দেশের অর্থনীতিতে আরেকটি গেম চেঞ্জার হতে যাচ্ছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। এই মেগা প্রকল্পের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে এভিয়েশন, পর্যটন, যোগাযোগ, আমদানি-রপ্তানি ও কৃষিতে। বিদেশি বিনিয়োগ, দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানেও পড়বে ইতিবাচক প্রভাব। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে যথাযথ সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, বৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারসহ বিদেশি পর্যটক টানার মতো নানা দর্শনীয় স্থান দেশজুড়ে। কিন্তু যোগাযোগসহ নানা দুর্বলতায় বিদেশি পর্যটক তেমন আসেন না। কর্তৃপক্ষের আশা, নতুন টার্মিনালে আধুনিক সেবা দূর করবে বিদেশিদের আক্ষেপ।
শনিবার উদ্বোধন হবে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, যার আয়তন প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। যাত্রী পরিবহণ সক্ষমতা বছরে সোয়া কোটি। সব মিলিয়ে দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরের আয়তন হবে সোয়া তিন লাখ বর্গমিটার। পরিকল্পনা আছে রানওয়ে বাড়ানোরও।
গবেষণা সংস্থা সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘তৃতীয় টার্মিনালটাকে যদি আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে আমাদের সেবার মানটাও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। কেবল অবকাঠামোর মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে করলে হবে না। কারণ, যারা আসবেন তারা কিন্তু সেই সার্ভিসটা পেতে চাইবেন।’
এই টার্মিনাল চালুর পর বাড়বে ফ্লাইট সংখ্যা ও কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা। আমদানি কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বছরে ৮৪ হাজার টন থেকে বেড়ে হবে পৌনে ৩ লাখ টনে। পাশাপাশি রপ্তানি কার্গো হ্যান্ডেলিং সক্ষমতা বছরে ২ লাখ টন থেকে বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে ৫ লাখ টনে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, ভৌগোলিক দিক থেকে ঢাকার অবস্থান বেশ সুবিধাজনক। অনেকটা দুবাইয়ের মতো। ঢাকাকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাতে যাতায়াত করা যায়, সে সুবিধা নিশ্চিত করতে চায় বেবিচক।
সংস্থাটির চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান বলেন, ‘দুই ঘণ্টার ভেতরে আমাদের সাউথ এশিয়ান দেশগুলো আমরা ট্রাভেল করতে পারি। চার ঘণ্টার মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিকের অনেকগুলো দেশ আমরা পেয়ে যাচ্ছি। ছয় ঘণ্টা হয়ে গেলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আমার আয়ত্বে চলে আসছে। আট ঘণ্টা ফ্লাই করলে আমি ইউরোপ চলে যেতে পারছি। যে পরিমাণ ডায়াসপোরা আমাদের বিদেশে আছে, অনেক সম্ভাবনা এখানে আছে হাব হওয়ার।’
সেবা নিয়ে ব্যবসায়ীদের আক্ষেপ ঘুচার আশা বেবিচকের। কর্মকর্তারা জানান, বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতার কারণে কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী আর নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন না। বিমানবন্দরের বড় পরিসরে বাড়বে সেবামূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বাড়বে কর্মসংস্থানও।
২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় একনেক। শুরুতে এর নির্মাণব্যয় ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা টাকা ধরা হলেও পরে তা আরও ৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়ানো হয়। এতে প্রকল্পের আকার দাঁড়ায় প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকায়। প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে।
প্রকল্পটির নির্মাণব্যয়ের বড় জোগান দিচ্ছে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকা। সংস্থাটি ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। আর বাকি ৫ হাজার ২৫৮ কোটি ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার।
টার্মিনালের মূল ভবনের আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। জাপানি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিমুজি আর কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান স্যামসাং যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
বর্তমানে শাহজালালে যে দুটি টার্মিনাল আছে, সেগুলো বছরে প্রায় ৭০ লাখ যাত্রীকে সেবা দিতে পারে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এ বছরে প্রায় ২ কোটি যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
তৃতীয় টার্মিনালের অ্যাপ্রোন বা পার্কিংয়ে এক সাথে ৩৭টি উড়োজাহাজ রাখার ব্যবস্থা থাকবে। যুক্ত হবে নতুন ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ, ১১টি বডি স্ক্যানার আর ১৬টি লাগেজ বেল্ট। এ ছাড়া থাকবে স্বয়ংক্রিয় ইমিগ্রেশন ব্যবস্থাপনা। গাড়ি পার্কিংয়ে রাখা যাবে এক সাথে প্রায় ১ হাজার ২৩০টি গাড়ি।
জাগরণ/যোগাযোগ/এসএসকে/এমএ/কেএপি