ছোট কাকার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম, জীবনে প্রথম। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। তখনও পর্যন্ত কোনো সিনেমা দেখিনি। সে সময় শুনলাম, ‘ছুটির ঘণ্টা’ নামে একটা সিনেমা এসেছে ‘ছবিঘর’ সিনেমা হলে। ‘ছুটির ঘণ্টা’তে নাকি একটা বাচ্চা ছেলে স্কুলের বাথরুমে আটকা পড়ে এবং স্কুলের দফতরি ভুল করে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে চলে যায়। তারপর বেশ কয়েকদিন স্কুল ছুটি থাকায় সেই আটকে পড়া বাচ্চাটি শেষ পর্যন্ত সমস্ত দর্শকের চোখে অশ্রুর প্লাবন ডেকে মারা যায়। তাই এ সিনেমাটি হলে গিয়ে দেখার জন্য সেই প্রথম পারিবারিক অনুমতি পেয়ে যাই, তবে যেতে হবে ছোট কাকার সঙ্গে। এরমধ্যেই একদিন, আমি ও আমার বড় কাকার ছেলে ছোট কাকার সঙ্গে ঝিনাইদহ ‘ছবিঘর’ সিনেমা হলের সামনে গিয়ে দেখি, ‘ছুটির ঘণ্টা’ আগের দিনই নেমে গেছে। চলছে ‘আপন ভাই’। ‘আপন ভাই’ই আমার দেখা প্রথম সিনেমা, হলে বসে। ছোট কাকার সঙ্গে। যদিও আমার নিজের কোনো আপন ভাই নেই। ‘আপন ভাই’ ছবিতে নায়িকা ছিলেন ববিতা। ববিতাকে দেখে পছন্দ করে ফেললাম। ববিতাকে দেখে খুব ভালো লেগে গেল। পরে ববিতার আরও কত ছবি যে দেখেছি। সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ও পরে বড় হয়ে দেখেছি। দেখার বিশেষ কারণ, ববিতাকে আমার পছন্দ হয়ে গেছে। তখন, সে বয়সে মনে হয়েছিল বড় হয়ে ঢাকায় যাব এবং ববিতার সঙ্গে আমার দেখা হবে নিশ্চয়ই। তখন সেই বয়সে তো আর জানতাম না যে, একদিন আসলে সত্যি সত্যি আমিই সিনেমা বানাব ঢাকায় বসে। যাই হোক, ববিতার সঙ্গে কিন্তু আমার আজও দেখা হয়নি। এত বছর ঢাকায় আছি, তাও। হয়ত একদিন দেখা হবে!
ববিতার পাশাপাশি শাবানাকে ভালো লেগেছিল ‘অবুঝ মন’ ছবিতে দেখে। পরে, শাবানারও অনেক ছবি দেখেছি আমি। আরও দু’একটি ছবিতে শাবানাকে আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু ‘লাইলি-মজনু’ ছবিতে ববিতার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। বালু বা মরুভূমির মধ্যে লাইলিরূপী ববিতা যেভাবে আছড়ে আছড়ে পড়েছে মজনুর জন্য, তা দেখে আমার তখন ভালোমতো গোঁফ-দাড়ি না উঠলেও নিজেকে এ যুগের মজনু মনে হয়েছিল। কার জন্য? লাইলির জন্য। লাইলি কে? ববিতা। শুনলাম, ববিতা বা তার বোন সুচন্দারা যশোরের মানুষ, আমিও বড় হচ্ছিলাম যশোর জেলাতেই, তাই মনে হলো— ববিতার ওপর আমার খানিকটা অধিকার আছেই। সেই অধিকার, কিসের অধিকার? অবশ্যই প্রেমিকের, চূড়ান্ত অর্থে কর্তৃত্বের অধিকার। ভালোবাসা পাওয়া ও দেওয়ার অধিকার এবং কর্তৃত্বের ব্যাপারও বটে। ‘ছবিঘর’-এ বসে সিনেমা দেখেই, সেদিনের কৈশোর মনে ববিতাকে অনুভূতির মধ্যে পেয়ে গিয়েছিলাম।
