উপন্যাস-রচয়িতা হিসাবে সমধিক পরিচিত হলেও প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩) প্রবদ্ধের ঢঙে বেশ কিছু গ্রন্থ বা পুস্তিকা রচনা করেছেন। আখ্যানধর্মিতার আঙ্গিকে রচিত এ সমস্ত লেখার পরতে পরতে তাঁর নারীভাবনার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। শিল্পমূল্য বিচারে এসমস্ত রচনা তাঁকে মহীয়ান করে না তুললেও এসবের রয়েছে ঐতিহাসিক ও সামাজিক তাৎপর্য ।
প্যারীচাঁদ মিত্রের নারীভাবনা বিষয়ে বিস্তর বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর ‘রামারঞ্জিকা (১৮৬০)’ গ্রন্থে। এছাড়া ‘অভেদী (১৮৭১)’, ‘এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্বাবস্থা (১৮৭৯)’, ‘আধ্যাত্মিকা (১৮৬০)’, ‘বামাতোষিণী(১৮৮১)’ এবং ‘আলালের ঘরের দুলাল(১৮৫৮)’ নামক গ্রন্থসমূহে তাঁর নারীভাবনার প্রক্ষেপণ রয়েছে। নিছক সাহিত্যসৃজন নয়- সমাজসংস্কার, নারীজাগরণ ও শিক্ষাবিস্তার তাঁর রচনার প্রধান উদ্দেশ্য। প্যারীচাঁদ মিত্র বাঙালি নারীর মানসিক দাসত্বমোচনের উপায় খুঁজেছেন ।
‘রামারঞ্জিকা’ গ্রন্থে প্যারীচাঁদ প্রশ্ন-উত্তরের ধাঁচে, স্ত্রী পদ্মাবতী ও স্বামী হরিহরের কথোপকথনের ঢঙে বাল্যবিবাহ, বিধবাবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহ প্রথা, নারীশিক্ষা, নরনারীর সম-অধিকার সম্পর্কে নিজের মতপ্রকাশ করেছেন। পৌরাণিক ও ইউরোপীয় নারীদের স্বাধীনচেতা রূপকে তুলে ধরে তিনি স্ব-কালের নারীজাগৃতির পথ বাৎলে দিয়েছেন। অজ্ঞতা-অশিক্ষা-পশ্চাৎপদতার আকর পদ্মাবতী যেন তৎকালীন নারীসমাজের যথার্থ প্রতিচিত্র। পদ্মাবতী তার ৮ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে দিতে মরিয়া। ‘মেয়েমানুষ লেখাপড়া শিখলে বিধবা হয়’-বলে দৃড়ভাবে বিশ্বাস করে যে সমাজ, সেখানে হরিহর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে স্বরগ্রাম উচ্চকিত করেন। যেখানে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথসহ বিভিন্ন প্রথিতযশা ব্যক্তি বাল্যবিবাহের সাথে সংশ্লিষ্ট, সেখানে প্যারীচাঁদের চিন্তা বেশ অগ্রগামী।
প্যারীচাঁদ মিত্র নারীকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে ছিলেন বদ্ধপরিকর। মেয়েরা শিক্ষিত না হলে সমাজে শিক্ষিত মায়ের অভাব দেখা দেবে। শিক্ষিত মা ছাড়া শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলা যে অসম্ভব, নোপোলিয়নের বাণীর যথাযথ তাৎপর্য অনুভব করে তিনি বলেছেন- ‘‘অগ্রে ভাল মাতা যাহাতে হয়, এমত চেষ্টা কর।’’ তাঁর বক্তব্য, মায়ের কটূবাক্য, মিথ্যাচার, হিংসার মনোভাব সন্তানে বর্তায়। আবার, শিক্ষিত মায়ের তত্ত্বাবধানেই শিশুরা প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে । অশিক্ষিত মাকে প্যারীচাঁদ অন্ধ-বোবা পথপ্রদর্শকের সাথে তুলনা করেছেন।
বাংলার মায়েদের উদ্দেশে প্যারীচাঁদ বলেছেন, তারা যেন আড্ডাচ্ছলে ও আনন্দের পরিবেশে সন্তানদেরকে শিক্ষা প্রদান করেন। ভয়ের পরিবেশ শিশুশিক্ষার অন্তরায়। মায়েদের উচিত সন্তানকে ভয় না দেখানো এবং অবশ্যই শারীরিক নির্যাতন না করা। শিক্ষায়-চিন্তনে-আধুনিকমনস্কতায় তিনি ছিলেন অনন্য। আমাদের দেশের কিছু স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় আমরা ভূরিভূরি শিশু-নিগ্রহের ঘটনা দেখতে পাই। অথচ, এতো বছর পূর্বে প্যারীচাঁদ মিত্রের শিশুশিক্ষা-মনস্তত্ত্ব আমাদেরকে বিস্মিত করে।
