মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলতেন হরহামেশাই, ‘কখনো বাঘের পিঠে চেপো না। পড়ে গেলে বাঘ খেয়ে ফেলবে।’ তার মতন লোকায়ত নেতার এমন উক্তি কেন যেন এখন- মানে গত এক দশক থেকেই মনে পড়ছে। কেন মনে পড়ছে, তা যদি একটু ভাবি অথবা চতুর্দিকে তাকাই, তাহলেই অনুধাবন করব এই চরম সত্যনিষ্ঠ উক্তির মর্মার্থ। অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ তাঁর বর্ষীয়ান জীবনের পোড়খাওয়া অভিজ্ঞতা থেকে যে কথা বলেছেন, ‘তা যেন মনে হচ্ছে, এখনো প্রণিধানযোগ্য।’
রাষ্ট্র এখন বিষম দইরা। আকাশ ঘিরে ফেলছে ঝড়ো লাল মেঘ। বায়ু বইছে মাঝেমধ্যেই। কখন যে বেসামাল ঝড় ওঠে, কে বলতে পারে?
কী ভয়ঙ্কর বাতাস ঝাপটা মারছে, উলট-পালট করে দিচ্ছে দিক থেকে দিগন্তকে। আমরা ঊর্ধ্বশ্বাস নাগরিকরা কেবল হাপিত্যেশ করেই থেমে যাচ্ছি। দেশে কোনো বাস্তবধর্মী রাজনৈতিক চক্র কেন শক্তি সঞ্চয় করতে পারছে না। কেন এমন দুঃসময় এলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে? ক‚লে বসে আমরা কেবলই ভাবছি। কী হবে আমাদের। দেশ যেন বিপন্নতায় ভুগছে বলে মনে হচ্ছে। রাজনীতি কুক্ষিগত, লুটেরা শ্রেণির হাতে ফুঁসে উঠছে অর্থনীতির জলরাশি মাঝে মাঝেই। মনে হয়, কোথা থেকে যেন স্থিরজলে কারা ঢিল মারছে? কেন এমন হচ্ছে। ভাবাচ্ছে আমাদের মতো দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষদের।
কী নির্মম নিষ্ঠুরতাই না শুরু করেছে ব্যবসায়ী-আমদানিকারক, আড়তদার, বিক্রেতা, মহাজনগোষ্ঠীর অভাবিতপূর্ব এমন আচরণ। যেমন ধরুন না পেঁয়াজ। কী বিষম চড়া দামে চড়েছে। লোকে নয় কেবল দেশের অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন, পেঁয়াজ না খেলে কি হয়। তা ঠিক বটে তবে বিদগ্ধজনরা রসিকতা করে বলছেন, সঙ্গে সঙ্গে লবণ, তেল, আটারও নাকি দাম চড়িয়ে দিয়েছে লোভাতুর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। দাম বেড়েছে বলে কি খাদ্যাভ্যাস হঠাৎ পরিবর্তন করা যায়? আর সে বিবেচনায় পেঁয়াজ তো গরিব মানুষের নিত্যকার খাদ্য তালিকার প্রয়োজনীয় বিষয়। একে বাদ দিলে আমরা সবাই খাবার মুখে তুলব কি করে? তাই রসিকতা ছুটল চালের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। তাহলে কি ভাত খাওয়া ছেড়ে দেব? না, তা তো হয় না। তাই আন্দোলন গড়ে ওঠে দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধে। মনে পড়ছে, পাকিস্তান আমলে লবণের দাম হয়েছিল ষোলো (১৬) টাকায় এক সের। তখন গণশিল্পীরা গান বেঁধেছিলেন :
‘ষোলো টাকা সের দরে লবণ খেয়ে
স্বর্গে যাবো গো
(মোরা) না খেয়ে না খেয়ে খালি পেটে পেটে
গাছে গাছে ঝুলে রবো।’
সেদিন দেশে ছিল মুসলিম লীগ সরকারের প্রশাসন। জনগণের আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়েছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বিষয়ে ফয়সালা করতে। তাতে লবণের দাম কমে স্বাভাবিক পর্যায়ে অবশেষে এসেছিল।…কিন্তু আজকে জমানা পাল্টেছে, কে দেবে আমাদের অভয়বাণী। মন্ত্রীরা নানান আশ্বাস, প্রতিশ্রæতি দেন, দোষারোপ করেন ব্যবসায়ীদের ওপর। কিন্তু বিষয়টির সুরাহা করার কোনো পথ দেখাতে পারেন না। ‘পেঁয়াজ বিমানে চড়েছে, এলেই দাম কমবে।’ কিংবা দেশি পেঁয়াজ ওঠার ভরসায় আশাবাদ জোগাচ্ছেন জনে জনে। সরকার ওদের পাত্তাই দেয় না। পেটায় সুযোগ পেলে। মন্ত্রী বুঝি ভ্রমণে ব্যস্ত থাকেন বিপদের সময়। মন্ত্রণালয় সরব হতে সাহস পায় না সিন্ডিকেটের প্রভাবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এক্ষেত্রে যোগ্যতা দেখাতে ব্যর্থ। সরকারও কোনো নির্দেশনা দিয়ে টেকাতে পারছে না, তো করবে কি?
