একবার কোনোভাবে ফেসবুক সেলিব্রিটি হয়ে যেতে পারলে বড় কবি হওয়া ঠেকায় কে! ভক্ত-আশেকানের অভাব হবে না, তারা কবির গুণগান গাইবে। ইতিমধ্যেই বুঝে গেছি, ভালো কবিতা লিখতে না পারা অপরাধ নয়, কিন্তু লিংক না থাকা বোকামি। সঙ্গে যদি থাকে কূটকৌশলে গিজগিজ করা মগজসমৃদ্ধ একটি মাথা, তাহলে খুবই ভালো।
কবিতার বড় বাজার এখন ফেসবুকে। নিজের ওয়ালে পোস্ট করা যায়, আবার বিভিন্ন গ্রুপেও একই কবিতার মাধ্যমে অস্তিত্ব জানান দেওয়া যায়। সতীর্থ কবিদের পরামর্শে ধার-কর্জ করে কিনে ফেলেছি ভালো মানের একটি স্মার্টফোন। অল্প কিছু টাকার ডেটা কিনে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। মোবাইল অপারেটররা যদিও কবিদের জন্য জন্য বিশেষ কোনো প্যাকেজ ঘোষণা করেনি; তবু যে সার্ভিস চলমান আছে, সন্তোষজনকই বলতে হবে। জুকার মামার কোম্পানিতে অ্যাকাউন্ট খোলার এক মাসের মাথায় পেয়ে গেলাম সুফল। ফেসবুক গ্রুপ কবিতার ফুল (কফু) থেকে মর্সসেরা কবি নির্বাচিত হলাম কয়েক লাখ প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে। ‘মর্সসেরা’ শব্দটা অনেকের কাছেই অপরিচিত লাগতে পারে। বর্ষসেরা থেকেই মর্সসেরার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন গ্রুপের অ্যাডমিন প্যানেল। এ শব্দে অন্য রকম একটা জোশ আছে, যেটা ‘মাসসেরা’য় মেলে না। কোনোরকম লেনদেন ছাড়াই সেরা কবির সম্মান আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তারা কুরিয়ার করে মুদ্রিত সনদের কপিও পাঠিয়ে দিয়েছে। লেমিনেটিং করিয়ে নিয়েছি। সনদটা নিয়ে নানা জায়গায় কবিতা পড়তে যাই। কেউ কেউ আলাদাভাবে সম্মান করে, সমীহের দৃষ্টিতে তাকায়। এসব কবিতা পড়া ও শোনার অনুষ্ঠানে নিয়মিত যাতায়াতের সুবাদে সার্কেল বড় হয়েছে। অনেক নারী-পুরুষ কবির ফোন নম্বর নিয়ে সমৃদ্ধ করেছি স্মার্টফোনকে।
বন্যাজলের মতো কবিতা পাঠাতে শুরু করার পর ছাপাও হতে শুরু করেছে এখানে-ওখানে। কিঞ্চিত সমস্যা হয় প্রিন্ট পত্রিকায়। একই কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠানো যায়। কেউ পড়ে না বলে সমস্যা হয় না। তবে গত মাসে একজন প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছিল পত্রিকায়, অমুক কবিতা তো অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছিল। আবার এখানে কেন! রাগের বদলে খুশিই হই এতে। ভেবেছিলাম, সবাই যার যার কবিতা নিজেই দেখি; এখন দেখছি অনুমান মিথ্যা। অদৃশ্য পাঠক অবশ্যই আছে। যে কারণে চুরি ধরিয়ে দেওয়ায় বেজারের বদলে আনন্দিত হয়েছি।
সাহিত্য সম্পাদকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। যেখানে অভিযুক্ত সেখান থেকেই তবে শুরু হোক! বৃষ্টি আক্রান্ত এক প্রসন্ন সকালে সম্পাদককে কল করলাম। বৃষ্টিস্নাত কদমফুলের শুভেচ্ছা দিয়ে পরিচয় পর্ব শেষ হল। বললাম, ‘আপনার অনেক কবিতাই আমার মুখস্থ। ভালো লাগে আপনার কবিতা।’
তিনি উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘তাই নাকি! কোনটা কোনটা মুখস্থ আছে?’
