কাজী নজরুল ইসলাম সৃজন সংসারে সক্রিয় ছিলেন মাত্র ২২ বছর। বেঁচে ছিলেন ৭৭ বছর। এর মধ্যে ৩৫ বছরই ছিল বেদনা বিধুর। অসাম্প্রদায়িক এই জীবনে বাঙালির চিন্তাচেতনা, মনন ও অনুভূতির জগতে নানাভাবে নাড়া দিয়েছেন। ফ্যাসিবাদ, অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে ধরেছিলেন কলম, গেয়েছিলেন সাম্যের গান। আর কবিরাই পারে শত বেদনায় সব সময় নিজের ছাড়াও সবার কথা সাবলীলভাবে তুলে ধরতে। ‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবো না, সারাদিনমান কোলাহল করি কারো ধ্যান ভাঙিবো না। নিশ্চল-নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িবো একাকী গন্ধবিধুর ধুপ।’
জীবনীকার গোলাম মুরশিদ বলেন, কী করে হঠাৎ একদিন উল্কার মতো বাংলা সাহিত্য এবং সংগীতজগতের মধ্যগগনে আবির্ভূত হয়ে সমস্ত আকাশকে উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন। কী করে তিনি দুখু মিয়া থেকে নজর আলি, নজর আলি থেকে নজরুল এসলাম, নজরুল এসলাম থেকে নজরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম হয়ে উঠলেন, সেই বিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ এবং আগ্রহব্যঞ্জক। অন্যদিকে নজরুল ইসলামকে নিয়ে কতগুলো জীবনী লেখা হয়েছে, তার সংখ্যা আমার জানা নেই। তবে আমার বিশ্বাস, অত জীবনী অন্য কোনো বাঙালিকে নিয়ে লেখা হয়নি, এমনকি রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও নয়। এর একটা কারণ, নজরুল সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব। বিশেষ করে সৈন্যবাহিনী থেকে তিনি কলকাতায় ফিরে আসার আগের সময়টা আমাদের কাছে একান্ত অস্পষ্ট। শোনা কথা, যে যা কল্পনা করতে পেরেছেন, তিনি তাই লিখেছেন। তাঁর সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারতেন, এমন কোনো যোগ্য আত্মীয় তাঁর ছিল না।
এমনি অজানা অধ্যায়, অব্যক্ত বেদনার গল্পের নায়ক নজরুল। তাঁর যখন আগমন, তখন রবীন্দ্রনাথ গৌরবের পূর্ণতায়। অপ্রতিদ্বন্দ্বী তাঁর প্রভাব সর্বত্রগামী এবং প্রায় সব দিকেই। আর নজরুল প্রতিভার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমর্থন ও অকাতর স্নেহ পেয়েছেন। তিনিও গুরুদেব বলে মান্য করতেন, বলতেন তাকে অতিক্রম করা অসম্ভব। তবে চলনে-বলনে-লেখায় নিজেও ছিলেন অত্যন্ত উৎসাহী ও গভীরভাবে রবীন্দ্রভক্ত। অন্যদিকে বাংলা ভাষায় এই দুজন মানুষ, যাঁদের নাম প্রায় একসঙ্গে উচ্চারিত হয় রবীন্দ্র-নজরুল ভাষাকেন্দ্রিক বিরাট জনগোষ্ঠীকে এক বাঁধনে বেঁধেছেন, বিভক্ত দেশের সব সীমারেখা মুছে দিয়ে। বলা চলে, বাঙালির সংস্কৃতিকে অবিচ্ছেদ্য করে তুলেছেন দুটি বটবৃক্ষ!
