বাংলা নাট্যাঙ্গনের অনির্বাণ দ্যুতি হিসেবে আবির্ভূত এক অদ্বিতীয় সত্তার নাম মমতাজউদদীন আহমদ। প্রভূত প্রতিবন্ধকতায় আবদ্ধ বাংলাদেশের নাট্যভুবনে যাঁরা মুক্ত বাতাস সঞ্চারণ এবং সজীব পরিবেশ নির্মাণে সর্বদা সচেষ্ট, মমতাজউদদীন আহমদ তাঁদের অগ্রদূত এবং ভিন্নমাত্রিক কর্মগুণে অনন্য।
প্রতিভাদীপ্ত নাট্যকার, অভিনেতা, প্রাবন্ধিক, সংগঠক ও কথক হিসেবে তাঁর পরিচয় দেশ-বিদেশে বিস্তৃত। আন্তরিকতা, শ্রমনিষ্ঠা, প্রজ্ঞা, স্বদেশপ্রীতি এবং মানবিক মূল্যবোধ তাঁর এ পরিচিতিকে করেছে অধিক সমৃদ্ধ। সমাজজীবন এবং শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ বলেই তাঁর নাটকগুলো মৃত্তিকানির্ভর; ভিনদেশি নাটকও রূপান্তরগুণে পেয়েছে মৌলিকতার মর্যাদা। ব্যক্তিক-সামাজিক-রাষ্ট্রিক সমস্যা কিংবা অবস্থা চিহ্নিতকরণ, বিশেষত ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাভিত্তিক নাট্যরূপায়ণে তিনি কুশলী কারিগর। তাঁর নাটকের চরিত্রগুলো কথা বলে কখনো ধীরলয়ে, কখনো উচ্চস্বরে, কখনো তির্যক ভঙ্গিতে, কখনো রসালোভাবে, কখনো বা প্রতীকী ঢঙে। কথার পিঠে কথা সাজিয়ে গঠিত হয় সতেজ নাট্যসংলাপ, রচিত হয় সাহসিক বক্তব্য। নাটকের বাস্তবতায়, অভিনেতার ঋজুতায়, প্রাবন্ধিকের প্রাতিস্বিকতায়, সংগঠকের মমতায় এবং কথকের দৃঢ়তায় মমতাজউদদীন আহমদ উজ্জ্বল আর অকুতোভয় নাট্যজন।
স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, নুরুল মোমেন ও আসকার ইবনে শাইখ কয়েকজন প্রতিভাবান তরুণ ছাত্রছাত্রীর সমন্বয়ে নাট্যচর্চায় সংযুক্ত করেন নতুন মাত্রা। স্বাধীন বাংলাদেশে এসব নবীন নাট্যকর্মীই নাট্যান্দোলনের নেতৃত্ব দেন, গড়ে তোলেন গ্রুপ থিয়েটার কর্মকাণ্ড। মমতাজউদদীন আহমদ এ নাট্যচর্চার অগ্রজ এবং সক্রিয় সদস্য। অভিনয় ছাড়াও স্বাধীনতার এক দশক আগে, ১৯৬০ সালে তাঁর প্রথম নাটক রচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর রচিত ও মঞ্চায়িত নাটকগুলো যেন শত্রু হননের হাতিয়ার এবং জনগণকে জাগরণের মন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। সাহসী মুক্তিযোদ্ধার মতো তিনিও এক নাট্যসৈনিক, যাঁর নাট্যায়োজন দেখে হাজার হাজার দর্শক স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তবে তাঁর এসব নাটক কেবল স্লোগানসর্বস্ব নয়, শৈল্পিক মানদণ্ডে অবশ্যই উত্তীর্ণ।
পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিকভাবে মমতাজউদদীন আবাল্য নাট্যিক পরিবেশে লালিত ও সমৃদ্ধ। মায়ের কোলে বসে নাটক-যাত্রা দেখা, স্বজনের অভিনয়-নেশা এবং বাবার নীরব নাট্যশিল্পপ্রেম তাঁর নাট্যকর্মী হিসেবে বেড়ে ওঠার অনুকূল স্রোত হিসেবেই বিবেচিত। তাঁর পেশা অধ্যাপনা কিন্তু নেশা নাট্যচর্চা। তিনি বলেছেন, ‘নাটকের নেশায় যে একবার মজেছে তার আর উপায় নেই। বারবার তাকে আসতে হবে। তার ক্ষুদ্র ক্লিষ্ট সংসারে দারিদ্র্যের শত ছিদ্র বেদনা জড়িয়ে থাকুক, তার রুগ্ণ স্বাস্থ্যে অবক্ষয়ের যন্ত্রণা ঘিরে থাকুক, তবু তাকে আসতে হবে পাদপ্রদীপের সামনে। সে চায় জীবনের সংলাপ যথাযথভাবে উচ্চারণ করতে।’ জীবনবাদী মমতাজউদদীন এই নাটক নাটক করে সত্তর বছরে উপনীত হলেন। নাট্যকর্মীদের জন্য তিনি বরাভয়। সত্যের কাছে মাথা নত করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি ‘ভয়াবহ সব সত্য কথা বলেন, কোনো পরিণাম বিবেচনা না করেই।’ এ জন্য তিনি অনেক সময় ক্ষমতাসীন শক্তির বিরাগভাজন হলেও মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন অকুণ্ঠ। শওকত ওসমানের দ্বিধাহীন স্বীকারোক্তি, ‘মমতাজউদদীন আহমদকে তখন থেকে ভালোবাসতে শুরু করেছি, যখন থেকে দেখলাম, শোষকের ঘাস আর দানা ও খায়নি।’
নাটকের সাহিত্যমূল্য ও মঞ্চায়নসাফল্য একই সূত্রে গাঁথা। তাই নাট্যকলার প্রকৃত বিকাশের লক্ষ্য উপযুক্ত মঞ্চ প্রয়োজন। কিন্তু মঞ্চ কোথায়? মঞ্চের সাধ মিলনায়তনে মেটাতে হয়। এ ব্যাপারে সরকারের তেমন মাথাব্যথা নেই। মঞ্চ মঞ্চ করে মাথা ঠোকেন কেবল নাট্যকর্মী দল। এ ক্ষেত্রে মমতাজউদদীনের পরিষ্কার অভিমত, ‘আসলে বাংলাদেশে একটিও নাট্যমঞ্চ নাই। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের জন্য চার ফুট উঁচু একটা ঢিবি বেঁধে দিলেই তো হলো না। মঞ্চ মানে অনেক কিছু। আলো, দৃশ্যপট, মহড়াস্থল, প্রশিক্ষণব্যবস্থা ইত্যাদি যাবতীয় আয়োজন ছাড়া মঞ্চ হয় না। ব্যবস্থা ছাড়াই কম্বল সম্বল করে নাট্যকর্মীরা মোক্ষ লাভের সন্ধান করছেন, নাট্যকর্মীদের এ অমানুষিক উদ্যোগ ও পরিশ্রমকে বাহবা দিতেই হবে।’ অনেকেই আছেন প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই প্রতিবাদহীন কাজ করে যান। আবার কেউ কেউ কাজও করেন, প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের জন্য সোচ্চারও হন। মমতাজ শেষোক্ত শ্রেণিভুক্ত। এতে কিছু ভালো কাজও হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চ।
শিল্পীর মানসিক স্বস্তি ও আত্মিক উৎসারণ ছাড়া কোনো সুস্থ শিল্পকর্ম হতে পারে না। মঞ্চ নাট্যশিল্পীদের ভাগ্যে এ সুযোগ খুব কমই জুটেছে। পারিবারিকভাবে মনে করা হয়েছে নাটক করা মানেই ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়ানো। আর রং মেখে সং সেজে কেউ নাটক করবে, এটা সমাজ যেমন স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি, অনেক সময় রাষ্ট্রপক্ষও নয়। কারণ, নাটক সত্য উদ্ঘাটন করে, শোষণ-নির্যাতন ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, দর্শক-জনতাকে জাগিয়ে তোলে। ফলে প্রশাসনযন্ত্রের ভিত নড়বড়ে হতে পারে। এ আশঙ্কায় নাট্যকর্মী ও নাট্যগোষ্ঠীর ওপর জারি হয় নানা বিধিনিষেধ। নাট্যকর্মীদের চাপের মুখে অশুভ নিষেধাজ্ঞা খানিকটা শিথিল হলেও অলক্ষে থাকে খবরদারিত্ব। এ অবস্থার মধ্যেই নাটক করতে হয়। মমতাজউদদীন তাঁর যথার্থ চিত্র এবং জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন এভাবে, ‘নাট্যকর্মীদের আকাশে সারা রাত