‘সীমা-পরিসীমা নেই। তবে প্রতিমার বুকে বেদনার জল কবিতাটা শোনাচ্ছি এখন।’
বইটা খোলা ছিল আগেই। সেখান থেকে দেখে দেখে পড়েছি। টনক নড়ল ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসায়। কী কাণ্ড, এত বড় কবি, ডাকসাইটে সম্পাদক আবার কাঁদেন কেন! জড়ানো কণ্ঠে আকমল আনোয়ার বলেন, ‘এত সম্মান আমি জীবনে আর পাইনি। আমার কবিতা কাউকে এমন গভীরভাবে ছুঁয়েছে, নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না।’
নিজের পাল্লা ভারী করতে বললাম, ‘খোঁজ নিয়ে দেখুন, আটলান্টিকের ওপারেও আপনার পাঠক আছে। সবাইকে তো চিনবেন না। অন্যদিকে সবাই কিন্তু সৃষ্টিশীল বিদ্বানকে ঠিকই প্রাতঃস্মরণীয় করে রাখে। পুজো দেয় মনোমন্দিরে রেখে।’
আকমল আনোয়ারের কণ্ঠ এবার মেঘমুক্ত আকাশের মতো ঝরঝরে। বললেন, ‘তুমি অফিসে এসো। শুক্রবার ছাড়া যেকোনো দিন সকালের দিকে।’
বুঝে গেলাম, কেল্লা ফতে। পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা বিশ টাকার বইটা ভালোই কাজ দিয়েছে। এবার সময় করে যেকোনো দিন কবিতা নিয়ে দেখা করব। তার আগে সম্পাদক মহোদয়ের স্ট্যাটাসগুলোতে ইতিবাচক কিছু মন্তব্য করে রাখতে হবে। যাতে আরও সহজে শনাক্ত করতে পারেন। মন দ্রবীভূত থাকে।
অফিসে যাওয়ার আগেই দেখা হয়ে গেল আকমল আনোয়ারের সঙ্গে। আলাপের দুদিন পরে বড়কুঠিতে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কুতুবুদ্দিনের জন্ম-ষাট উৎসব। জন্মদিনে তাকে নিবেদন করে কবিতা, গান ও কথার অনুষ্ঠান। আকমল আনোয়ারের সামনে গিয়ে পরিচয় দিতেই চিনলেন। বললেন, ‘যাক। তোমার দেখা পেয়ে ভালোই হলো। এখানে আমাকে কবিতা পড়তে হবে। অথচ পাণ্ডুলিপি সঙ্গে আনিনি। তোমার মুখস্থ আমার যেকোনো একটা কবিতা লিখে দাও। সেটাই পড়ব।’
সম্মতি জানিয়ে সরে এলাম দূরে। একেই বলে মাইনকা চিপা। হ্যাঁ বললে দোষ, না বললেও দোষ। ভাবতে ভাবতে মাথাটা খুলে গেল। ভাবলাম, কাছেই তো বইয়ের মার্কেট। দ্রুত একটা বই কিনে আনলেই হয়। একশ বিশ টাকা শ্রাদ্ধ করে নিয়ে এলাম আকমল আনোয়ারের একটি কাব্যগ্রন্থ। সরাসরি তার হাতে দিয়ে বললাম, ‘আমার কাছে আপনার বই-ই ছিল। সব সময় থাকে। সময় পেলেই পড়ি। বইটা আপনিই রাখুন। হাতে লিখলে বানান ভুল হতে পারে।’
তারপরের অভিশপ্ত আধা ঘণ্টার কথা না বললেই ভালো হতো। কিন্তু অপমান যার কপালে থাকে, কে তাকে দেবে সুরক্ষা! আকমল আনোয়ার মঞ্চে উঠলেন স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে। প্যাকেট খুলে দেখলেন এটা অন্য কবির বই। বিরক্তি নিয়ে ‘ধুর’ বলে বইটা ছুড়ে ফেললেন অদূরে। মাইককে সাক্ষী রেখে বললেন, ‘দুঃখিত। ভুল বই নিয়ে এখানে হাজির হয়েছি। আপনাদের দরবারে আমার কবিতা আবৃত্তি করে শোনাবেন তরুণ কবি মিজানুল হক।’