কেবলই সরকারপ্রধানের দিকে তাকিয়ে থাকে সবাই। যদি তাই হয় তাহলে এতবড় মন্ত্রিসভা, এত মন্ত্রী, সিনিয়র মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এমনকি উপমন্ত্রীর কিইবা প্রয়োজন! কী বিপদই না হয়েছে। আজ প্রায় তিন মাস কেটে গেল তবু দ্রব্যমূল্যের সংকট কাটল না। এ দিকে পেঁয়াজ, চাল, লবণ, তেল, আটার দাম চড়ছে। আর কত যে পণ্য তালিকায় যুক্ত হবে, তা কেবল কাগজের রিপোর্টাররাই জানেন। সরকারও জানে না। কারণ যে গোয়েন্দারা এখন খুব ব্যস্ত, তাদের তো কোনো হদিস দেখি না। বাজারের এই অস্থির প্রবাহ ক্রমেই দেশবাসীর নিরন্তর ক্রোধে পরিণত হচ্ছে। একে রোখার কোনো উদ্যোগ হয়তো আছে কিন্তু তার কোনো বাস্তব সাক্ষ্য আমরা জনগণ বুঝতে পারছি না।
এমন কর্মকান্ড কিন্তু ব্যবসায়ী লোভী চক্রের। একে ঠেকিয়ে দিতে হলে দরকার জনগণের রাজনীতি সচেতন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের। পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করে ক্ষমতাবান সরকারকে বাধ্য করতে পারে। অথবা সরকার নিজ উদ্যোগ নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ যদি নিতে পারেন, তবে জনগণও তাদের প্রতি সহানুভ‚তিশীল হবে। কিন্তু এ কী মর্মান্তিক অবস্থা। কোনো সৎ ও সাহসী উদ্যোগ কারো পক্ষ থেকেই যে গৃহীত হচ্ছে না। মাঝে পড়ে আমরা সাধারণ মানুষ ত্রাহি ত্রাহি করছি।
এত গেল দ্রব্যমূল্যের সাতকাহন। অথচ এখন শীতকাল। অগ্রহায়ণ চলছে। নানা ধরনের তরিতরকারি ও শাক-সবজি উঠতে আরম্ভ করেছে। এর দাম এখন কম হওয়ার কথা, অথচ যৎসামান্য হলেও যা ছিল এর দাম আগে এখন তার চাইতে কিছুটা বেড়েছে। অতীতে এমনটি দেখেছি বলে আমার এ দীর্ঘ জীবনে মনে পড়ে না। …এই মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত হলো মাঝখানের পরিবহন ধর্মঘট। পাকিস্তান আমলে হরতাল হলে আমরা বলতাম ‘চাকা বন্ধ’। কিন্তু এখন মোটরের চাকা যখন ঘোরে না তখন ধর্মঘট বা হরতাল বলে না, বলে কর্মবিরতি। ট্রেড ইউনিয়নের কোনো ব্যাকরণে কর্মবিরতিকে ধর্মঘটের পাল্টা শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে জানি না, এবারে তাও শুনলাম।
এই অযাচিত পরিবহন ধর্মঘটের ফলে বিক্রেতারা এরই অজুহাত দেন এবং দাম বাড়ান। যখন-তখন পরিবহন ধর্মঘট করায় শুধু খাদ্যদ্রব্য বাজারে পৌঁছানো ছাড়াও মানুষের যে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয় তা কি কখনো মোটর শ্রমিক ও মালিক বুঝতে পারেন? আবার পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের ‘শক্তিধর’ নেতা হঠাৎ উদয় হয়ে দেখি এই পরিবহন সংকট নিরসন করেন। তিনি অবশ্য বলেন, শ্রমিকরাও তো মানুষ। হ্যাঁ, আমরা তো সেকথা অস্বীকার করি না, কিন্তু তারা কয়েকজন যখন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগের কারণ হন তখন কি আমরা মানুষ মানুষের সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি? যাই হোক না কেন সমাজবদ্ধ মানুষের নানা পেশা থাকে তাই ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা-সংকটেও তারা জর্জরিত।
যারা কোনো বাস্তব কর্মসূচি নিতে পারে না। সরকারের বিরোধিতা করাই কেবল যাদের স্বভাব, তারা রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কেবলই মওকা খোঁজে অথচ নিজেদের শক্তির কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ দেয়ার মতন কোনো কাজ দেখাতে বারবারই ব্যর্থ হচ্ছে। এদের অথর্ব সরকারবিরোধী বলা হয়ে থাকে। এরা আন্দোলনের কথা মুখে মুখে বলে বসে কিন্তু ধারেকাছেও যাওয়ার সাহস আজ পর্যন্ত দেখাতে পারেনি। জনগণও এদের মুখের কথা বুঝতে পেরে এদের প্রতি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করে না। সুতরাং এমনি শূন্যতা যেহেতু কোনো রাষ্ট্রের জন্য অপ্রত্যাশিত, তাই এই অভাব পূরণ করতে নতুন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।