উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার মধ্যে ১৪টিই প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে সেসব উপজেলার নিচু এলাকার প্রায় ৭ লাখ মানুষ। সড়কে পানি ওঠায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। আটকা পড়েছে কয়েকশ গাড়ি।
কয়েকদিন ধরেই টানা বৃষ্টিতে নাজেহাল চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ। সোমবারই তলিয়েছে বান্দরবানের বিশাল এলাকা। বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চলের সেই পানিই সমতলের দিতে নামছে শঙ্খনদ ও ডলু নদী দিয়ে। এর জেরে প্লাবিত হয়েছে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ ও সাতকানিয়ার প্রায় সব ইউনিয়ন।
চারদিকে থৈ থৈ পানিতে ভাসছে সব। ডুবে আছে ঘর-বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ডুবেছে ফসলের ক্ষেত, পুকুর। ভেসে গেছে গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি। সামান্য যা কিছু পানির কাছ থেকে বাঁচানো গেছে, তা নিয়েই আশ্রয় শিবিরে দুর্ভোগের জীবন।
পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক তলিয়ে যাওয়ায় আটকা পড়ে অসংখ্য যানবাহন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে আটকে থেকে দুর্ভোগে হাজারো যাত্রী।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো.ফখরুজ্জামান জানান, ফটিকছড়ি ছাড়া চট্টগ্রামের সব উপজেলাই প্লাবিত উল্লেখ করে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৪শ টন চাল ও সাড়ে ৬ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে জরুরী উদ্ধারকাজে সেনা ও নৌবাহিনী মোতায়েনের কথা জানিয়েছে আইএসপিআর। দুর্গতদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় বিত্তবানরাও।
সোমবার রাতে বৃষ্টি কম হওয়ায় চট্টগ্রাম মহানগরীর বেশিরভাগ এলাকার পানি নামতে শুরু করেছে। অতিবৃষ্টিতে তৈরি হওয়া জলাবদ্ধতার কারণে গত ৫ দিন ধরেই পানির নিচে চট্টগ্রাম শহর। এতে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরীর বাসিন্দারা। জলাবদ্ধতার কারণে মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মহানগরীর সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আরও দুদিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
বন্দরনগরীতে ৩০ বছরের মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের নতুন রেকর্ড হয়েছে গত রোববার। এছাড়া চলতি মাসে যেখানে বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল ৫৩০ দশমিক ৬ মিলিমিটার সেখানে প্রথম ছয়দিনেই হয়েছে ৫শ ৫০ মিলিমিটারের বেশি। অতিবৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পূর্ণিমার প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত তিনফুট উঁচু জোয়ার।
খাগড়াছড়িতে ভারি বর্ষণের কারণে দীঘিনালার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রাঙামাটির লংগদুর সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। পানিবন্ধী হয়ে পড়েছেন প্রায় ছয় শতাধিক মানুষ। জেলায় ১৩৩ টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
টানা বৃষ্টিতে তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড় ধস ও সড়ক ডুবে গিয়ে সাজেকে আটকা পড়েছেন দেড় শতাধিক পর্যটক। কক্সবাজারের ২০টি গ্রামে পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ। এদিকে উজানের ঢলে ফেনীতে প্লাবিত হয়েছে নতুন বেশ কিছু গ্রাম।
টানা ৬ দিনের বৃষ্টিতে রাঙামাটির বিভিন্ন এলাকায় ২ শতাধিক স্থানে পাহাড়-টিলা ধসে চারশ'র বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খাগড়াছড়িতে পাহাড় ধসে দীঘিনালার সাথে বাঘাইছড়ির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া, মাইনী নদীর পানি বাড়ায় তলিয়ে গেছে বেশ কিছু এলাকা।
সাঙ্গু ও মাতামুহুরি নদীর পানি বাড়ায় বান্দরবান শহর ও নিচু এলাকার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী। জেলার বেশিরভাগ এলাকায় গতকাল থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় জেলার সাথে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
কক্সবাজারে মাতামুহুরী ও বাকখালী নদীর পানি বাড়ায় চকরিয়া ও পেকুয়ার ২০টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ।
চট্টগ্রাম ওয়াসা, পানি ভবন, নগরীর চান্দগাঁও থানার নিচতলা পানিতে তলিয়ে আছে। রোববারের জোয়ার-বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে ডুবে ছিল কালুরঘাটে ফেরি চলাচলের জন্য স্থাপিত পন্টুন। দুই পাড়ের মানুষতে ফেরি পারাপারে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বৃদ্ধ ও শিশু এবং রোগীদের কোলে করে পারাপার করতে দেখা যাচ্ছে। এ সময় রিকশা কিংবা গাড়ি থেকে পানি ছিটকে পড়ে দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে যাত্রীদের।
বাণিজ্যিক এলাকা চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে ভিজে গেছে লাখ লাখ টাকার পণ্য। একই অবস্থা রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকায়ও। রিয়াজউদ্দিন বাজারের শত শত দোকানে পানি ঢুকেছে। টানা তিন দিন পানিতে ডুবে আছে রিয়াজউদ্দিন। দোকানে পানি ঢুকে পড়ার কারণে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোটি কোটি টাকা অন্যদিকে ব্যবসা বাণিজ্যেও স্থবিরতা নেমে এসেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, রিয়াজউদ্দিন বাজারের গোলাম রসুল মার্কেট, আরএস রোড, বাহার লেইন, পশ্চিম বাজার, মশারি গলি, রহমতুন্নেচ্ছা রোড এবং জেবুন্নেচ্ছা রোডে হাঁটু পানি উঠে। এসব রোডে থাকা মার্কেট ও দোকানে পানি ঢুকে যায়। রিয়াজউদ্দিন বাজারের মোবাইল মার্কেটেও পানি ঢুকে যায়।
রিয়াজউদ্দিন বাজারে ব্যবসায়ী আবদুল হামিদ বলেন, টানা তিন দিনের ভারি বর্ষণে রিয়াজউদ্দিন বাজারের শত শত দোকানে পানি ঢুকেছে। আগে যেসব দোকানে পানি ঢোকেনি সেসব দোকানেও এবার পানি ঢুকেছে।
শুক্রবার বন্ধ থাকলেও শনিবার ও বোরবার কোনো ব্যবসা বাণিজ্যই হয়নি। কাপড়ের দোকানে পানি ঢুকে কোটি টাকার কাপড় নষ্ট হয়ে গেছে।
রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির জানান, এ বছর রিয়াজউদ্দিন বাজারে স্মরণকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে পানি উঠেছে। রিয়াজউদ্দিন বাজারের প্রবেশপথে প্রায় কোমর সমান পানি হয়েছে। এখানে ড্রেন বড় করে কালভার্ট বানানো হয়েছে। তারপরও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।
জা্গরণ/পরিবেশ/কেএপি/এমএ