কী মুসিবত! দোকানদার যে ভুল করে অন্য কবির বই দিয়েছে তাড়াহুড়োয় খেয়াল করিনি। সমস্যা হচ্ছে, সেই কবি, রিপন অভাগীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত। তার বই ছুড়ে ফেলা প্রত্যক্ষ করেছেন আগুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। নামের সঙ্গে মিল ভালোই। বেচারা আসলেই অভাগা। নইলে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে হয় একজন কবিকে! এদিকে আবার মঞ্চে উঠে কবিতা আবৃত্তি করতে হবে। আকমল আনোয়ার এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কবি নন, তার কবিতা আমার মুখস্থ থাকবে। সমাজ বাঁচাতে দুরুদুরু বক্ষে এগিয়ে গেলাম মাইক্রোফোনের সামনে। কেশে বললাম, ‘আকমল আনোয়ারের প্রায় সব কবিতাই আমার মুখস্থ ছিল। কিন্তু আজ এখানে এত সব গুণীর দেখা পেয়ে আমার সব এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার বাবার নাম যে সোলেমান হক, সেটাও ভুলে বসে আছি। যাহোক, আপনাদের কাব্যসুধা থেকে বঞ্চিত করব না। আমার রচিত তিনটি কালজয়ী কবিতা শোনাচ্ছি।’
প্রথম কবিতাটি পরিবেশন করার পরই কবি রিপন অভাগীর সঙ্গে আকমল আনোয়ারের হাতাহাতির দৃশ্য দেখা গেল। সঙ্গে তুই-তোকারির হট্টগোল। তারা যে একটি ভদ্র পরিবেশে আছেন, দুজনের কারোরই বোধ হয় মনে নেই! দ্বিতীয় কবিতা অর্ধেক পড়ার পর লক্ষ করলাম, দর্শক মনোযোগ অমৃতের দিকে নেই। গরলেই মজা পেতে চাইছে সবাই। দ্রুত সটকে পড়লাম। আমার জন্যই যে এত হাউকাউ, জানাজানি হলে সমস্যা আছে!
পালিয়েও রক্ষা পেলাম কই! আত্মগোপন করে থাকা চায়ের আড্ডায় তিন ঘণ্টা পর উপস্থিত হলেন রিপন অভাগী। গজরাতে গজরাতে স্বগতোক্তি করলেন, ‘শালারা সংস্কৃতি মারায়, অন্যকে সম্মান করতে শেখেনি।’
সুযোগ বুঝে তার জন্য চায়ের অর্ডার দিই। বলি, ‘আকমল আনোয়ারের আবার কবিতা হয় নাকি? এ জন্যই তো আমি পড়িনি!’
সমর্থন পেয়ে রিপন চেতে যান আরও। বলেন, ‘কিন্তু উজবুকটা কি এটা বোঝে! বছরের পর বছর কী সব লিখছে পত্রিকার নামে। সবই সিন্ডিকেটের খেইল। ও আজ আমার মতো রাস্তায় নামুক, তারপর দেখো কে ছাপে কবিতা!’
‘এসব বিষয় বোঝানোর জন্যই তাকে আপনার বইটা এনে দিলাম। যে বইয়ে সত্যিকারের কবিতা আছে। কিন্তু সেখান থেকে না পড়ে বই যে ছুড়ে মারবেন বুঝতে পারলে কি আর...।’
রিপন অভাগীকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলি, ‘আপনার কবিতা অনেক ভালো। আমি গত সপ্তাহেও সাপ্তাহিক গঙ্গাবতীতে পড়েছি।’
এমন জলজ্যান্ত সাক্ষ্যে খুশি হন তিনি। বলেন, ‘তুমি আসলেই কবিতাবোদ্ধা।’
‘আকমল আনোয়ারের সব কবিতা মিলিয়ে আপনার একটি পঙ্ক্তির সমানও হবে না।’
আরও খুশি হন অভাগী কবি। বলেন, ‘তোমার একগুচ্ছ কবিতা আর একটা রঙিন ছবি দিও। আমি দৈনিক আড়িয়াল খাঁ-র সাহিত্য সম্পাদককে দেব। সে আমার গ্রামের ছোট ভাই। আমাকে খুব মান্য করে।’
বললাম, ‘জি। অবশ্যই দেব।’
‘আমি এখনই সম্পাদকের মেঞ্জেজারে বলে দিচ্ছি, তোমার দিকে একটু খেয়াল রাখতে।’
পরক্ষণেই চেঁচিয়ে ওঠেন রিপন অভাগী, ‘দেখলে, ওরা কী করল!’
ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে কবিতা নিউজ টোয়েন্টি ফাইভ ডটকমের একটি লিংক। আজকের ঘটনা নিয়ে তারা সংবাদ শিরোনাম করেছে, ‘শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে দুই জ্যেষ্ঠ কবির হাতাহাতি!’
