি যদি লিখতে না পারি, তাহলে এদের সাথে দল বাঁধলাম কেন? হাসানকে ধরলাম। সে তো বাঁদরের হদ্দ। তো একটা কবিতা লিখলাম। ‘রঘুবংশীর বাংলাঘরে’ নামে সেই কবিতা পড়ে হাসান বলল, কবিতাটা তো ভালোই। কিন্তু তুমি এর নাম দাও ‘প্রাকৃত কবিতা’। আমি চিন্তা করলাম, কবিতা লিখে ওদের সঙ্গে পেরে উঠব না, আমাকে গদ্যই লিখতে হবে।”
“আমার লেখা প্রথম বেরোয় ১৯৬৭-তে। ওই সময় জগন্নাথ কলেজ একটা গল্প লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আমার গল্পের নাম ছিল ‘জোনাকি ও সন্নিকট কেন্দ্র’। লেখাটা দ্বিতীয় হয়। ওই গল্প পরে কামাল বিন মাহতাব সম্পাদিত ‘ছোটগল্প’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।”
বুলবুল চৌধুরী ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট গাজীপুরের দক্ষিণবাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য একুশে পদক ছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক, সমকাল সাহিত্য সহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।