“আমি সেই অবহেলা
আমি সেই নতমুখ
নীরবে ফিরে যাওয়া
অভিমান ভেজা চোখ”
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আহমদ ছফার কথা মনে করে এই লাইনগুলো লিখেছেন কি না জানিনা, তবে রুদ্রর এই শব্দমালার সাথে আহমদ ছফাকে আবিষ্কার করা যায় সহজেই। আহমদ ছফা মহৎ বিস্তার এক অবিনাশী নক্ষত্র, যে নক্ষত্র এখনও জ্বলজ্বল করে।
আহমদ ছফা সময়ের চেয়ে অগ্রগামী এক ক্ষণজন্মা বিদ্বানজনের নাম; বাংলাদেশের একজন ‘মেঘে ঢাকা তারা’ তিনি। ছফার নীতি, নৈতিকতায় মুগ্ধ হননি এমন পাঠকের সংখ্যা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আহমদ ছফা বিশ্লেষণে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তিনি এক আহত বিদ্বান নায়ক। প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ-এখন কি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে যিনি নাম, পদবী, পদক চান না, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাননা। অথচ ছফাই চেয়েছেন সকল লোভ, মোহের ঊর্ধে থেকে সত্যনিষ্ঠ হয়ে সাবলিলভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের বিচ্যুতিগুলি গণমানুষের সামনে উপস্থাপন করতে। কিছু মানুষ আছেন যারা মুক্ত মনে মুক্ত দর্শন রচনা করেন। আহমদ ছফা সেই দার্শনিকদের একজন। কেউ তাঁর পাশে না থাকলেও তিনি সত্য বলেছেন, সত্যকে অস্বীকার করে মিথ্যা কথায় বই এর দৃষ্টি ভারী করেননি।
মানুষের জন্য মানুষ, একথাটিই আহমদ ছফা তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে, প্রকাশের পিছনে আহমদ ছফার অবদান অনস্বীকার্য। প্রকাশনায় বই-এর মুখবন্ধ লেখার কাজটিও তিনি ড: আহমদ শরীফকে দিয়ে করে দিয়েছেন। একজন লেখকের সৃষ্টিশীলতায় আর এক লেখকের নান্দনিক সাহচর্য আমাদের সমাজে বিরল ঘটনা। আহমদ ছফা কেবল নিজেই গণমানুষের নায়ক নন; অসংখ্য নতুন নায়ক সৃষ্টিতেও তাঁর অবদান রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবালদের বাড়ী যখন কেড়ে নেয়ার অপচেষ্টা চলছিল, ছফা তখন নিজের গায়ে আগুন লাগাবার হুমকি দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে, পরবর্তী প্রজন্মকে মানতে হবে।
আমরা বর্তমান সময়ে মাঝে মাঝে তরুনদের মধ্যে উন্মাদনা দেখি চে গুয়েভারার ছবি সম্বলিত টি শার্ট পরে রাজাকার বিরোধী আন্দোলন করতে; কিন্তু এসব উন্মাদনা ক্ষণস্থায়ী। তরুণরা আহমদ ছফাকে ধারণ করে নীতি নৈতিকতার প্রাথমিক পাঠ অর্জন করতে পারত বলে আমার ধারণা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনো আন্দোলনে ছাত্রদের কাছে ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত' বইটি দেখতে পেয়ে খানিকটা অবাক হই। হয়ে হয়েও হলো না শেষ, আহমদ ছফার শেষ নেই। বরং শেষের থেকে শুরুর কাজ করতে হবে। শুধু হুমায়ূন আহমেদ নয় বাংলাদেশে বাউল চিত্রশিল্পী এস.এম. সুলতানকে নতুন করে আবিষ্কার করার কাজে ছফার অবদান অনস্বীকার্য। স্বল্প পরিসরে ছফাকে বিশ্লেষণ করা দুরূহ কাজ।
ছফা বিপ্লবী, বিদ্রোহী; না প্রেমী- এ ব্যাপারে অনেক গবেষণার প্রয়োজন। তবে আমার প্রাথমিকলব্ধ অনুসন্ধান থেকে বলতে পারি, আহমদ ছফা বিপ্লবী, বিদ্রোহী। তিনি বিপ্লবী বলে সমাজে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।
বিদ্রোহী এজন্য যে, তিনি সমসাময়িক বিষয়ে তাবেদারদের মুখোশ উন্মোচন করে একাকী সমকালীন বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। প্রেমী এজন্য যে, প্রেমের কাছাকাছি গিয়েও তা অর্জন করে আবার সেখান থেকে বিদায় নিয়েছেন।
আজ ২৮শে জুলাই আহমদ ছফার প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি। আমাদের নিঃশ্বাসে আহমদ ছফা চিরন্তন চিরঞ্জীব।