নজরুলকে একটি সংবর্ধনা দিয়েছিলেন সমগ্র বাঙালির পক্ষে অ্যালবার্ট হলে (১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর, কলকাতার কফি হাউস) সভাপতি ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ভাষণে বলেছিলেন, “নজরুল কবি, প্রতিভাবান মৌলিক কবি।...আজ এই ভেবে বিপুল আনন্দ অনুভব করছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি।” এর প্রত্যুত্তরে নজরুল খুব সুন্দর করে বলেন, “আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই আমি জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।”
সত্যিকারভাবে শিল্প জীবন এমনি হয়। কারও পকেটের না, না কোনো দরবারের। নজরুল জীবনের শেষ ভাষণে (১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে) বলেছিলেন, ‘বন্ধুগণ, আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনু-মন প্রাণ আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে। তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বণিত হয়ে উঠেছে- আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্য্যবাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের, সকল মানুষের...।’
দুরারোগ্য ব্যাধিতে চিরজীবনের জন্য বাক্রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার আগে এই ছিল তার সর্বশেষ বক্তৃতা। তবে নজরুল অল্প সময়েই কালজয়ী কবিতা, অসামান্য গান, সমাজ ও রাজনীতিসচেতন গল্প, স্বাধিকারবোধের নাটক, জীবন খেয়ালি উপন্যাস, সাহিত্যকৃতি জাগরণের প্রবন্ধ— সবর্ত্র বিচরণ করেছেন। ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব, কিন্তু সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করা নজরুলের জীবন ছিল একেবারে ছন্নছাড়া। ফলে টিকে থাকার জন্য জীবনে কত রকম কায়দা করতে হয়েছে, তা আজও অজানা অধ্যায়। এর মাঝে নজরুলের শেষ জীবনের কিছু হৃদয় ছেঁড়া কম জানা তথ্য উপস্থাপনের চেষ্টা।
খ.
কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাহিত্যিক সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ। একসঙ্গে সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও রাজনীতি করেছেন। আবুল মনসুর রচনা করেন জীবন-ক্ষুধা, নজরুল রচনা করেন মৃত্যুক্ষুধা। আবুল মনসুরের বিখ্যাত আয়না গল্পগ্রন্থের ভূমিকাও লিখেছিলেন বন্ধু নজরুল। ১৯৪১ সালে শের-এ-বাংলা দৈনিক নবযুগ পত্রিকা বের করেন। আবুল মনসুর আহমদকে সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ায় কথা বললেও রাজি হননি। তখন কাজী নজরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, কাজ করতেন আবুল মনসুর। বহুলপঠিত ‘আত্মকথা’ বইতে আবুল মনসুর এর নাম দেন ‘বেনামী সম্পাদক’। নবযুগের স্মৃতি থেকে জানা যায় :
কাযী সাহেবের স্ত্রী বহুদিন ধরিয়া দুরারোগ্য পক্ষাঘাত রোগে ভুগিতেছেন। তাঁর রোগী হওয়া মানে কাযী সাহেবেরও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়া। কথাটা মনে হইতেই গা কাঁটা দিয়া উঠিল। এই অশুভ চিন্তার জন্য মনে-মনে তওবা করিলাম। কাযী সাহেব আমার বিচলিত ভাব দেখিয়া সান্ত্বনা দিলেন: ‘চিন্তার কোনো কারণ নাই। ব্যাপারটাকে যত সাংঘাতিক মনে করিতেছেন, তত সাংঘাতিক এটা নয়। আমি আমার স্ত্রীর মতো অসুস্থ হইয়া আবার ভালো হইব এবং তখন স্ত্রীও আমার সাথে-সাথে আরোগ্য লাভ করিবে। আধ্যাত্মিক সাধনার বলে এমন ইচ্ছাধীন রোগাক্রান্তি এবং রোগমুক্তি সম্ভব এটা বৈজ্ঞানিক কথা। এটাকে বলে সাইকো-থিরাপি।’ আমার মনে মানিল না, কারণ আমি ও-সম্বন্ধে কোনো বই-পুস্তক পড়ি নাই। কেমন যেন অশুভ-অশুভ মনে হইতে লাগিল। যিনি শুনিলেন তিনিই এটাকে মস্তিষ্ক বিকারের লক্ষণ বলিলেন।