পরদিন সকালে ঢুঁ মারলাম আলুনগর বাজারে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আটটা থেকে নয়টার দিকে এ বাজারে আসেন আকমল আনোয়ার। তিনি কুমড়োফুল ও কলমি শাক পছন্দ করেন। প্রতিদিনই কেনা চাই। জীবনানন্দ দাশ কবিতায় কলমি শব্দটা ব্যবহার করেছেন। ধারণা পোষণ করে, কলমি শাক খেলে তিনিও জীবনানন্দের মতো মহৎ কবি হতে পারবেন। আমি বোধ হয় একটু দেরিই করে ফেললাম। বাজারের ব্যাগ নিয়ে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন কুঁচো মাছের ভাগা কিনতে। এগিয়ে হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করি ব্যাগ। বলি, ‘আমাকে দিন। অনেক ওজন!’
‘তুমি এখানে কী করছ?’
‘মেসের বাজার করতে এসেছি। সেটা পরে করব। আগে আপনারটা সারুক। এভাবে আপনার সঙ্গে হয়তো আরও দেখা হবে। একত্রে বাজার সারতে পারব।’
ব্যাগটা আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘তোমার কাছ থেকে সঠিক আচরণ প্রত্যাশিত ছিল। গতকাল কী অপমানের মুখেই না ফেললে!’
‘ওটা আসলে অ্যাক্সিডেন্ট। প্যাকেট বদল হয়েছে। এই দেখুন, আপনার কবিতার বই আমার কাছে এখনো আছে। ভোরে পড়েছি। দুপুরে-সন্ধ্যায়ও পড়ব।’
চটি ব্যাগ থেকে বই করলে আনন্দে তাজা সরপুঁটির মাছের মতো চকচক করে ওঠে আকমল আনোয়ারের মুখ। আবৃত্তি শুরু করলেও শেষ করতে পারি না। মাছ দোকানির ‘মাছ না খাইয়া কবিতা খান/ ভিড় কমান বাসায় যান’ উসকানিমূলক বক্তব্যে আমরা দ্রুত সটকে পড়ি। যেতে যেতে গতকাল রাতে মুখস্থ করা কবিতা শোনাই। বাসার সামনে ব্যাগ বুঝিয়ে দিতে চাইলে সম্পাদক মহোদয় হেসে বলেন, ‘আরে, চা খেয়ে যাও।’
চা-বিস্কুট গলাধঃকরণের ভেতরেই একটা কবিতা লিখে ফেলি। তুলে দিই তার হাতে। সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয়তাও পাই, এ সপ্তাহে ছাপা হবে।
মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম। এখন হচ্ছে যোগাযোগ আর ফিটিংবাজির যুগ। যে যত বেশি এসব করতে পারে, সে তত বড় কবি। শুধু ভালো লিখলেই হয় না, সম্পর্ক রচনা করতেও জানতে হয়। আমার প্রসন্ন মনোভাব বেশিক্ষণ বহাল রইল না। রাস্তায় বের হতেই দেখা মর্জিনা মাইক সার্ভিসের মালিক মর্জিনার বাপের সঙ্গে। পড়বি তো পড় পাওনাদারের ঘাড়ে। পালানোর পথও নেই। আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক আমবাগান পত্রিকায়। আনন্দের আতিশয্যে সিদ্ধান্ত নিলাম, খবরটা মহল্লাবাসীকে জানাতে হবে। একটা মাইক ভাড়া নিয়ে রিকশায় চড়ে নিজেই শুরু করলাম মাইকিং, ‘প্রিয় মহল্লাবাসী, সুখবর...সুখবর! আজ আমার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আমবাগানে। আপনারাও এ গৌরবের অংশীদার। দলে দলে পত্রিকাটি সংগ্রহ করুন। মিজানুল হক নাম দেখে খরিদ করিবেন। হকাররা অনেক সময় সাহিত্য সাময়িকী দেয় না। আলাদাভাবে জমিয়ে রেখে সের দরে বেচে দেয়! প্রিয় কাব্যামোদী জনতা...।’
তখন টাকা পরে দেব বলায় মর্জিনার বাপ মেনে নিয়েছিল। এরপর তাকে ধরাই দিইনি। আজ বাধ্য হয়ে আগ বাড়িয়ে বললাম, ‘ভাইজান, আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম!’
তিনি ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘যান। দোকানে বহেন গিয়া। আমি তাইতাছি।’
এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। তিনি বোধ হয় আমাকে চিনতে পারেননি। মুহূর্তে পগারপার আমি। এখানে-ওখানে আরও বাকি জমেছে। টাকার হিসাবে কয়েক হাজার তো হবেই। সব ঠিক থাকলে আগামী মাসেই বাসা পাল্টে ফেলব। এমনিতেই কত খরচ। দুই-তিন দিন পরপরই এমবি কিনতে হয়। কম দাম হলেও সেটাই আমার জন্য অনেক টাকা। অন্তত চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত। প্রতিদিনকার বড় কাজ বিভিন্ন দৈনিক, সাহিত্য ম্যাগাজিন, লিটলম্যাগ সম্পাদক ও অনলাইন পোর্টালের সাহিত্য সম্পাদক ও তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের পোস্টে মন্তব্য করা। শুভেচ্ছা, অভিনন্দন, এগিয়ে যান, সকালেই পড়েছি খুব ভালো লেখা...এমন মন্তব্য জায়গা বুঝে পেস্ট করা। একবার দেশের সবচেয়ে বেশি ঠোঙা সাপ্লাইয়ে অবদান রাখে এমন দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকের কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধের লিংকে মন্তব্য করলাম, মুগ্ধতা রেখে গেলাম প্রিয় সাহিত্যজন। অবাক ব্যাপার, তিনি রিপ্লাই দিয়ে ধন্যবাদ জানালেন। খুশিতে সেদিন আমি বুকে-পিঠে এ ফোর সাইজ কাগজে লিখে ‘দৈনিক মোমদানির সাহিত্য সম্পাদক ফেসবুক কমেন্টের রিপ্লাই দেওয়ায় একক আনন্দ মিছিল’ বের করি। রাস্তাঘাটের লোকজন হাসে আর বলে, ‘ভাই, আপনি কি পাগল?’
ঠাঁটবাট বজায় রেখে বলি, ‘না। আমি কবি।’
অবশ্য মোমদানির সাহিত্য সম্পাদককে নিয়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ। তিনি গোত্রের বাইরের কারও লেখা ছাপেন না। কবিতাবাগের বিক্ষুব্ধ তরুণরা প্রায়ই সগোত্রীয়দের সঙ্গে আলোচনায় আনে এ সম্পাদককে। তাকে উদ্দেশ বলে, ‘ভাই, তোরে কিছুই করতে অইব না। কবিতা ছাইপা কী করবি, পরে তো ঠোঙা অইয়া যাইব! তুই শুধু একবার কবিতাবাগে আমগো লগে চা খাইতে আয়!’
সেই ‘কবিতার দুষমন’কে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার এমন মিছিলে সতীর্থ কবিরা ক্ষেপল। বলল, ‘তুই কি কবিতা লেখবার আইছস নাকি দালালি করবার?’
আত্মপক্ষ সমর্থন করে জবাব দিলে তারা পাল্টা পাটকেল ছুড়ল, যাদের আমি কবি বলে সম্বোধন করছি তারা নাকি প্রকৃতপক্ষে কন্ডাক্টর। এদের যোগ্যতা মুদিদোকানে আটা-ময়দা মাপার।
তাদের মন জোগাতে মুখে হ্যাঁ-হুঁ বললেও মনে মনে ঠিকই জানি, কে যে আসলে কী! তবে যে যা-ই হোক, তাতে আমার কী যায়-আসে। নিজের কবিতাটা সময়মতো প্রকাশ করতে পারলেই বাঁচি। সতীর্থদের মতো সততা ও নৈতিকতার বিপ্লব দেখাতে আসে যারা, তারাও তলে তলে ঠিক আমারই মতো!
আগামী বছর কলকাতা, আগরতলা, ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড ভ্রমণের ইচ্ছা আছে। তার আগ পর্যন্ত সুনামটুকু হোক অন্তত। নতুন জায়গায় গিয়ে নিজের কবিপ্রসিদ্ধি যদি দেখে আসতে পারি, এর চেয়ে ভালো সংবাদ আর হবে না। ভ্রমণের খবরটা ছড়িয়ে দিতে হবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। রাস্তার পাশে মরা ঘাস-বিচালির ওপর বসে লিখতে শুরু করলাম সাহিত্য সংবাদ, ‘অল্প কিছুদিনের মধ্যে ওপার বাংলায় কবিতা পড়তে যাচ্ছেন তরুণ কবি মিজানুল হক। জানা গেছে, একটি সংগঠন সমকালীন বাংলা কবিতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য সংবর্ধনা দেবে তাঁকে...।’