শুকতারা জ্বলে না। পূর্ণিমার আলোতে নরম ঘাসে আয়েশি পদচারণ নাট্যকর্মীদের ভাগ্যবিধাতা দিওয়ানুসুস রচনা করে যাননি। এ দেশে রাহুকবলিত অবজ্ঞাত শত শত নাট্যকর্মীর ভাগ্য বড় নিদারুণ হতাশায় অকালে ঝরে গেছে। নাট্যকর্মীদের একটি স্বাধীন ফেডারেশন গঠন করুন। নিরাপত্তার জন্য, বন্ধুত্বের জন্য। প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতায় সবার বন্ধুত্ব নির্মিত হোক। কে করবে এ দায়িত্ব পালন? আমি, আপনি আমরা।’ একজন সৎ, নির্ভেজাল, নিষ্ঠাবান ও নির্ভীক নাট্যজন ছাড়া এ আহ্বান জানাতে পারেন না।
সত্য প্রকাশে বাধা থাকলে লেখকরা রূপকের আশ্রয় নেন। নাটক পাঠ করে এই রূপকের অর্থ অনুধাবন প্রজ্ঞাবান পাঠকের জন্য যত সহজ, মঞ্চদর্শকের জন্য তত সহজ নয় বিশেষত বাংলাদেশের সহজ-সরল মানুষের কাছে। তাই মমতাজ বলেন, ‘আমরা রূপকে প্রকাশ করতে বসে রূপকের আশ্রয় গ্রহণ করছি। রূপই যখন অন্ধকার সেখানে আরও অন্ধকার রূপকে নিয়ে কতকাল চলব। বালুর মধ্যে মুখ লুকিয়ে উটপাখির আত্মগোপন স্বভাব আর কতকাল। সত্যকে সহজে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যদি নির্ভর না হয়, আনন্দের আলো যদি পর্যাপ্ত শক্তি না পায়, তাহলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে আমাদের নাটক কিছুকাল গোলকধাঁধায় ঘুরবে। তারপর একদিন পালাবে।’ তার মানে এ নয় যে মমতাজউদদীন রূপক ও নিরীক্ষাধর্মী নাটক রচনার বিপক্ষে কিংবা কেবলই ক্ষোভ ও ক্রোধ প্রকাশের পক্ষে। তিনি সত্যকে সাবলীল, রসালো, ব্যঙ্গাত্মক ও আন্তরিক দরদে চিত্রিত করতে অভ্যস্ত। তাঁর নাটকে জীবন ও শিল্পের মধ্যে কোনো বিরোধ না চরিত্রায়ণ ও সংলাপের স্বতন্ত্র নির্মাণশৈলীগুণে জীবনই প্রধান প্রতীয়মান হয়। এটি তাঁর সদর্থক জীবনভাবনা ও সমকাল সচেতনতার শিল্পিত রূপায়ণ-কৌশল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। এ আন্দোলন নিয়ে রচিত হয়েছে অমর গান, কবিতা, নাটক ও কথাসাহিত্য। মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকের পর ভাষা আন্দোলনভিত্তিক দ্বিতীয় কোনো সার্থক নাটকের নাম উচ্চারিত হলে তা অবশ্যই হবে মমতাজউদদীন আহমদের বিবাহ। দুটো নাটকেই রয়েছে ভাষা ও দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা এবং মানুষের অস্তিত্ববাদী চেতনা। ভাষা আন্দোলনের পরের বছর রচিত বলেই কবর নাটকের শহীদ মূর্তিদের প্রতিবাদ ও বাঁচার আবেদন সুস্পষ্ট। তারা কবরে যাবে না। তারা মরেনি, মরতে পারে না। প্রকৃত অর্থে এখানে মৃত ব্যক্তির সদর্থক চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে জীবিতদের মধ্য। তারপর বীর বাঙালি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে কেউ কেউ স্বার্থের পাহাড় গড়েছে। কেউবা আশাভঙ্গের বেদনা কিংবা ত্যাগের মহিমাকে বছরের পর বছর লালন করে চলেছে। বিবাহ নাটকের সখিনারও সাধ ছিল, স্বপ্ন ছিল। সে যখন গায়েহলুদ আর হাতে মেহেদি মেখে বধূবেশে বসেছিল, তখন তার হবু