এরপর কাযী সাহেব অফিসে আসা একদম বন্ধ করিয়া দিলেন। শুধু বেতন নিবার নির্ধারিত তারিখে রশিদ সই করিয়া টাকা নিতে আসিতেন। তাও খবর দিয়া আনিতে হইত। কয়েক মাস পরে তাও বন্ধ করিলেন। লোক পাঠাইয়া বেতনের টাকা নিতে লাগিলেন। নজরুল ইসলাম সাহেবই ছিলেন ‘নবযুগ’ অফিসে ছাত্র-তরুণদের বড়ো আকর্ষণ। তিনি আর অফিসে আসেন না কথাটা জানাজানি হইয়া যাওয়ায় আস্তে-আস্তে তাদেরও যাতায়াত কমিয়া গেল। (আত্মকথা)
অন্যদিকে প্রাবন্ধিক ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় জানান নতুন তথ্য। নজরুলের অসুস্থ হয়ে পড়ার দিন নিয়েও সঠিক তথ্য জানা যায় না। কেউ বলেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিবসে (৭ই আগস্ট ১৯৪১) কলকাতা রেডিওতে ‘রবিহারা’ কবিতাটি ওই দিনই লিখে আবৃত্তি করার সময় কবির কণ্ঠস্বর জড়িয়ে আসে, কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। হতে পারে একটা প্রাথমিক লক্ষণ। এক বছর পর ১০ জুলাই নজরুল তার সুহৃদ জুলফিকার হায়দারকে একটি চিঠি লিখেছিলেন “তুমি এখনি চলে এসো... আমি কাল থেকে অসুস্থ”। আমরা ধরে নিতে পারি ১৯৪২ এর ৯ অগস্ট থেকেই কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কবি তখন আক্ষরিকভাবেই কপর্দকহীন। সংসারে দুই শিশুপুত্র, পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রী প্রমীলা, সর্বক্ষণের অভিভাবক শাশুড়ি গিরিবালা। ১৭০০ গানের রেকর্ডে লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফার সন্ধান দেওয়া গ্রামোফোন কোম্পানি কোনো রয়্যালটি, প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিচ্ছে না, তার লেখার প্রকাশকরা ফিরেও তাকাচ্ছে না। ১৭ জুলাই ১৯৪২, শারীরিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করে এক বন্ধুকে পত্র লেখেন কবি। লিখেছিলেন : “আমি blood pressure এ শয্যাগত, অতিকষ্টে চিঠি লিখছি। আমার বাড়িতে অসুখ, ঋণ, পাওনাদারদের তাগাদা, প্রভৃতি worries, সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খাটুনি। তারপর নবযুগের worries ৩/৪ মাস পর্যন্ত। এই সব কারণে আমার nerves shattered হয়ে গেছে।... কথা বন্ধ হয়ে গিয়ে অতি কষ্টে দু’একটা কথা বলতে পারি, বললে যন্ত্রণা হয় সর্ব শরীরে”।
কবির অসুস্থতার কারণ বা কী ছিল তার অসুখ, তা নিশ্চিতভাবে কেউ জানাননি। নানা রকম কথা নানানজনে লিখে গেছেন। জনশ্রুতি আছে ‘নবযুগ’ সম্পাদনাকালে একবার কবি উত্তরপাড়ায় এক দুষ্কৃতি দলের কাছে প্রহৃত হয়েছিলেন, কয়েকজন যুবক উত্তরপাড়া থানার হেফাজত থেকে, ঘাড়ে ও মাথায় কঠিন আঘাত পাওয়া নজরুলকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই আঘাতের কথা কোনো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি।
বিস্ময়ে হতবাক হই—কী নিদারুণ হয়েছিল তার অসুস্থতা প্রকট হওয়ার পর। প্রথম সাত দিন চিকিৎসা করেন হোমিওপ্যাথিক মতে, নজরুলেরই বাড়িওয়ালা ডাক্তার ডি এল সরকার। অথচ মাত্র তিন দিন চিকিৎসার পর অতি উৎসাহী হয়ে নজরুলের সেই বন্ধু জুলফিকার হায়দার খবরের কাগজে কবির অসুস্থতার সংবাদ দিয়ে পাঠিয়ে প্রচার করে দেন নজরুল ‘উন্মাদ’ হয়ে গেছেন বলে। বাইশ বছর পরে লেখা তার গ্রন্থে (‘নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় ১৯৬৪) জুলফিকার হায়দার এই মিথ্যা সংবাদ প্রচারের সাফাই দিয়েছিলেন যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ‘হয়তো অসুখের সংবাদ পেয়ে কাজীদার অনেক বন্ধুবান্ধব এবং ভক্ত অনুরক্তদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যাবে, দেখতে আসবে’। অথচ জুলফিকার হায়দার প্রচারিত কবির ‘মস্তিষ্ক বিকৃতি’র মিথ্যা সংবাদ প্রচারের দুই বছর পরেও ১৯৪৪ এর ২৭ ফেব্রুয়ারি একজন নুরুল ইসলামকে একটা কাগজে লিখে নজরুল জানিয়েছিলেন “শ্রীমান মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, তুমি চিরঞ্জীব হয়ে থেকো। আমায় ও আমার ছেলে দুটিরে চিরদিন মনে রেখো”।