ববিতার পরপরই ভালো লাগল শাবানাকে। তবে সে-অর্থে শাবানা-ফ্লু হয়নি আমার। যেটা হয়ে গেল সুচিত্রা সেন, কবরীর সঙ্গে। হ্যাঁ, সুচিত্রাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে ফেললাম হাই স্কুলে থাকতেই। কিসের উত্তম কুমার? সুচিত্রার ছবি দেখতাম সুচিত্রাকে দেখার জন্য, সুচিত্রার হাসি দেখার জন্য। সুচিত্রার মুখের তিলটি দেখার জন্য। চুলের খোঁপা দেখার জন্য। সব মিলিয়ে সুচিত্রার জন্য আমার মন সেদিন কিই-না করেনি! তবে সুচিত্রার ছবি সব দেখেছি টেলিভিশনে, ভিসিআর-ভিসিপিতে। সুচিত্রারা পাবনার মানুষ—এটা জানার পর প্রায়ই মনে হতো, একদিন না হয় ঝিনেদা থেকে কুষ্টিয়া পার হয়ে পাবনা ঘুরে আসি। সত্যি, সুচিত্রা সেনকে আমি কোনোদিন ভুলব না। ভুলব না ববিতাকেও। আর কবরীকে চিরকাল মনে রেখে যাব।
কবরীই হচ্ছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে মিষ্টি মেয়ে, বাজি ধরে বলতে পারি। কবরীর ছবিগুলো দেখলেই, এখনও মনে হয় আহ্! এ রকম আরেকটি মেয়ে আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পেলাম না আমরা। কবরীর মুখে যে মায়া, যে নীরব-জাদু কাশবনের ঢেউয়ের মতো বিচ্ছুরিত হয়, তা আর পাইনি কোথাও। ‘সারেং বউ’, ‘সুতরাং’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘দেবদাস’—কোন ছবি তার দেখিনি? ঢাকায়, শাবানাকেও আমি কখনও সামনাসামনি দেখিনি। তবে জাতীয় জাদুঘরে ‘কবরীর চার দশক’ শীর্ষক আলোকচিত্র-প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে গ্যালারিতে পেয়ে যাই আমার কৈশোরের সেই মিষ্টি মেয়েকে, কবরীকে। এই কবরী তখন পার্লামেন্ট মেম্বার, এই কবরী রাজনীতিবিদ। ইশ...ছোটবেলায় মনে হতো, কবরী কেন আমার জন্মের আগেই জন্মেছে! রাতে, বিছানায় শুয়ে ঘুম-অনাগতকালে কবরীকে মনের মধ্যে করে উড়াল দিতাম। কেউ জানে না।
জাদুঘরে, বেশ কিছুক্ষণ কথা বললাম তার সঙ্গে, এক ফ্রেমে ফটো তোলাতুলিও হলো, খুব ভালো লাগল কবরীকে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে কবরীর বিয়ের দৃশ্যে, রাতে, কী যে টান দিয়ে যায় নায়িকার মুখ! সেই টান-টানানি লেখা সম্ভব নয়। ওই দৃশ্য দেখলেই আমার মনে হয়, আমিও মল্লপাড়ার ছেলে। আমিও তিতাস নদীতে মাছ ধরি। আমারও পছন্দ আছে। আমি যাকে পছন্দ করেছি, সেই চরিত্রে একমাত্র মানায় কবরীকে। এটা বুঝতে পেরেই ঋত্বিক ঘটক কবরীকে কাস্ট করেছেন। আমি সবসময় বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানাই ঋত্বিককে। সত্যজিৎ রায় হচ্ছেন মাস্টারমশাই, কিন্তু ঋত্বিক ব্যাটা স্কুল কমিটির অভিভাবকদেরই গালাগাল করেন। সমাজে দু’জনেরই প্রয়োজনীয়তা থেকে যায়। তাই সত্যজিৎ আমার পছন্দের কথা মনে রেখেই ববিতাকে নিয়ে একটি ছবি হলেও করেছেন। ঋত্বিক কবরীকে নিয়ে করেছেন। দুই পরিচালকই আমাকে বিবেচনায় রেখে বাংলা ছবি করে গেছেন। প্রমাণিত।