পুরাকালে স্ত্রীলোকের সতীত্ব হরণের শাস্তি ছিল প্রাণদণ্ড। পরস্ত্রীকে ‘সুভগে ভগিনী’ হিসেবে সম্বোধনের রীতি ছিল। ‘স্বয়ম্বরা’র মাধ্যমে উপযুক্ত নারীরা তাদের জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারতো। কিছুকাল পূর্বপর্যন্ত আমাদের নারীদের অবস্থা ছিলো ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’। তাঁর দৃষ্টিতে নারীকে উপযুক্ত হওয়ার সুযোগ না দেওয়া অসভ্যতারই নামান্তর। স্ত্রী সুশিক্ষিত না হলে পুরুষেরও প্রকৃত জ্ঞান অর্জিত হয় না। তিনি বলেন, “সুশিক্ষিতা স্ত্রী পুরুষের এক প্রকারের শান্তা ও উপদেষ্টা।” প্যারীচাঁদ মিত্র নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। ‘কুমারসম্ভব’ ও ‘বিক্রমোর্বশী’, নাটকে বর্ণিত পৌরাণিক নারীদের লেখাপড়া এবং ভাস্করাচার্যের কন্যা লালাবতীর গণিতশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জনসহ বিভিন্ন দৃষ্টান্তের মাধ্যমে তিনি হৃষ্টচিত্তে ‘প্রত্যেক কন্যাকে পুত্রবৎ পালন ও যত্নপূর্বক শিক্ষাদান করা কর্তব্য’ বলে মতপ্রকাশ করেছেন।
কৌলিন্যপ্রথা ছিলো আমাদের সমাজের আরেক অভিশাপ। কুলীন ব্রাহ্মণেরা এ ‘বল্লালী বালাই’-কে পুঁজি করে ক্ষেত্রবিশেষে শতাধিক বিয়ে করতো। কোথায়, কবে, কোন বাড়িতে বিয়ে করছে, তা নোটবুকে লিখে রাখতো। পারসোনাল সেক্রেটারির সহায়তায় খাতায় দাগ কেটে, সারাবছর একের পর এক শশুরবাড়িতে গিয়ে হাজির হয়ে সেখানে এক-দু’রাত কাটাতো। এরপর পর্যাপ্ত পারিতোষিকসহ বাড়ি ফিরেই কিংবা সেখান থেকেই অন্য শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা হতো। ব্রাহ্মণনামী এসব ব্যবসায়ীরা ‘ঘাটের মড়া’র স্তরে পৌঁছে কখনওবা শ্মশানেই আবাস গাড়তো। একে ‘অন্তর্জলিযাত্রা’ নামে অভিহিত করা হয়। বলাবাহুল্য, এ অবস্থাতেও এরা অনেক সময় আরও দু-একটি বিয়ে করতো। প্যারীচাঁদ কৌলিন্যপ্রথা ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে সর্বদাই খড়গহস্ত ছিলেন।
সমাজ যখন পুরুষের শিক্ষাকেই গুরুত্ব দেয়নি, তখন নারীশিক্ষার অপরিহার্যতার কথা বলেছেন প্যারীচাঁদ মিত্র। খুরধার লেখনির মাধ্যমে এগিয়ে নিয়েছেন তাঁর শিক্ষা-আন্দোলনকে। এই একুশ শতকেও আমাদের সমাজের কেউ-কেউ যখন ‘মেয়েরা টু-থ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেই চলে’ বলে সুচিন্তিত মতপ্রকাশ করেন, বিপরীতে প্যারীচাঁদের নারীশিক্ষা-ভাবনা আমাদেরকে যারপরনাই বিস্মিত করে।
এবার একটু উল্টোরথে চড়া যাক। বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রবর্তিত বিধবাবিবাহ আইনের বিরোধিতা করেছেন প্যারীচাঁদ মিত্র। স্ত্রীকে সর্বদাই স্বামীর প্রেমে উপগত থাকবার পরামর্শ দিয়েছেন। পতির বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর বাক্য ব্যবহার না করা, উচ্চস্বরে কথা না বলা, এমনকি পরস্ত্রীতে আসক্ত স্বামীর প্রতি অনুরক্ত থাকাকে তিনি পতিব্রতা নারীর কর্তব্য বলে মনে করতেন। ‘রামারঞ্জিকা’য় তিনি বলেছেন, “পতিশুশ্রূষা, পতির অনুকূলবর্তিনী হওয়া, পতিবন্ধুর অনুবৃত্তি করা, নিত্য পতির নিয়মধারণ, এই চারিটি পতিব্রতা স্ত্রীর লক্ষণ ও ধর্ম।”
এছাড়া ‘বামাতোষিণী’ তে প্যারীচাঁদ বলেছেন, স্ত্রীলোকের তিন কার্য- সংসার কার্য করা, স্বামীকে সুখী করা ও সন্তানদিগকে শিক্ষা দেওয়া। ‘আধ্যাত্মিকা’ নামক গ্রন্থে তিনি বিধবাদেরকে ব্রহ্মচর্য-ধর্ম পালনের পরামর্শ দিয়ে বলেছেন- স্ত্রী জীবনে একবারই পতিগ্রহণ করবে এবং একপতিতেই আজীবন সমর্পিত থাকবে। পতি জীবিত থাকলেও পতি, মৃত্যুবরণ করলেও পতি। সুতরাং, নিজের জৈবিক সুখের জন্যে নোতুন পতিগ্রহণ করা অধর্ম।