বর বায়ান্নর উত্তাল মিছিলে ছুটে গিয়ে নিজ রক্তের বিনিময়ে ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করে। সখিনার চেতনায় সেই হলুদের রং রক্তের মতোই গভীর। মোছা যায় না। তাই স্মৃতি আর স্বপ্নের সাগরে ভাসমান কঠিন-করুণ সখিনার আবেদন, ‘আমার আনন্দ, গৌরব, সুখ, সংসার। কাকে দেব, কেমন করে দেব ছোট মামা। হলুদ শাড়ি আমার ওই শাড়িতে যে বেঁচে থাকার প্রদাহ, দাহ লেগে আছে। না জানা ভালোবাসা ছোট মামা, আমার এক এক করে অনেক বছরের ফাল্গুন জমে আছে। আমি যে নীড় রচনার কাজে নিমগ্ন আছি। এই দেখলাম হাঁড়িতে ভাত টগবগ করে ফুটছে, কখনো শুনছি একটি সবল নরম কণ্ঠ এসে আমাকে বলছে : চল না নৌকায় চড়ে নদীর মোহনায় যাই। কখনো শুনি একটি কচিকণ্ঠের অমৃত কান্না বলছে : মা, ওমা আমাকে কোলে নাও, ঘুম যাব। সখিনার বাবাকেও মমতাজউদদীন বাংলা ভাষা, স্বাধীনতা ও মানবতার পক্ষের একজন দরদি মানুষ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকাতে শুনছি ছাত্ররা খুব ক্ষেপে গিয়েছে আতিয়া। মিছিল করবে, হরতাল করবে। করবেই তো। বাংলা ভাষা যদি না থাকে তো কিসের দেশ, কিসের স্বাধীনতা।’এবং ‘আমার মেয়ের জামাই জালেমের গুলিতে শহীদ হয়েছে। বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। এ তো একটা ঘটনা না। এ তো ইতিহাস, এ তো একটা অগ্নিগিরি। আমি বলছি, আমার দেল বলছে ওই ছেলেকে আমরা মাটির নিচে রাখব না। আমার ছেলেকে হরগিজ কবরে যেতে দেব না।’ আন্দোলন কিংবা যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের কবরে না যাওয়া অথবা যেতে না দেওয়া Irwin Shaw's BURY THE DEAD, মুনীর চৌধুরীর কবর এবং মমতাজউদদীন আহমদের বিবাহ নাটকে প্রতিবাদ হিসেবে উচ্চারিত হয়েছে। এখানে কেউ কারও দ্বারা প্রভাবিত নন, বরং তিনজনই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মমতাজউদদীন মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ছিলেন চট্টগ্রামে কর্মরত। তাঁর পেশা অধ্যাপনা, নেশা নাট্যচর্চা। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং মুক্তির শুদ্ধচেতনায় জনতাকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্য তিনি নাট্যরচনা ও মঞ্চায়নে নিমগ্ন হন। এখানে নেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল তাঁর দেশপ্রেম। স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা নাটকে স্বাধীনতাবিরোধী চরিত্র নূর মোহাম্মদ যখন বলে, প্রয়োজন হলে লাখো মানুষের জীবন যাবে, তবু দেশ ভাগ করা চলবে না, তখন নাট্যকার জনতার প্রতিনিধির মাধ্যমে জানান দেন, ‘প্রেমের জ্বালা আর স্বাধীনতার আগুন কখনো নিভে না।’ এবারের সংগ্রাম নাটকেও একজন নির্যাতিত মানুষের উদ্দেশে বলে, ‘আমার হৃদয়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে এ আকাশ এ মাঠ আর সমুদ্রকে বলে দিচ্ছি, ভাইসব, এদের চিনে রাখ, এরা ধর্মের নামে, সংহতির নামে, নানা ফন্দির জাল বিস্তার করে আমাদের শোষণ করছে। আর এদের ছেড়ে দিয়ো না। এবার এরা ঘরে ঘরে ঢুকে প্রত্যেকের সন্তানকে হত্যা করবে। এরা খুনি। মানুষের রক্তের বিনিময়ে এরা সাম্রাজ্যবাদীদের ডেকে আনে, তোমরা এদের নির্মূল কর।’ স্বাধীনতার সংগ্রাম নাটকের জহুরুল এবং বর্ণচোরা মতিউরের কণ্ঠেও একই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং স্বাধীনভাবে বাঁচার স্পৃহা ব্যক্ত করেছেন নাট্যকার মমতাজউদদীন।
স্বাধীনতার প্রায় দেড় যুগ পর মমতাজউদদীন আহমদ রচনা করেন মঞ্চসফল কালজয়ী নাটক সাতঘাটের কানাকড়ি। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির জাগরণ, স্বজন-সম্পদ ও ইজ্জতহারা মানুষের বেদনা, তোষামোদকারীদের সুবিধাভোগ, স্বৈরশাসনের দাপট এবং গণমানুষের প্রতিরোধ-সংকল্প এই নাটকের উপজীব্য বিষয়। নাট্যকার কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো প্রতীকের আলোকে, কখনোবা সূক্ষ্ম হিউমারের মাধ্যমে বক্তব্যবিষয়কে নাট্যরূপ দিয়েছেন। অন্যান্য নাটকের মতো এখানেও তাঁর নিজস্ব নির্মাণশৈলী, শক্তি ও সাহস উপস্থিত। নাটকে যুবকদের ন্যায়সংগত যে জিজ্ঞাসা, তা নাট্যকারের সত্যাশ্রয়ী, প্রতিবাদী, স্বাধীনতাপ্রীতি উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। তাঁর হাত ধরে নাটকের সংলাপে বলিষ্ঠ কণ্ঠ মঞ্চ কাঁপায় বাঙালি জাতিসত্তার জিজ্ঞাসা, ‘মুনীর চৌধুরীকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার হলো না কেন? জহির রায়হানের হত্যার তদন্ত হলো না কেন? বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা ঘুরে বেড়ায় কেন? উত্তর কোথায়?’
মমতাজউদদীন-ঘোষিত এ যুদ্ধ অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য, স্বাধীনতাকে প্রকৃত অর্থবহ করার জন্য, সামগ্রিক কল্যাণের জন্য। শোষকের বিরুদ্ধে, নির্যাতকের বিরুদ্ধে, মিথ্যার বিরুদ্ধে তাঁর কলম ও কণ্ঠ ছিল সর্বদা শানিত। পাঁচ দশক ধরে মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মহান সংগ্রামে অংশগ্রহণের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন নিষ্ঠাবান নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ। তিনি সরকারি চাকরি করেছেন। চাটুকারিতা নয়, অধ্যাপক হিসেবে নিজস্ব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে অসংখ্য মানুষ গড়েছেন, অসৎ আর অসত্যের কাছে কখনো আত্মবিসর্জন দেননি। নির্ভয় আর অসীম বিশ্বাসে তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর জীবনাদর্শ, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালো বাসিলাম।’ তাঁর এই কঠিন ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম নাটক, যা এ জাতির তরে সত্য ও সুন্দরের সমন্বয়ে রূপায়িত এক অমূল্য সম্ভার। জাতীয় ও বৈশ্বিক নাটকের ঘরানায় সত্যবান, সাহসিক, আন্তরিক ও ভিন্নমাত্রিক নাট্যজন মমতাজউদদীন আহমদ এক মৃত্যুঞ্জয়ী মহাজন। যারে হারায়ে খুঁজে ফেরে বাংলাদেশ।