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আর্থিক সহায়তায় কবিকে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য মধুপুর পাঠানো হলো ১৯৪২-এর ১৯ জুলাই। কিন্তু অর্থ শেষ হয়ে যাওয়ার পর কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয় ২১ সেপ্টেম্বর। ১৯৪৪ ২৪ মে আনন্দবাজার পত্রিকার ‘কবি নজরুল পীড়িত’ শিরোনামে একটি আবেদন প্রচারিত হয়। আবেদনে বলা হয়েছিল ‘বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহুদিন যাবত পক্ষাঘাতে শয্যাগত। অসক্ত হইয়া পড়ায় তিনি এখন নিঃস্ব ও কপর্দকহীন। তাঁহার স্ত্রীও পক্ষাঘাতে শয্যাশায়িনী। চিকিৎসা দূরের কথা, এমন সঙ্গতি নাই যে শিশু পুত্রদ্বয়, রুগণা পত্নী ও নিজের আহার্যটুকু জোটে। বাংলার জাতীয় কবির প্রাণরক্ষায় সহৃদয় সর্বসাধারণের অকুণ্ঠ সাহায্য একান্ত আবশ্যক’।
এরপর কয়েকটি সাহায্য সমিতি গঠিত হয়। কলকাতার সুখ্যাত চিকিৎসকেরা কবিকে দেখেন একাধিকবার। কিন্তু নিরাময়ের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কাজী আবদুল ওদুদের উদ্যোগে গঠিত ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’ কবিকে রাঁচির মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠানো হয় ১৯৫২-এর ২৫ জুলাই। কিন্তু চার মাস চিকিৎসাধীন থেকেও কোনো উন্নতি না হওয়ায় ফিরিয়ে আনে কলকাতায়। পরের বছর ১০ মে ১৯৫৩ কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে। সেখানকার চিকিৎসকেরা মতপ্রকাশ করেন যে কবির ব্রেন কুঁকড়ে গেছে অর্থাৎ মস্তিষ্কের সংকোচন হয়েছে। লন্ডন থেকে ১০ ডিসেম্বর নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হয় ভিয়েনায়। সেখানেও চিকিৎসকের অভিমত ছিল কবিকে আর সুস্থ করে তোলা যাবে না। এরপরেও পূর্ব জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক রুশ ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছিলেন। তাঁর অভিমত ছিল যে অনেক দেরি করে রোগীকে আনা হয়েছে। সাত মাস বিদেশে বৃথা চেষ্টার পর কবিকে ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় ১৯৫৩-এর ১৪ ডিসেম্বর।
এরপরেও ২৩ বছর জীবিত ছিলেন নজরুল। অভাবের তাড়না, মানসিক কষ্ট, নিঃসঙ্গতা, পরিচিত বন্ধুদের দূরে চলে যাওয়া, অবহেলা এসবই ছিল কবির শেষ জীবনের সঙ্গী। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বিনা ভাড়ায় থাকার জন্য ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত ও দুই বাংলা থেকেই লিটারারি পেনশনের ব্যবস্থা হওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি এসেছিল। ১৯৬২-এর ২৩ জুন দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পক্ষাঘাতে শয্যাগত স্ত্রী প্রমীলার দেহাবসান হল, কবি আরো নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন। (বাঁধন সেনগুপ্ত)
কী নিদারুণ দৃশ্য। মনে পড়ে শচীন সেনগুপ্তের সিরাজদ্দৌলা নাটকের কথা। নজরুলের লেখা ‘নদীর একূল ভাঙে, ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা’ কিংবা ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফিরি একা’ গান দুটি তাঁর জীবনের সাথে কত সহজে না মিলে যায়!