প্যারীচাঁদ মিত্র সতীদাহ তথা সহমরণপ্রথার পক্ষে জোরালো বক্তব্য পেশ করেছেন। সহমরণে যাওয়াকে নারীর অধিকার বলে প্রতিপন্ন করেছেন। এহেন নারীর আধ্যাত্মিক বলের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। এমনকি, একে বীরত্বব্যঞ্জক বলে অভিহিত করেছেন। সবচাইতে বিস্ময়কর বিষয়, ‘অভেদী’ গ্রন্থে সহমরণকে তিনি সোক্রাতিসের হেমলকপানে মৃত্যুবরণ এবং জেসাস ক্রাইস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার চাইতেও পবিত্রকর্ম বলে উল্লেখ করেছেন।
প্যারীচাঁদ মিত্র স্থানীয় ও সর্বভারতীয় বহু সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় আইনবিষয়ক ও ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরিচিত ছিলেন সমাজসেবী হিসেবে। কলকাতা মিউনিসিপ্যালটির অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা করতেন। বঙ্গীয় থিয়সফিকাল সোসাইটির সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন। ছিলেন ‘এগ্রিকালচার ও হর্টিকালচার সোসাইটি’র সহকারী সভাপতি। ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে ভক্তি প্যারীচাঁদকে অনেকটাই চোখ-খোলা মানুষ করে তুলেছিলো। কিন্তু, এর ধারাক্রম বজায় রাখতে তিনি শেষতক ব্যর্থ হয়েছেন।
মাইকেলের তীব্র আলোকচ্ছটা প্যারীচাঁদকে আলোকিত করতে পারেনি। বঙ্কিমের শিল্পীসত্তাও তাঁকে উজ্জীবিত করতে ব্যর্থ। পুরাণ থেকে নারীশিক্ষার গুরুত্ব বোঝলেন; অথচ, সেই পুরাণের দোহাই পেড়েই বিধবাবিবাহের বিরোধ করলেন। ইউরোপীয়-মার্কিন নারীর অগ্রগামিতার অকুণ্ঠ সমর্থক হয়েও সতীদাহপ্রথাকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করেছেন! এহেন দ্বৈতসত্তা প্যারীচাঁদ মিত্রের চারিত্র্যকে নিঃসন্দেহে খর্ব করে।
দোষে-গুণে-উদারতায়-সীমাবদ্ধতায় মানুষ। বাল্যবিবাহের বিরোধিতা, সামাজের উন্নতিতে শিক্ষিত-মায়ের অপরিহার্যতা, সন্তানকে আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষাদান, নারীশিক্ষায় যারপরনাই গুরুত্বারোপ, নারী-পুরুষের সমমর্যাদা, পুত্র-কন্যাকে সমদৃষ্টিতে দেখা, জ্ঞানার্জনকে মহৎ-কর্ম বলে ভাবা- ইত্যকার বৈশিষ্ট্য প্যারীচাঁদ মিত্রকে আধুনিক, অগ্রপথিক ও স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষের কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়। আবার, সহমরণকে সমর্থন এবং বিধবাবিবাহের বিরোধিতা তাঁকে পশ্চাতেও ঠেলে দেয়। বাঙালির প্রগতিশীলতা, মানবতাবাদ, যুক্তিবাদের অন্যতম পথিকৃৎ হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১)-র সাক্ষাত ছাত্র হয়েও তিনি কী করে এমনটি করতে পারলেন, তার উত্তর মেলা ভার!
বাঙালির আজদিনের শিক্ষাদীক্ষা-চালচলন-আধুনিকচিন্তন বহুযুগের কর্মপ্রক্রিয়ার ফসল। বহুপ্রজন্মের-বহুজনের নিরবচ্ছিন্ন পথহাঁটা এবং বহু অনলস-কর্মের ও অজস্র-চিন্তার ফলে গড়ে উঠেছে আজকের বাঙালি জাতি। বাঙালির জাগরণে রামমোহন-অক্ষয়দত্ত-ডিরোজিও-বিদ্যাসাগর-মাইকেলের যে অপরিসীম ভূমিকা, প্যারীচাঁদ তার থেকে যোজনদূরে। তথাপি নারীশিক্ষায়, শিক্ষার বৈজ্ঞানিকতায় এবং নারীপুরুষের সমমর্যাদা সংরক্ষণে প্যারীচাঁদ মিত্র অনেক কাজ করেছেন।
আধুনিক বাঙালি নারীর মানস একদিনে গঠিত হয়নি। যুগকে ছাপিয়ে যাওয়া মানুষ যুগেযুগে অল্পই জন্মগ্রহণ করেন। সমাজকে আমূল বদলে দেওয়ার মতো অনন্য প্রতিভাধর না হলেও বাঙালি নারীর বিকাশে প্যারীচাঁদ মিত্রের অবদানকে অস্বীকার করবার সুযোগ নেই।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।।
দ্রষ্টব্যঃ- প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।