তাহলে আর যারা, তারা কারা? তাদের কি মোটেই মনে রাখিনি? তারা কি মোটেও পাত্তাযোগ্য নন আমার দু’নয়নে? আমার অন্তরে? তা কেন হবে? আমি কি তা বলেছি? আমি কোন সাহসে বলব মাধুরীকে, তার আগে শ্রীদেবীকে আমার ভালো লাগেনি? ঐশ্বরিয়াকে ভালো লাগেনি—এ কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে? দীপিকা পাডুকোনকেও আমার ভারি পছন্দ। একদা মণীষা কৈরালার দিকেও আমার নজর গিয়েছিল। আবার পাওলি দামের মধ্যে একটি কালো সাপ কি দেখিনি আমি? যে সাপের ঠোঁটে চুমু খেয়ে মরে যেতে চায় অনায়াসেই অনেক যুবক! নন্দিতা দাশের প্রতি একটা গোপন দুর্বলতা আমার রয়েই গেছে। রাইমা সেনকেও খুব পছন্দ হয়েছে। পছন্দ হতে তো আর অনুমতি লাগে না, কোনো সিডিউলও লাগে না, পছন্দ হয় তাই পছন্দ করি। পছন্দের ওপর সামরিক আইনও কার্যকর করে রাখা যায় না। যায় না বলেই, শ্যারন স্টোনকে আমার পছন্দ ছিল, পছন্দ ছিল জোলিকেও। একদা মনরোর স্টিল দেখে যতটা আকর্ষণ বোধ করেছি, ওর ছবিগুলো দেখে ওকে অতটা টানেনি। টানেনি বলেই, আমি মনরোর আত্মহত্যাময়-মৃত্যুতে কি একটুও কাঁদিনি? দোকান থেকে একটা দামি ব্রা কিনে এনে আমি কি আমার ঘরের মধ্যে ঝুলিয়ে রেখেই বলিনি, এটা বাংলাদেশের ‘মনরো মিউজিয়াম?’ সালমা হায়েকের চেয়ে হয়তো মনিকা বেলুচ্চির দিকেই বেশি রাত ঘোরাঘুরি করে ফেলেছি। তবে সব কথা তো আর বলা যায় না। বলা ঠিকও না। ইরানের এক ছবি দেখে আমার মনে হয়েছে, যাই, ঢাকায় তো অনেক বছর হয়ে গেল, এবার না হয় তেহরান থেকে আসি কিছুদিন। তেহরানের ছবিগুলো বিশ্ব চলচ্চিত্রে জায়গা করে নিল, চোখের সামনেই। গত দু’দশক ধরেই, তেহরান-ছবির মধ্য দিয়ে আমি কি ইরানিয়ান মেয়েদের দিকেও লক্ষ রাখছি না?
আমার তবু ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র ইভা আচাউকে মনে পড়ে। এজন্যে আমি একবার হলেও এ জীবনে ইয়াঙ্গুন যাব। ইভা আচাউয়ের খোঁজ-খবর নেব। আশির দশকের হাসিমাখানো মেয়ে সুচরিতাকে মনে পড়ে। ‘তালাশ’ ‘হারানো সুর’-এর শবনমকে মনে পড়ে। মৌসুমী-শাবনূর তো চোখের সামনেই ধেই ধেই করে বড় হয়ে উঠল, হয়ত শতখানেক করে ছবি করেও গেল। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে আমি চোখের সামনে তেমন কাউকে দেখছি না—যাকে দেখে, ঘুম হারাম হয়ে যাবে। খাওয়া-দাওয়াও প্রায় বন্ধ হবে। মনে মনে নায়ক মনে হলেও স্বাস্থ্য যথেষ্ট খারাপ হয়ে যাবে। পাড়াপ্রতিবেশিনীদের দিকেও নজর দেওয়ার টাইম পাব না—সেই নায়িকা কই?
নিশ্চয়ই আছে, আড়ালে সে আছে। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো বনে সে কুঁড়ি মেলে দেওয়ার সন্ধিক্ষণে আছে, পুষ্প হওয়ার প্রস্তুতিতে আছে। যার মুখে মায়া, জাদু, নেশালাগা ঘোর, বিদ্যুতের ঝিলিক, সাপের ফণা কিংবা যার হাসির মধ্যে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল আছে, সেই মুখ আছে নিশ্চয়ই। এখন অপেক্ষার মুহূর্ত যাচ্ছে। সম্ভবত সেই নায়িকার মুখ দেখব বলেই এখনও এই দুই চোখ সম্পূর্ণ খুলে রেখেছি...