নাম তার কাঞ্চনজঙ্ঘা। হিমালয়ের কন্যা সে। অপরূপ সৌন্দর্যে আর ঔদ্ধত্যে মাথা তুলে জেগে আছে পৃথিবীর বুকে। আর আছে এক স্পর্ধিত মাতাল আহ্বান। কুমারী মেয়ের গোপন সৌন্দর্যের মতো ওর থেকে দৃষ্টি ফেরানো যায় না। যত কাছে যাই, তত কাছে ডাকে সে। সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়, মেঘের সঙ্গে চলে আর নিত্য লুকোচুরি খেলা।
একদিন আমরা কজন এই অনিন্দ্য সুন্দরী রাজকুমারীকে কাছ থেকে দেখার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গন্তব্য হলো দার্জিলিং, সান্দাকফু হয়ে ফালুট পৌঁছানো। আমাদের পথে পড়বে মানেভঞ্জন, চিত্রা, মেঘমা, লামেধুরা, টুমলিং, গাইরিবাস, কালিপোখারি। আমাদের ১৭ জনের দলটি ভিসার রুট অনুযায়ী দুভাগে বিভক্ত হয়ে হরিদাশপুর ও চ্যাংরাবান্ধা হয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছালাম। আমরা যারা চ্যাংরাবান্দা দিয়ে এলাম তারা পুরো রাস্তা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে এসেছি। শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে রওনা হলাম। পাহাড়ের ওপর যত উঠছি এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখে তত মুগ্ধ হচ্ছিলাম। দার্জিলিংয়ের এই পথটুকু যেন কোনো শিল্পীর নিপুণ হাতের আঁকা অনুপম চিত্রকর্ম। পাহাড়ের ওপর দিয়ে বাঁধানো রাস্তা, কিছু দূর পরপর ঝিরি, ঝরনার কলতান আর পাহাড়ি বাড়িগুলোর সামনে ছোট্ট বাগান, নাম না জানা নানা রঙের ফুল– লাল, হলুদ, বেগুনি... সবকিছু যেন এক স্বপ্নময় জগৎ তৈরি করেছিল। অপেক্ষা করছিলাম কখন পৌঁছাব দার্জিলিং। সেই দার্জিলিং! ছোটবেলা থেকে যাকে নিয়ে মনের পর্দায় কত রঙের ছবি এঁকেছি, যাকে দেখবার জন্য কত বছর অপেক্ষা করে আছি। হয়তো মনে মনেও অপেক্ষা করেছি। সত্যজিৎ রায়ের কাঞ্চনজঙ্ঘার কথা খুব মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল কবিগুরুর কথা, পিতার সঙ্গে হিমালয়ে বসে উপনিষদ আর ধ্যানময় দিনগুলোর কথা। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘণ্টা তিন পার হয়ে গেল, টেরই পাইনি। চলে আসি কার্শিয়ং, তারপর ঘুম রেলস্টেশনে, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্টেশন যেটি। আমাদের পথ আটকে মাঝে মাঝে হেলতে-দুলতে ধীরলয়ে চলছিল টয় ট্রেন। একসময় আমরা পৌঁছে যাই দার্জিলিং। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ের বুকে জ্বলে উঠেছে সহস্র তারার ফুল। আকাশের তারাগুলো যেন নীরবে ভূমে তৈরি করে চলেছে নিজেদের প্রতিবিম্ব। নভোমণ্ডলের আর মর্ত্যলোকের তারাদের আছে কত গল্প। এক একটি আলোকবর্তিকার নিচে কত হাসি-কান্না, বেদনা, আনন্দ মিশে আছে। হোটেলের বারান্দায় বসে এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে লক্ষ জীবন যেন কাটিয়ে দেওয়া যায়। হালকা ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম রাতের দার্জিলিং দেখতে। এখানে সবকিছু আটটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। আমরা মমো আর চাওমিন দিয়ে ডিনার সারলাম। মল চত্বরে বসে বসে দেখছি ব্রিটিশদের তৈরি সভ্যতা। রাত তখন নয়টা। ঘুমিয়ে পড়েছে পুরো দার্জিলিং শহর। বাতাসের আলোড়নে থেকে গেছে জনতার কলরোল।
পরদিন সকালে আমরা খেতে গেলাম ব্যানিশ রেস্তোরাঁয়। মেনু ছোলে-ভাটুরে। একটা বিশেষ কারণে রেস্টুরেন্টটি আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। এত চমৎকার করে সেখানে বাজছিল গায়ত্রি মন্ত্রের সুমধুর সুর, পুরো সকালটাই যেন এক পবিত্র বোধে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