গ.
তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য গণসংবর্ধনার আয়োজন করেন (১৯৭২)। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশে সফর। আমি ও বন্ধু নারায়ণঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলীর ছেলে সফিউদ্দিন সারওয়ারের সঙ্গে সংবর্ধনায় দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুসহ মঞ্চে আরোহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভেঙেছে দুয়ার এসেছে জ্যোতির্ময় তোমারি হউক জয়’ সমবেত কণ্ঠে এই গান দিয়ে উপস্থিত লাখো দর্শক শ্রোতার গগনবিদারী কণ্ঠে অনুষ্ঠান শুরু হয়।
অনুষ্ঠান শেষে পূর্বপরিচিত আনন্দবাজার পত্রিকার আলোকচিত্রশিল্পীকে কবি নজরুল ইসলামের বাসায় নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। গিয়ে দেখি একটি জরাজীর্ণ কক্ষে চৌকিতে নির্বাক বসে আছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম! দেখে ভীষণ খারাপ লাগল। (তবিবুল ইসলাম বাবু /প্রথম আলো)
১৯৪২ সালের কবির অসুস্থতা আর কাটেনি। সেভাবেই তিনি ছিলেন কলকাতায়। অবশেষে ১৯৭২ সালের ২৪ মে অসুস্থ কবি দেখলেন স্বাধীন বাংলাদেশকে। কবির সঙ্গে ছিল কবির পুরো পরিবার। বড় ছেলে কাজী সব্যসাচী ও তাঁর স্ত্রী উমা কাজী, ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ ও তাঁর স্ত্রী কল্যাণী কাজী এবং তাঁদের সন্তানেরা এসেছিলেন কবির সঙ্গে। কবির ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডি কে রায়ও এসেছিলেন সঙ্গে।
জীবনের শেষ সময়ে জাতীয় কবি বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমায়িক আন্তরিকতায় তার প্রাপ্য সমাদর পেয়েছিলেন। তবে সামগ্রিক তথ্যমতে নজরুলের জীবনের শেষ চৌত্রিশটা বছর ছিল বড় মর্মান্তিক। এর অন্যতম সাক্ষী কমরেড মোজাফফর আহমদ, বন্ধু আবুল মনসুর আহমদ, কবি ও নজরুল গবেষক আবদুল কাদির। তারা বলেন, কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ জাতীয় কবির মতো নিদারুণ অবহেলা আর বঞ্চনার যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন কি না, জানা নেই। মধুসূদন দত্ত জীবনের শেষ দিনগুলো আত্মীয়-পরিজনহীন, চরম দারিদ্র্য ও সৈয়দ মুজতবা আলীও অবহেলার মুখোমুখি হয়েছিলেন যেমন, তেমনি নজরুলের শেষ জীবন ছিল চরম বেদনাদায়ক।
কবির দেহান্তর হলেও তার সাহিত্য চিন্তা রয়ে যায় কাল থেকে কালান্তর। আজকের পৃথিবীতে মানুষ যখন ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হতে হতে ক্রমশ ছোট হতে বসেছে, ঘরে ঘরে রাজনীতি, নীতি নৈতিকতা শেষ করে দিচ্ছে। শেষ হতে বসেছে সম্প্রীতি, সমানুভাবের মতো শব্দমালা, ঠিক এখনি বোধ হয় রবীন্দ্র নজরুল প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন আমাদের চর্চায় মন ও মননে।
তথ্যসহায়ক :
১. স্মৃতিকথা : মুজফফর আহমেদ
২. আত্মকথা : আবুল মনসুর আহমদ
৩. জীবন স্মৃতি : মাহমুদ নুরুল হুদা
৪. কাজী নজরুল ইসলাম: আবদুল কাদির
৫. নজরুল-জীবনী : রফিকুল ইসলাম
৬. নজরুল জীবনী (বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত) : গোলাম মুরশিদ
৭. নজরুল জীবনের শেষ পর্যায় : বাঁধন সেনগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা।