১৯৭১ সাল। বিনত বাবু তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। পরিবারের সঙ্গে থাকতেন সৈয়দপুর শহরের দিনাজপুর রোডের বাড়িতে। শহরটিতে বিহারীরাই সংখ্যায় অধিক ছিল। তারা ছিল পাকিস্তানীদের অনুসারী। ২৫ মার্চ থেকে খানসেনারা শহর থেকে স্বাধীনতাকামীদের ধরে নিয়ে আসত সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে। সে সময় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকদের চিনিয়ে দেওয়ার কাজটি করত বিহারীদেরই একটি অংশ।
৭ জুন ১৯৭১। বিনত বাবুকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় খানরা। এক দিন পরই তার বাবা বালচান্দ আগরওয়ালাকেও নিয়ে আসা হয় সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে তাদের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন।
সৈয়দপুরে তখন বিমানবন্দর নির্মাণের কাজটি করছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ধরে আনা মুক্তিকামী রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও নিরীহ মানুষদের দিয়ে করানো হতো মাটি কাটার ভারী কাজগুলো। কাজের মধ্যে বিনা কারণেই করা হতো বেত্রাঘাত। ১৩ জুন রাত দেড়টা। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিনত বাবুসহ অন্যদের নিয়ে যাওয়া হয় রেলস্টেশনে। সেখানে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এরই মধ্যে জড়ো করা হয় বেশ কিছু পরিবারকে। একটি ট্রেনের দু’টি বগিতে তোলা হয় পুরুষদের। দু’টিতে রাখা হয় মহিলা ও শিশুদের। ট্রেনের অধিকাংশই ছিল বাঙালী হিন্দুধর্মাবলম্বী ও মাড়োয়ারী। স্টেশনে বিনত বাবু দেখা পান তাঁর মা তরদেনী দেবী ও ছোটবোন সাবিত্রীর।
পুরুষরা যেন পালাতে না পারে সে কারণে বগিতে সবাইকেই বিবসন করে রাখা হয়। সকাল সাতটার দিকে ট্রেনটি যাত্রা শুরু করে অজানা গন্তব্যে। বন্ধ করে দেওয়া হয় ট্রেনের দরজা-জানালাগুলো। বগির ভেতর সবাই ভয়ে জড়সড়। কিলো তিনেক চলার পর ট্রেনটি গোলারহাটে এসে থেমে যায়। এর পরই শুরু হয় সেই নারকীয় হত্যার উৎসব।
বিহারী পুলিশ ও বর্বদের পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুক্ত হয় মুখে কাপড় বাঁধা একদল বিহারী। বগি থেকে তারা একে একে নামিয়ে তলোয়ারের আঘাতে কচুকাটা করে একেকজনকে। বেওনেটের খোঁচায় ছিন্নভিন্ন হয় কোলের শিশুদের দেহ। কখনো যুবক, কখনো বৃদ্ধ, কখনো বা শিশুর চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে গোলারহাটের বাতাস।
নারকীয় এ হত্যার দৃশ্য দেখে বগির ভেতর ছটফট করতে থাকেন বিনত বাবু। কয়েকজনের সঙ্গে তিনিও অন্য পাশের জানালা দিয়ে দৌড়ে পালান। পেছন থেকে চলে খানদের গুলিবৃষ্টি। গুলিবিদ্ধ হয়ে আছড়ে পড়েন কয়েকজন। কিন্তু দৈবক্রমে বেঁচে যান বিনত বাবু, রামলাল দাস, তপনকুমার দাসসহ আরও প্রায় ২০ জন।
নিজে বেঁচে গেলেও সেই দিনের গণহত্যায় শহীদ হন বিনত বাবুর মা, বাবা আর বোন। আবেগভরা কণ্ঠে গোলারহাটের গণহত্যার কথা এভাবেই বলছিলেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া সুবত আগরওয়ালা। সৈয়দপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়ে বসে কথা হচ্ছিল তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে। কথা হয় শহীদ রামেশ্বর আগরওয়ালার ছেলে নিজুর সঙ্গেও। গোলারহাটের গণহত্যায় শহীদ হন তাঁদের পরিবারের নয়জন। স্মৃতি হাতড়ে নিজু জানান সে সময়কার কিছু কথা।
৭ এপ্রিল ১৯৭১। সকালের দিকে খানসেনারা হানা দেয় তাঁদের বাড়িতে। ধরে নিয়ে যায় তাঁর বাবা ও দুই ভাই পুরুষোত্তম ও বিমন কুমারকে। ‘তোম লোককো মেজর সাব বোলাতায়ে’। এক হাবিলদারের কণ্ঠ আজও নিজুর কানে বাজে। পরে তাঁদের খোঁজ মেলে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে।
শহীদ রামেশ্বর আগরওয়ালার ছেলে নিজু আগরওয়ালা। ছবি: লেখক
বাবা ও ভাইদের জন্য প্রতিদিন বাড়ি থেকে নাস্তা নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে দিতেন নিজু। গণহত্যার দিন নাশতা হাতে ফিরে আসেন তিনি। তাঁর বাবা ও ভাইদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভারতে। খবর পেয়ে নিজু ছুটে যান স্টেশনে। কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। স্টেশন থেকে গোলারহাটের দিকে ট্রেনটিকে থামতে দেখে নিজুও ছুটে যান । ২০০ গজ দূর দাঁড়িয়ে দেখতে পান নারকীয় সেই হত্যাযজ্ঞটি।নিজু বলেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচার করলেই শুধু হবে না। ১৯৭১ সালে যে সকল পাকিস্তানি সেনারা নীরিহ বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে ছিল, তারও বিচার করতে হবে। পাশাপাশি তিনি ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণার দাবী জানান।
ইতিহাসের খোঁজে আরেকটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায় ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে। কথা হয় হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী মোঃ দরিমান আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে পাকিস্তানী আর্মিদের ক্যাম্প ছিল পীরগঞ্জ হাসপাতালে। এক সকালে তারা হানা দেয় আমাদের বাড়িতে। ধরে নিয়ে যায় আমার বাবা দর্শন আলীকে। বাড়ির দক্ষিণ পাশে এক নির্জন জায়গায় বড় গর্ত খুঁড়তে হবে। তবেই মিলবে তার মুক্তি। এমন প্রতিশ্রুতিতে ধরে আনা হয় জগথা গ্রামের সিনদারু মোহাম্মদ, ইয়াসিন ওরফে অয়াসু মোহাম্মদ ও ইব্রাহীমকেও।
‘শুরু হয় মাটি খোঁড়া। দুপুরের মধ্যেই তৈরী হয়ে যায় বড় একটি গর্ত। কাজ শেষে ছেড়েও দেওয়া হয় সবাইকে। তবুও মনের ভেতর অজানা ভয়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। একে একে সেখানে ধরে আনা হয় মুক্তিকামী বাঙালীদের। সবার হাত পেছনে বাঁধা। পালা করে তাদের গর্তের সামনে দাঁড় করানো হয়। অতঃপর গুলির শব্দ। রাতভর চলে এ হত্যা উৎসব। মানুষের আর্তচিৎকারে ওই রাতে ভারী হয়ে ওঠে জগথা গ্রামের বাতাস
‘ভোর হতেই দেখি রক্তাক্ত মানুষে গর্তটা ভর্তি। দুই শতাধিক লাশ। অধিকাংশ যুবক বয়সী। আশপাশে ছোপ ছোপ রক্ত।’
‘আমি কোদাল চালাই। লাশগুলো ঢাকতে এগিয়ে আসে আব্দুল হামিদও। অচেনা লাশের ভিড়ে মেলে দু’টি চেনামুখ। পয়েন্দা গ্রামের জামাল উদ্দীন ও ভেগদল সরকার। নিজ হাতে মাটিচাপা দিই তাদের। তিন দিন লেগেছিল লাশগুলো মাটিতে ঢাকতে।’ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার ভেতরে জগথা গ্রামটি। ওই গ্রামের ফকীরপাড়া মোড়ের এক পাশে দরিমান আলীর বাড়ি। অন্য পাশে রাস্তার ধারঘেঁষা কলার ক্ষেত। তা পেরোলেই মাঠের এক পাশে বেগুনক্ষেত। অন্য পাশে ধানক্ষেত। দুই খেতের মাঝের আইল বরাবর মেলে নাম না-জানা গাছের জংলা। এ জংলা স্থানটিই শহীদদের গণকবর।
দরিমান আলীকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজ মেলে জগথার গণকবরের। নেই কেনো স্মৃতিচিহ্ন। অবহেলা আর অশ্রদ্ধায় সেখানে পড়ে আছে শহীদদের গণকবরটি
শহীদ জামাল উদ্দীনের ছেলে জালাল উদ্দীন। একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল ১৩ বছর। জানলেন তাঁর বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা। জামাল উদ্দীন ছিলেন পয়েন্দা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি জামাল চৌধুরী নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। সেই গ্রামে বিহারীদের তৎপরতা ছিল বেশী। লুটতরাজ ছাড়াও তারা পাকিস্তানী সেনাদের চিনিয়ে দিত বাঙালীদের বাড়িগুলো।
জগথার গণকবরটি দেখাচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শী দরিমান আলী : ছবি: সালেক খোকন
একবার পয়েন্দা গ্রামে মুক্তিকামী বাঙালীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় বিহারীদের। সে সময় জামাল উদ্দীন মানবতার খাতিরে রক্ষা করেন কয়েকজন বিহারীকে। কিন্তু বেঁচে যাওয়া ওই বিহারীরাই কাল হয়ে আসে তাঁর জীবনে।
২২ এপ্রিল ১৯৭১। ফজরের সময়। পয়েন্দা গ্রামকে ঘিরে ফেলে বিহারী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মসজিদ থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় জামাল উদ্দীনকে। যে বিহারীদের তিনি প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন, তারা তাঁর দিকে আঙুল তাক করে ওই দিন বলেছিল, ‘এ আদমি হামকো মারা হে’। সে সময় বিহারীদের নেতৃত্ব দেন হাতেম আলী, নিজামুদ্দীন, মোঃ ঈশা, আব্দুর রহমান, মজিদসহ কয়েকজন। প্রথমে পীরগঞ্জ সেনা ক্যাম্পে নির্যাতন করা হয় এবং ওই দিন সন্ধ্যায়ই জামাল উদ্দীনকে হত্যা করা হয় জগথায়। একইসঙ্গে হত্যা করা হয় তাঁর ভাই মহির উদ্দীন, রশিদুর রহমান, আব্দুল লতিফ, ভাতিজা নজরুল ইসলাম, মজির উদ্দীনসহ পরিবারের আটজনকে। হত্যা করা হয় বেগুনগাঁও ভাল্লী মসজিদের ঈমামসহ অনেককেই।
জালাল উদ্দীন দুঃখ করে বলেন, যাঁদের রক্তে দেশটা স্বাধীন হল, তাঁদের কথা মনে রাখল না এ জাতি। জামাল উদ্দীনের পাশেই শহীদ ভেগদল রহমানের বাড়ি। তাঁর ছোট ছেলে দরিমান রহমান। কথা হয় তাঁর সঙ্গে।সারা দেশে তখন যুদ্ধ চলছে। চলছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার দোসরদের অত্যাচার। এ সব দেখে ঠিক থাকতে পারে না ভেগদলের বড় ছেলে ফজলুর রহমান। এক রাতে তিনি চলে যান মুক্তিযুদ্ধে।এ খবর পৌঁছে যায় পীরগঞ্জ সেনা ক্যাম্পে। ওই দিন দুপুরেই বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ভেগদলকে। সন্ধ্যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ছেলে ধরা দিলে তবেই তাঁর মুক্তি। পরিবারের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের ছিল না কোনো যোগাযোগ। ফলে ছেলে না আসায় ওই দিন সন্ধ্যায় ভেগদলকে হত্যা করা হয় জগথায়।
কান্নাজড়ানো কণ্ঠে দরিমান রহমান বলেন, ‘যেখানে হত্যা করা হল বাবাকে, সে গণকবরটি সংরক্ষণ করল না স্বাধীন দেশের কোনো সরকার। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে।’
পাশ থেকে এ বিষয়ে জালাল উদ্দীন বলেন, ‘প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি অদ্যাবধি।’
কথা বলেন জালালের বড় ভাই আলাল উদ্দীনও। তাঁর ভাষায়, ‘মুক্তিযুদ্ধে পরিবারের আটজনকে হারিয়েছি। এখন আল্লাহর ওপর বিচার দিয়ে চুপচাপ আছি।’তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে গণকবরের জায়গা কিনে নিয়ে হলেও আমরা চাই এটি সংরক্ষণ করতে।’ পাশাপাশি তিনি মনে করেন ১৯৭১ সালে যে সকল বিহারী পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছিল তাদের বিচার করতে হবে।
যাঁদের আত্মত্যাগে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। আজ এই স্বাধীন দেশে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে তাদের গণকবর ও বদ্ধভূমিগুলো— এ বড়ই লজ্জার, বড়ই কষ্টের। শহীদদের গণকবরগুলো সংরক্ষণ করা না হলে বিবর্ণ হতে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে হবে ১৯৭১ সালের গণহত্যার ঘাতকদের বিচারের।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধ ও আদিবাসী বিষয়ক গবেষক।