দার্জিলিংয়ে তখনো আমাদের পুরো টিম এসে পৌঁছায়নি। আপাতত দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর সবকিছু দেখভালের। দুপুরে সবার জন্য আবার হোটেল ঠিক করে চলে গেলাম আমরা কেব্ল কারে চড়তে। কেব্ল কারে চড়ার সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভেসে ভেসে যাচ্ছি, মেঘের অহমে নেচে নেচে। নিচে বিস্তীর্ণ চা-বাগানের সবুজ। প্রায় ২০ মিনিট ধরে আমরা অন্য প্রান্তে পৌঁছে বসলাম এক ক্যাফেতে। পাহাড়ের ওপর বসে বসে চা খেতে খেতে দেখলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা। নির্লজ্জের মতো সমস্ত সৌন্দর্যের ডালি খুলে বসে আছে। কিন্তু পুরা রহস্য তার অধরাই থেকে যায়। আবার ফিরতি যাত্রা। কেব্ল কার থেকে নেমে, গাড়িতে না উঠে আমরা পাহাড়ের ওপর দিয়ে ট্র্যাকিং করে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। গোধূলিবেলায় পাহাড়ের যে এক অপরূপ দৃশ্য সৌন্দর্য। আমরা এগিয়ে চলছি আর দেখছি ক্ষণে ক্ষণে আকাশের রূপ বদলের দৃশ্য। হলুদ, কমলা, লাল রক্তিম আভা যেন ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত পাহাড়ের বুকে। পাহাড়ের রাস্তায় হেঁটে চলছি এক বুনো গন্ধ নিয়ে, মনে হচ্ছিল সত্যজিতের সিনেমার শুটিং এখানেই নিশ্চয়ই হয়েছিল। প্রায় দেড় ঘণ্টার এই ট্র্যাকিং আমাদের একটুও ক্লান্ত করেনি, বরং এনে দিয়েছে এক অপূর্ব প্রশান্তি।
হোটেল ফিরে দেখি, আমাদের পুরো টিম চলে এসেছে। এবার শুরু হলো আমাদের আসল আনন্দ। সবাই একসঙ্গে সারা দিন আড্ডা দেওয়া, খুনসুটি করা আর সবকিছু ঘুরে দেখা। কে বলবে এর আগে অধিকাংশই আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না। নিমেষেই যেন একটা পরিবার হয়ে গিয়েছি। পরদিন দেখলাম, রক গার্ডেন, চুন্নু সামার ফলস, চিড়িয়াখানা, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট ও জাদুঘর, বাতাসিয়া লুপ, পথে পথে তো চোখ জুড়ানো চা-বাগান আছে। এখানে দেখলাম মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের নানা খুঁটিনাটি বিষয় আর মহান পর্বতারোহীদের স্মৃতিচিহ্ন। সন্ধ্যায় কেউ কেউ গেল সিনেমা হলে, তবে আমরা কয়েকজন এই সময়কেই আরও বেশি উপভোগ করতে চাইলাম।
এর পরদিন শুরু হলো আমাদের আসল অভিযান। দার্জিলিংকে বিদায় জানিয়ে আমরা ছুটলাম সান্দাকফুর উদ্দেশে। খুব সকালে রওনা দিয়ে আমরা মানোভঞ্জন এসে পৌঁছালাম। যার একপাশে নেপাল একপাশে ভারত। এখান থেকে দুটো চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে আমরা পাহাড়ের উঁচু পথে চলতে লাগলাম। পাহাড়ের বুকে সারি সারি পাইনগাছের ফাঁক গলিয়ে আছড়ে পড়ছে সূর্যের কোমল রশ্মি। প্রায় তিন কিলোমিটার পাহাড়ের ওপর খাড়া উঠে আমরা পৌঁছালাম চিত্রের মন্দিরে। নানা রংবেরঙের কাপড়ে মন্ত্র লিখে সাজিয়ে রাখা হয় এখানকার প্রতিটি মন্দির, পবিত্র তীর্থভূমি। চিত্রের এই জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। পাহাড়ের ওপর থেকে দেখছি কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনাবরণ রূপ, আর নিচে সবুজের হাতছানি।
এরপর গাড়ি গিয়ে থামল লামেধুরায়। একটু আগে যেখানে সূর্যের প্রচণ্ড প্রতাপ দেখলাম, মেঘের মোহে তার সমস্তটুকু হারিয়ে গেল। মুহূর্তেই আমরা মেঘের সঙ্গে মিশে গেলাম। কাছের মানুষগুলোও ঝাপসা হয়ে উঠছিল মেঘের কারণে। সেই মেঘের সমুদ্রে ভেসে থাকলাম, মেঘের স্পর্শগুলো গায়ে মাখলাম, মনকে মিশিয়ে দিলাম মেঘের সঙ্গে। কান পেতে থাকলাম। কী যেন বলতে চায় সে। কী বাণী পাঠাবে সে।
আবার যাত্রা শুরু করলাম। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা, বন্ধুর পথ। দুপাশে ঘন সবুজের হাতছানি। আমি ভেবেছিলাম, সান্দাকফুর পথটা হবে পাহাড়ি, রুক্ষ, পাথুরে। কিন্তু না। এ যে আমাদের বান্দরবানের মতোই সবুজ, শ্যামলে শ্যামল আর নীলিমায় নীল। আমরা ক্রমশ ওপরে উঠছি। আর সবুজগুলো যেন ঈর্ষায় মরে যাচ্ছে। ওরাও যে আকাশের নীলকে ছুঁতে চায়। এবার আমার পৌঁছালাম মেঘনমায়, মেঘের রাজ্যে। মেঘের রূপ যে কত রকমের, কত সৌন্দর্যের হতে পারে, তা এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না, এখানে মেঘই সব। মেঘের কাছে অন্য চরিত্ররা হার মেনে যায়। দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন ব্রহ্ম সুন্দর। মেঘ তাকে আগে থেকেই পৌঁছে দেয় আমাদের আগমনী বার্তা।
আবারও আমরা এগিয়ে চলছি। মেঘ আর সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে। বোদলেয়ারের সেই আশ্চর্য মেঘদল, যারা চিনিয়ে নিয়েছে আমাদের পথ সত্য, বিদীর্ণ। ভীষণ সুন্দর এই যাত্রাপথ। একদিকে গিরিখাদ, যার দিকে তাকালে প্রমাণ করে দেয় কতটা উচ্চতায় আছি আমরা। অন্যদিকে উঁচু-নিচু বালিয়াড়ির মতো ছোট্ট ছোট টিলা। মাঝে মাঝে বনফুলের ঝোপ, ক্যাকটাস, স্তরে স্তরে সজ্জিত পাপড়ি। রেড পান্তাদের অভয়ারণ্য। পাহাড়ি বুনো গন্ধ শীতের মতো ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র শরীরে, মনে, চৈতন্যে। যেদিকেই চোখ পড়ে, সেদিকেই নীল নীল পাহাড় দূর দিগন্তে হাত ধরাধরি করে ছোট ছেলেমেয়ের মতো সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে। ওপরে নীল আকাশ, ইন্দ্রনীলমণির মতো নীল তার তলায়, হলুদ-খয়েরি রঙের পৃথিবী।
টুমলিংয়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা গাইরিবাসে এসে পৌঁছালাম। মনকে প্রবোধ দিলাম, ফেরার পথে এখানে তো এক রাত থাকছিই। গাইরিবাসে আর্মি ক্যাম্প, আবারও চা-পানের বিরতি। হঠাৎ কোত্থেকে ভেসে এলো একটা নেপালি গান। ব্যস, আর যায় কোথায়। রাস্তার মধ্যেই আমার নাচতে শুরু করে ছিলাম। আসলে প্রকৃতির এই রূপ আমাকে ভেতরের সহজিয়া শিশু সত্তাটাকেই বের করে আনে।
আবারও আমাদের ছুটে চলা। যত এগোচ্ছি কাঞ্চনজঙ্ঘা তত স্পষ্ট হচ্ছে, ওর বিশাল আকৃতি মেলে ধরছে। এ কেমন যেন মাতাল আহ্বান! মনে হয় যেন, আরেকটু এগোলেই বুঝি ওকে ছুঁতে পারব। কিন্তু যতই ওর কাছে পৌঁছাতে যাই, ও ক্রমেই যেন দূরে সরে যায়। এ এক অদ্ভুত মজার খেলা! আহ্বান আছে, প্রত্যাশা জাগিয়ে রাখছে, অথচ প্রাপ্তির কোনো পথ নেই। আর মেঘগুলো ওর সৌন্দর্যের কাছে হার মেনে সমস্ত আকাশ ছেড়ে ওর পদতলে লুণ্ঠিত হয়ে আছে। যেন বলছে, আমি আমার সমস্ত কিছু ত্যাগ করে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমাকে গ্রহণ কর। আমার চলিঞ্চুতা রুদ্ধ করো। আমি যে তোমার মতো স্থির হতে চাই, দৃঢ় হতে চাই। আর যেই মেঘ স্থির থেকে স্থিরতর হতে হতে, পরস্পর পরস্পরের হাত ধরে তৈরি করে দিয়েছে এক স্বর্গীয় পথ। আমরা সেই পথ ধরে চলতে চলতে একসময় পৌঁছে যাব স্বর্গে। পাহাড়ের ওপর থেকে এই সৌন্দর্য দেখছি আর ভাবছি, এ মেঘের পরাজয় নয়। বরং পর্বতের প্রেমের কাছে সমর্পণ ওকে আরও বিনয়ী করে তুলেছে, সুন্দর করে তুলেছে, এক শাশ্বত গন্তব্যের কাছে নিয়ে চলেছে।
অন্যপাশে সিংগালিলা সাফারি বন। সারি সারি গাছ পাহাড়ের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে মাঝে ঝিরিপথ। আর সূর্যদেব ওদের কারণে ঠিকমতো নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে না। বহু কষ্টে এ গাছের ও গাছের ফাঁক গলিয়ে আলোর সুড়ঙ্গ তৈরি করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে চলেছে। আর পাহাড়ের ওপর থেকে আমরা গাছগুলোর অদ্ভুত সৌন্দর্য দেখে চলেছি। পাতার কী রং! লাল, হলুদ, সাদা, সবুজ, খয়েরি, বেগুনি। এত রঙের গাছের পাতা যে থাকা সম্ভব, তা কখনো কল্পনাতেও আসেনি। ভ্যান গগ বুঝি এখান থেকেই রং ধার করে তাঁর তুলিতে মেখেছিলেন।
এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা কালপোখারি পার হয়ে পৌঁছে গেলাম সান্দাকফুর সীমানায়। সারা রাস্তাজুড়ে অসংখ্য ট্র্যাকার দেখলাম, যারা মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফুর ৩৮ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা ট্র্যাকিং করতে করতে চলেছে। আসলে এটি পৃথিবীর অন্যতম একটি ট্র্যাকিং রুট। গাড়ির পথটা তাই শক্ত, পাথুরে। যা-ই হোক, সান্দাকফুর প্রান্তে এসে আমরা গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। কারণ, এই শেষ অংশটি খুব বিপজ্জনক। এখানে গাড়ির চাইতে ট্র্যাকিং করে যাওয়াটাই বেশি নিরাপদ। কিছুক্ষণ পাহাড় বেয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম সান্দাকফুর মূল পয়েন্টে। এক অপার বিস্ময় নিয়ে এবার কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখলাম। এত কাছে সে! যেন হাত দিলেই স্পর্শ করা যায়। মেঘগুলো পরম আনন্দে ঘিরে রয়েছে তাকে। এর চেয়েও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। কাঞ্চনজঙ্ঘার পাশে ওরই মতো সৌন্দর্যের আরও কিছু বিশাল পর্বত চোখে পড়ল- ওটাই এভারেস্ট। আর মাঝখানে থ্রি সিস্টারস, এই সেই এভারেস্ট! পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্ঘ। যাকে জয়ের স্বপ্ন মানুষের আজন্ম লালিত। জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে কত দুঃসাহসী অভিযাত্রী ওর চূড়ায় ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছে। কেউ সফল হয়েছে, কেউ হয়নি। যারা সফল হয়েছে, তাদের বুক পেতে স্থান করে দিয়েছে। আর যারা পারেনি, নির্বোধ প্রেমিকের মতো যারা ওর দিকে হাত বাড়িয়েছে, তাদের প্রতি চরম নিষ্ঠুর হয়েছে, কেড়ে নিয়েছে কখনো জীবনটুকুও। এই পর্বতশৃঙ্ঘ কত সহস্র, অযুত, নিযুত কালের সাক্ষী। সৃষ্টির শুরু থেকে আদি, অন্ত, অনাদিকাল প্রত্যক্ষ করে যাচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসের ধারা পরম্পরা। ওর প্রতিটা খাঁজে খাঁজে কত আনন্দ বেদনা সংগ্রাম, জেদ, অভিমান আর একাগ্রতার গল্প মিশে আছে। প্রভাতের প্রথম সূর্যকে স্পর্শের অধিকার তার সর্বাগ্রে। সবচেয়ে উঁচু মেঘটিকেও পরাজিত করার ক্ষমতা তার। অথবা কখনো হয়তো মেঘ দেখে তার মধ্যে আক্ষেপ জন্মে। একদিন হয়তো তার নিজেরও পাখা ছিল। ইকারুসের মতো অথবা বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘের মতো উড়ে বেড়াত আকাশ ছোঁবে বলে। সমস্ত ডানা মেলে পেয়েছিল ওড়ার আকাশ। একদিন দেবরাজ ইন্দ্র সমস্ত পর্বতের পাখাগুলো কেটে দেন। সেই থেকে ও স্থির, দৃঢ়, বিশাল এক সত্য।
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে এসেছি। এভারেস্ট দেখব ভাবিনি। সান্দাকফুর সর্বোচ্চ চূড়ায় ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে ঈশ্বরের এই অনবদ্য সৃষ্টি যত দেখছিলাম, নির্বাক বিস্ময়ে উপলব্ধি করছিলাম এর অন্তরতম স্পন্দন। একপাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা, আরেক পাশে এভারেস্ট। পৃথিবী সৃষ্টির অনেক পর সৃষ্ট কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দুজনের জন্ম, একত্রে আছে সেই সময় থেকে। ওদের সংসারে এলো তিনটি কন্যা। মাঝখানে চলছে সেই তিন বোনের খুনসুটি। ৮ হাজার মিটারি এভারেস্ট, মাকালু, লোৎসে ছাড়াও আছে কুম্ভকর্ণ, পান্দিম, রাতং, শিম্ভু, কোকতাংসহ সিক্কিম-নেপালের অসংখ্য পর্বতের স্পষ্ট সান্নিধ্য। পাহাড়ের অন্যপাশে মেঘ, মেঘের চাদর। দিনের শেষ সূর্য ওদের ওপর ফেলছে রক্তিম আভা। লাল, নীল, সাদা, হলুদ, কামলা সব মিশে যে এক অপূর্ব সৃষ্টি।
সন্ধ্যায় আমরা ফিরে এলাম সান্দাকফুতে, আমাদের নির্ধারিত হোটেলে। আমাদের জন্য তখন খাবার তৈরি। খিচুড়ি, ডিমভাজা, বাটার আর একটা টক আচার। সারা দিনের অভুক্ত মানুষের কাছে এত অমৃত! গোগ্রাসে খেয়ে আমরা মেতে উঠলাম আড্ডায়। ততক্ষণে প্রচণ্ড শীতে আমরা কাঁপছি। গায়ে মোটা মোটা জ্যাকেট, কানটুপি, মাফলার, সব চাপিয়ে দিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই কিন্তু হচ্ছে না। কাজেই আড্ডায় জমিয়ে পরিবেশটাকে গরম রাখার চেষ্টা চলছে। কিছুক্ষণ পর আমি সমস্ত শীতকে উপেক্ষা করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আর যা দেখলাম, তা আমার জীবনের এক শুদ্ধতম পাথেয়, অমূল্য সঞ্চয়। রাতের অন্ধকারেও কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এভারেস্ট হীরকখণ্ডের মতো জ্বলজ্বল করছে। যেন সমস্ত পৃথিবীকে পুণ্য বিতরণের ভার তার ওপর। আর এ দৃশ্য মুক্ত বিস্ময় নিয়ে দেখছে আকাশের সমস্ত তারা, নক্ষত্রমণ্ডল জ্বলজ্বলে সত্তা। মহাবিশ্বে, মহাকাশে, মহা আলোর মাঝে আমাদের এই মানবজন্ম যেন শাশ্বত, অসীম, চলমান। এই সমস্ত বিশালতা, শুদ্ধতা নিয়ে আমরা বেঁচে আছি আদি থেকে অন্তহীন। এই সমস্ত তারার মাঝে যেন কার নাম বাজে। কোন মহাশক্তির কোন পরমাত্মা সে। মহানামের যে ধ্বনি যেন আকাশ ছেড়ে নেমে এলো পৃথিবীতে, স্পর্শ করে গেল আমার ললাট, আমার হৃদয়। আর যার শান্তি ধারায় আমার সমস্ত বেদন মুছে গেল। এই অনন্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করছি নিজের ক্ষুদ্রতাকে, নিজের তুচ্ছ চাওয়াকে, দুঃখ-কষ্টকে। এখানে যে অপার আনন্দ, অপার বিস্ময়। আমার সমস্ত কিছুকে ধারণের ক্ষমতা যে ওর আছে। আর তাই সব গ্লানি, ক্লেদ, দুঃখকে ভাসিয়ে দিয়ে ওর কাছ থেকে সঞ্চয় করে চলেছি অনন্ত আনন্দ। এ অপার আনন্দলোকের রহস্য জেনেছে কে কবে? মহাকাল চলছে তার নিজস্ব গতিতে এ সঙ্গে নিয়ে তার মহাসৃষ্টি। তারা ভরা আকাশ, আকাশ ছুঁয়ে থাকা বিশাল পর্বত, এমন রাতে মন তো মিলে যায়, এক হয়ে যায় সেই মহাপ্রকৃতির সঙ্গে। আর মানুষ যখন সেই মহাপ্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে পারে, তখনই তো সে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। আজ এই রাতে আমিই তো কাঞ্চনজঙ্ঘা, আমিই তো সমস্ত পর্বত, তারা, নক্ষত্ররাজি, আমিই তো সমগ্র সৃষ্টি। আমিই তো প্রেম, মহা যজ্ঞভূমি। আমার হৃদয় সেই মহাস্রষ্টার নামে নামময় হয়ে উঠেছে। আত্মার পরিপূর্ণতা বুঝি একেই বলে। এই মহাবিশ্বে, মহাপ্রকৃতিতেই তো তার সাথে আমার যোগ। রাতের বেলায় তাপমাত্রা প্রায় নেমে এসেছে জিরো ডিগ্রির কাছাকাছি। ঠান্ডায় একেবারে জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। সারা রাত আমাদের কারোরই ঘুম হলো না। যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। সারা রাত ঘড়ি দেখছিলাম, কখন রাতটা শেষ হবে।
খুব ভোরে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। সূর্যোদয় দেখতে হবে। সান্দাকফুর সূর্যোদয় সে এক মনোরম দৃশ্য। কটেজের বাইরে বেরিয়ে এলাম। ধীরে ধীরে অন্ধকার সরে যাচ্ছে। আর একপাশে বিপুল গৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আলো যত স্পষ্ট হচ্ছে, তত রূপ বদলাচ্ছে যে। তুষার শুভ্র শুদ্ধতা নিয়ে নৈঃশব্দ্যে দাঁড়িয়ে ওর প্রাণ, যেন কোনো ধ্যানমগ্ন মুনী। সূর্য ওঠার পূর্বাভাস পাওয়া গেল। আকাশ রঙিন হয়ে উঠছে। পূর্বের রক্তিম আভা উত্তরের পর্বতের চূড়াকে ছেয়ে ফেলেছে। চারদিকে সোনালি আভার বিচরণ। পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘা কাঞ্চন বর্ণ ধারণ করেছে। একদিকে সূর্য উঠছে। অন্যদিকে রূপ বদলাচ্ছে তার। কোন দিকে তাকাব, দিশেহারা অবস্থা। বুঝলাম, কাঞ্চনজঙ্ঘা নামের তাৎপর্য। যেন সূর্যের সন্তান সে। সূর্য যেন ওর ওপরই আলো ফেলছে, তার সেই সোনালি আলো ওর তুষার শুভ্র বুকে প্রতিফলিত হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। স্রষ্টার আলোকে সৃষ্টির মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। ওগো আলো, তুমি আমায় সমস্ত মলিনতা মুছে আমাকে নির্মল কর, মঙ্গল করো। তোমার পুণ্য কিরণে আমার সমস্ত মোহ-কালিমা মুচে যাক। আমাকে পূর্ণ করো।
সকালের নাশতা সেরে আমরা রওনা হলাম আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য ফালুটের উদ্দেশে। আমরা যাচ্ছি পাথুরে পাহাড়ি সরু রাস্তা ধরে। পৃথিবীর পথ হেঁটে হেঁটে কত দিন-রাত্রি যেন আমাদের গিয়েছে কেটে। তবু তো হয়নি মলিন এই চোখ। মানুষের ভিড়, হাহাকার ফিরিয়ে দিয়েছি সব এইখানে। কেবল বিস্তীর্ণ প্রান্তরে জেগে রয় উৎসাহী আলোর প্রাণ। মেঘমুক্ত স্বচ্ছ নীলাকাশ। এত আশ্চর্য! যেন নীলের ভেতর আরও গভীর নীল। মৃত গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে কতিপয় প্রাণ। কখনো সবুজ, কখনো খয়েরি ঝোপ। আমাদের গাড়ি চলছে ধীরে ধীরে সাবধানে। ভয়ংকর বিপজ্জনক এই পথ। একটি পাথর উল্টে পড়লেই সোজা মৃত্যুর দুয়ারে। অন্যদিকে চোখে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির ভয়ংকর সৌন্দর্য। মাঝে মাঝে গাড়ি থেকে নামছি। ছবি তুলে রাখছি এই অপরূপ রূপের। কিন্তু কোনো ক্যামেরায়, শিল্পীর তুলিতে অথবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কবির বর্ণনাতেও এই সৌন্দর্য তুলে আনা সম্ভব নয়। একে শুধু দুচোখ ভরে দেখতে হয়, আর হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়।
একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম ফালুটে। গাড়ি থেকে নেমে প্রায় চল্লিশ মিনিটের ট্র্যাকিং। পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের চূড়ায়। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এভারেস্ট আরও স্পষ্ট, আরও কাছে। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। কী মনোরম দৃশ্য। যেন লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু, তবু হিয়ে জুড়ন না গেল। কেবল বলা যায় ‘দাঁড়াও মন অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড মাঝে, আনন্দ সভাভবনে আজ।’ সারা সৃষ্টির মাঝে যেন সেই অনন্ত আনন্দের লহরী বয়ে চলেছে। যত দেখছি, দেখার স্পৃহা বেড়ে যাচ্ছে। ফালুটের আবহাওয়া আজ খুব চমৎকার। তীব্র শীতের কাঁপুনি নেই, হিম বাতাস নেই। তাই যেন ফিরবার তাড়াও নেই। মনে হয় যেন এই বিশাল পর্বতমালাকে ছুঁয়ে দেখি, ওর গন্ধ নিই। ওদেরকে জয়ের জন্য, ওদের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেবার জন্য মানুষের কত সংগ্রাম! তবে আমার কাছে মনে হয়, পর্বত জয় যেমন গুরুত্বপূর্ণ, পর্বতের মতো হয়ে ওঠাটাও তেমনই গুরুত্বপূর্ণ। বরং সেটাই যেন সত্যিকারের জয়। এভারেস্টকে বললাম, তোমাকে হয়তো কখনো ছোঁব অথবা নয়। তবে তোমার মতো হয়ে সারা জীবন তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব। তোমার দৃঢ়তা, সাহস, বিশালতা আর শক্তি আমার মধ্যে সঞ্চারিত করো। দেখো, একদিন এভাবেই তোমাকে পেয়ে যাব আমি।
এই শুদ্ধতম সৌন্দর্যের কাছে এলে সময় যে কত দ্রুত বয়ে যায়। ডাক এলো, এবার ফিরতে হবে। ফালুটের প্রান্তে বসে পাহাড় দেখছি আর শুনছি গান। একটু পর কয়েকজন নেপালি কিশোরী এলো সেখানে। ওরাও দুটো গান শোনাল।
তারপর সেখানের একমাত্র কটেজে ম্যাগি খেয়ে আমরা ফেরত যাত্রা শুরু করলাম। সেই একই পথ। তবে বিকেলের আভায় পাহাড় আরও মনোময় রূপ ধারণ করেছে। সান্দাকফু হয়ে আমরা যাচ্ছি কালপোখারীর দিকে। কানে বাজছে নেপালি সানতারার সুর। পথিমধ্যে চাহরী চক নামে একটি নেপালি গ্রামে আমরা থামলাম। সূর্য মিলিয়ে গেছে চক্রবাকে একটা অনুচ্চ শৈলবালার মতো। পশ্চিমাকাশে রেখে গেছে তার অস্তরাগ। পাহাড়ের নিচে সমস্ত মেঘ এসে দাঁড়িয়েছে। গায়ে মেখে নিচ্ছে সেই রক্তিম রাগের সুর। সাদা মেঘগুলো হয়ে উঠেছে হলুদ, সোনালি, কমলা আর লাল রঙের ভেলা। এই ভেলায় ভেসে পৌঁছে যাওয়া যায় সুন্দরলোকে। আর এখানে আমাদের কটেজ যেন মেঘের টুকরো দিয়ে সাজানো ঘর। রাতের বেলায় গান, নাচে জমে উঠল আমাদের আড্ডা। এরপর গরম ভাত, সঙ্গে ডাল, ডিম আর সবজি। আহ, যেন কত দিন সবাই ভাত খায়নি। তারপর ক্লান্ত দেহে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ভোরবেলায় উঠে দেখলাম, আমাদের কটেজের সামনে শুভ্র তুষার পড়ে আছে। এই সময়টা আসলে বরফ পড়ার কথা নয়। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বরফ পড়ে। কিন্তু আমরা সৌভাগ্যবান। কিছুটা দেখা পেয়েই গেলাম। সকালের নাশতা সেরে আবার রওনা হলাম। যেতে যেতে দেখলাম কালপোখারী হ্রদ। হ্রদ না বলে একে পুকুর বলাই ভালো। পাহাড়ের এত উচ্চতায় এই জলাশয়ের অবস্থান এক অনন্য ঘটনা। এর জল কখনো শুকায় না। বরফও হয় না। স্থানীয়রা একে রীতিমতো পূজা করে। সাজিয়ে রেখেছে রংবেরঙের কাপড় দিয়ে, মন্ত্রময় উচ্চারণে। আরও এগিয়ে চললাম আমরা। সিংগালিলার অরণ্যের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, কেমন একটা গা ছমছমে ভাব। বন্য চিতা আর ভালুকের অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছি। অথচ আমাদের জিপের শব্দে ওরাই লুকিয়ে আছে। বুঝলাম, এর পরের বার জিপ সাফারি নয়, ট্র্যাক করেই আসতে হবে। নইলে ওদের অভিমান ভাঙাবে কে! আর কাঞ্চনজঙ্ঘা! পাহাড়ের ফাঁক গলিয়ে মাথা উঁচিয়ে জানান দিচ্ছে ওর অস্তিত্ব। কিন্তু যেন ক্রমশ দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। মনটা কেমন করে উঠল। বিদায়ের সুর বাজছে বিষাদের সরোবরে। পাইন আর নানা বর্ণের চেরির রং এক আশ্চর্য মূর্ছনায় মেঘ হয়ে মিশে যাচ্ছে। মন খারাপের ধীরলয়ের সুর, অথচ কী দ্রুততায় আমরা পৌঁছে গেলাম গাইরিবাসে।
সান্দাকফু, ফালুট গেলাম, কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেলাম, অথচ কিছুটা ট্রেক করব না, তা তো হতে পারে না। শুধু এটি হলেই তো আনন্দ পূর্ণতা পায়। ঠিক হলো, সবাই জিপে যাবে। আর আমরা কয়েকজন গাইরিবাস থেকে টুম্বলিং পর্যন্ত ট্র্যাক করে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
শুরুটা একটু কষ্টকর। পাহাড়ি পাথুরে পথ খাড়া ওপরের দিকে উঠে গেছে। হাইকিং করছি আর হাঁপিয়ে উঠছি। একটু পরপরই থেমে দম নিতে হচ্ছে। শীতে আর উচ্চতায় দম যেন আটকে যাচ্ছে। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা ট্র্যাকিং করার পর শরীর পাহাড়ি ভাষার সঙ্গে মানিয়ে গেল। সামনে যত এগিয়ে চলছি, মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে এই গাইরিবালার রূপ দেখছি। এখন বুঝলাম, কেন অভিযাত্রীরা এই পথ ট্র্যাকিং করে আসে। আসলে ট্র্যাকিং না করলে এই সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করা একেবারেই অসম্ভব। পথে পথে ফুটে আছে, দুধাল ঘাসের ফুল, ভীষণ সুন্দর, দেখতে নক্ষত্রের মতো আকৃতি, হলুদ রং, লম্বা, লম্বা সরু লতার মতো ঘাসের ডাঁটাটি মাটি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর কণ্টকময় গাছে বেগুনি রঙের ঝাড় ঝাড় ফুল ফুটে আছে, বিলেতি কর্ণ ফ্লাওয়ারের মতো দেখতে। সাদা বুনো তেউরি ফুলেরা মুকুট পড়ে দুলছে। এখানে প্রতিটি বৃক্ষলতার হৃৎস্পন্দন যেন নিজে বুজের রক্তের শান্ত স্পন্দনের মতো অনুভব করা যায়। আর বনপুষ্পের সুবাস, পাহাড়ি মাটির সোঁদা গন্ধ, শুকনো ঘাসের গন্ধ, শুকনো ঘাসের গন্ধ কি নিবিড়, মন মাতানো। বিস্তীর্ণ পাহাড়ে ঘন মেঘের ছায়া, কী নির্জন প্রার্থনা সংগীতের মতো ছেয়ে আছে। সৌন্দর্যের সব কথা তো আমি বলতে শিখিনি, অথচ কী সীমাহীন নিমজ্জন তার, মুগ্ধ বনানী কল্যাণী! এখানে সব সত্য, অথচ সব স্বপ্নময়। মোহিনী প্রকৃতিরাণী অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে নিবিড়তায় আচ্ছন্ন করে রাখছে। মেঘের পথে হাঁটছি পাহাড়ি সরু উঁচু পথ বেয়ে, যার শেষ সীমানা যেন মিশেছে স্বর্গে। এই তো স্বর্গসুখ! একপাশে নেপাল, এক পাশে ভারত, মাঝে আমরা হেঁটে চলেছি। এক প্রান্তে এসে থমকে দাঁড়ালাম। হঠাৎ করেই যেন পথটা শেষ হয়ে গেল। পথটা হঠাৎ খাড়া নিচে নেমে গেল। যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছালাম আমরা। এরপরে আর যেন কিছু নেই। মেঘে ছেয়ে আছে সমস্তটা। এ এক আশ্চর্য রূপ প্রকৃতির, এ এক অপূর্ব উপলব্ধি। ঈশ্বরের আরাধনার মতো এ প্রকৃতিকে চাইতে হয়। নিজেকে সমর্পণ করতে হয় এই সৌন্দর্যের কাছে। তবেই সে নিজেকে এভাবে উন্মুক্ত করে। এই রূপ খুঁজতে তাই সাধনা প্রয়োজন, আর প্রয়োজন পূজারির একনিষ্ঠতা। আর সাধককে প্রকৃতি যেন এভাবেই দুই হাতে ভরিয়ে দেয়। আর এই সৌন্দর্যের কাছে যেন অজস্র জন্ম কাটিয়ে দেওয়া যায়। মন চাইছিল না, ওকে ছেড়ে যাই। কিন্তু গন্তব্যের তাড়া! তাই ইচ্ছে না করলেও আবার যাত্রা শুরু হলো। প্রতিটি পদক্ষেপেই যেন আটকে যাচ্ছি। এত সুন্দর! এর রূপ! এত শোভা! এত মাধুর্য! সার্থক আমার এই মানবজন্ম! সার্থক আমার এই ভ্রমণ! জীবনের গভীর গভীরতম সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য, জীবনে বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহের জন্য এর বেশি কিছু প্রয়োজন নেই।
উঁচুতে আরও উঁচুতে আশ্চর্য মেঘেদের রাজ্যে উঠতে উঠতে আমরা পৌঁছে গেলাম ঝাওবাড়ি নামে একটা নেপালি গ্রামে। এত পরিচ্ছন্ন আর মেঘময়! সত্যিই চমৎকার। আর গ্রামবাসীর আতিথেয়তায় মনোমুগ্ধকর। এখানে চা খেয়ে আমরা আবার দেখা মিলল ন্যাশনাল পার্কের সীমানায়। আর অনেকক্ষণ পর উঁকি দিল কাঞ্চনজঙ্ঘা, জ্বলজ্বলে অস্তিত্বের পতাকা উড়িয়ে, পাহাড়ি পাথুরে পথের পরিবর্তে এখানে পিচঢালা পথ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম টুম্বলিং। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার ট্র্যাকিং শেষে ঘড়িতে তখন তিনটা। বাইরে আমাদের আওয়াজ শুনে জিপ নিয়ে আসা আমাদের অন্য সঙ্গীরা বের হয়ে এলেন, উষ্ণ অভ্যর্থনায় আমাদের স্বাগত জানানো হলো। কয়েকজন আমাদের জন্য না খেয়ে আছেন। সবাই দ্রুত খেয়ে নিয়ে পাহাড়ের প্রান্তে বসে তাকিয়ে আছি কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে। এই তো শেষবার। কাল থেকে তো এত কাছ থেকে ওকে আর দেখব না। এরপর আমরা আবার টুংলু গ্রামের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। সন্ধ্যাটা সেখানে কাটিয়ে দ্রুত ফিরে এলাম কটেজে। বাইরের তীব্র শীতে আমরা তখন জমে যাচ্ছি। কটেজে ফায়ার প্লেসের পাশে বসে আড্ডায় মেতে উঠলাম আমরা সবাই। রাতের খাবার খেয়ে নিলাম মাঝে। এখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা, একরুমে সবার। সারি সারি বিছানা পাতা আছে। সবাই আড্ডা দিতে দিতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম, টের পেলাম না।
খুব সকালে উঠে আবারও ফিরতি যাত্রার পথ ধরলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বিদায় জানিয়ে জিপে চেপে বসলাম। আবারও সেই সৌন্দর্যের স্বপ্নময় পথ ভেঙে ভেঙে বিষণ্ণ বিদায়কে সঙ্গী করে আমরা চলে এলাম মানেভঞ্জন। আবার সেখানে আমাদের এই কদিনের সঙ্গী গাড়ি দুটোকে বিদায় দিয়ে টাটা সুমের জিপে রওনা হলাম শিলিগুড়ির দিকে। সেই পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচে নামছি, পথে পড়ল শিরিক লেক, কালিম্পং।
পাহাড়কে বিদায় দিয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছালাম সমতলে, শিলিগুড়িতে। কিন্তু পাহাড় যাকে একবার আচ্ছন্ন করে ফেলে, মায়াজালে যাকে আটকে ফেলে, তার পক্ষে কি এই প্রেম বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব? গিয়েছিলাম সাধারণ, কিন্তু এক পাহাড়ি মন নিয়ে ফিরে আসলাম।
শিলিগুড়িতে হোটেলে উঠে আমরা ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরপর ঢাকা হোটেলে দিদির হাতের সেই অমৃত খাবার। এরপর আমি আর একজন গেলাম উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টি চমৎকার, ছিমছাম। সেখানে বাংলা বিভাগটাও দেখে এলাম। অধ্যাপক উৎপল মন্ডল স্যারও বিভাগের অন্য শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পণ্ডিত অশ্রুকুমার সিকদারের ঠিকানা পেলাম। দেশবন্ধু পাড়ায় স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। স্যার আর তাঁর সহধর্মিণী দুজনই খুব খুশি হলেন আমাদের পেয়ে। দুজনেরই পৈতৃক নিবাস ছিল বাংলাদেশে। দেশের কথা, সাহিত্যের কথা আর নানা কতকথায় চমৎকার এক সন্ধ্যা কেটে গেল।
পরদিন সকালে আমরা গেলাম সেভক সেতুতে। নিচে তিস্তা, যার জল এত আশ্চর্য স্বচ্ছ, সবুজ টলোমলো অশ্রুবিন্দু। সেই সবুজ নদীর জলে পা ডুবিয়ে রেখে এলাম সভ্যতার আদি সংগীত। পাথুরে স্রোত, নির্ভেজাল অথচ কঠিন। আমাদের ফিরতে হলো। দেশ ডাকছে, মা ডাকছে। শিলিগুড়ি থেকে দুপুরে রওনা হলাম প্রিয় বঙ্গভূমির উদ্দেশে। আহ! কত দিন বাংলাদেশের আকাশ দেখি না, প্রিয় দেশের বাতাসে বুক ভরে নিশ্বাস নিই না। ফিরছি নিজ নীড়ে, সঙ্গে নিয়ে হিমালয়ের সুখময় স্মৃতি। ভালো থেকো প্রিয়তম কাঞ্চনজঙ্ঘা। আবার দেখব তোমায়, বারবার দেখব তোমায়।