আজকের আয়ারল্যান্ড তখন ছিল বৃটিশদের উপনিবেশ। ইংরেজ ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব লর্ড মেকওলে ইংল্যান্ডের ইতিহাস লিখতে গিয়ে একটা মন্তব্যে বলেছিলেন, পৃথিবী জুড়ে অনেক বিখ্যাত, যোগ্য এবং উচ্চাভিলাষী আইরিশের দেখা মিলবে, কিন্তু আয়ারল্যান্ডে তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সারা পৃথিবীতে যদি আইরিশরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেন, নিজ দেশে কেন পারেন না? মেকওলের মনে হয়েছিল ঈর্ষাতুর স্বদেশবাসীই এর জন্য প্রধানত দায়ী। তারা কোন কীর্তিমানতম আইরিশটিকেও হয়তো অকর্মন্য ও অশিক্ষিত আইরিশ বাবু সম্প্রদায় নিজেদের চাইতে হীনতর ভাবতো।
গড় আইরিশদের সম্পর্কে সাধারণ বৃটিশ মনোভঙ্গিতেও এই হীন ধারণার ছাপ ছিল। ইংরেজের চোখে আইরিশ কতটা অযোগ্য, নোংরা আর অলস সেটা লর্ড মেকওলের চোখে ভাষাতেই বলা যাক:
“অন্যদিকে আদিবাসী চাষীকূল ছিল প্রায় বর্বর দশায়। তারা এমন বন্দোবস্তেও খুশি থাকতো যেটা সুখীতর দেশগুলোতে গবাদিপশুর জন্য বরাদ্দ করা পরিস্থিতির চেয়েও খারাপ। ইতিমধ্যেই আলু নামের একটা শেকড় সাধারণ মানুষের খাদ্যে পরিণত হয়েছে, এটা কোন নৈপুণ্য, পরিশ্রম কিংবা পুঁজি ছাড়াই আবাদ করা যায়, আর এটাকে দীর্ঘকাল সংরক্ষণও করা যায় না। এই ভাবে পেট ভরানো মানুষদের কাছ থেকে শ্রমনিষ্ঠা আর ভবিষ্যৎ-ভাবনা আশা করা যায় না। এমনকি ডাবলিনের কয়েক মাইলের মধ্যে পৃথিবীর সবচাইতে উর্বর আর সবুজতম ভূমিতেও পর্যটকরা বিবমিষার সাথে সেই অবর্ণনীয় কুড়েঘরগুলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে দেখতেন কুড়েগুলোর ভেতর থেকে নোংরা আর আর্ধনগ্ন বর্বররা তার দিকে বুনো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।”
লর্ড মেকওলের বিবরণ পড়লে বোঝা যাবে নোংরা অলস কিংবা অযোগ্য স্বপ্নহীন আইরিশের স্বভাবই তার পরিস্থিতির জন্য দায়ী। কিন্তু কেউ যদি ইংলিশ দখলদারিত্বের আগেকার আয়ারল্যান্ডের সাথে দেশটির তুলনা করেন, দেখা যাবে বহু দিক থেকেই আইরিশদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মান মধ্যযুগের মানদণ্ডে ইংল্যান্ডের তুলনায় কোন দিক দিয়েই ন্যূন ছিল না। বরং আইরিশ ক্যাথলিক যাজকদের শিক্ষা ও নৈপুন্যের একটা ইউরোপ জোড়া খ্যাতিই ছিল। বৃটিশদের কবল থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরবর্তী সময়ের দেশটিও শিক্ষার মান ও পরিচ্ছন্নতার জন্য পরিচিত।
পার্থক্যটা গড়ে দেয় ওই পরাধীনতা কিংবা মুক্তি। লর্ড মেকওলে আয়ারল্যান্ডের দুর্দশার প্রধান কারণ হিসেবে না উপস্থাপন করলেও ‘অ্যাবসেন্টি’ পরিচিত অনুপস্থিত জমিদারদের কথাও উল্লেখ করেছেন। এই জমিদাররা প্রধানত ইংরেজ, এবং জমিদারিতে উপার্জিত সবটুকু আয়ই তারা খরচ করতেন লন্ডনের মত বড় বড় শহরগুলোতে। জমির মুনাফা এভাবে জমিদারদের হাত ঘুরে চলে যেতো দেশের বাইরে, পুনরুৎপাদনে আসতো না। বাড়তি উৎপাদন মানে জমিদারের বাড়তি লাভ, কৃষকের জীবনের কিছু না। ফলে জাতীয় চরিত্রেও উৎপাদন বিমুখতা একটা স্থায়ী ভিত্তি পায়। কিন্তু আপাতদৃষ্টে মনে হবে অলস বলেই আইরিশ আলুর মত ফসল চাষ করে, নোংরা থাকে, এবং তার উচ্চতর মানবিক গুনের অভাবেই সে পরাধীন। আলুর দুর্ভিক্ষের সময়টিতে (১৮৪৫-১৮৪৯) লক্ষ লক্ষ আইরিশ স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। আইরিশদের এই দেশত্যাগকেও প্রকাশ্যেই উৎসাহিত করা হয়েছিল দখলদার ইংরেজদের পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যে, কেননা দরিদ্র মানুষের এই দেশত্যাগ দেশটির গড় আর্থিক উন্নতি এনেছে।
২.
স্বাধীনতা আর পরাধীনতার রাজনৈতিক পার্থক্যটা একটা জাতিকে কতটা গভীরে বদলে দিতে পারে, তার একটা বিশাল উদাহরণ গণচীনও বটে। দুটো আফিম যুদ্ধে পর্যুদস্ত, বৃটিশ-জার্মান-মার্কিন-রুশ-জাপানের মত শক্তিগুলোর চাপিয়ে দেয়া নানান রকম দখলদারিত্বের যুদ্ধে দিশেহারা দেশটির নাগরিকদেরও ভাবমূর্তি ছিল ওই ‘আফিমখোর চীনা’, ‘অলস চীনা’ এবং ‘নির্বোধ চীনা’র। অভাবের বিবেচনায় আরও দুর্দশাগ্রস্ত ছিল দেশটি, চির দুর্ভিক্ষের দেশের ভাবমূর্তির অধিকারী ছিল চীন। ভারত ও পাকিস্তান যখন স্বাধীন হয়, তারও দুই বছর পর চীন ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ থেকে মুক্তি পায়। এরপর চীন কত রাতারাতি বদলে গেলো, সেটার বিবরণ পাওয়া যাবে মওলানা ভাসানী আর শেখ মুজিবুর রহমান উভয়ের চীন ভ্রমণের স্মৃতিকথায়। কয়েকটা বড়সড় উদ্ধৃতিই দেয়া যাক:
ক. “(পাকিস্তান) স্বাধীন হবার পর নির্মিত রাস্তা আর ব্রিজগুলো যে কতবার ভাঙ্গল! বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্মিত বাঁধ ভেঙে কত হাজার হাজার একর জমির ফসল নষ্ট হলো, কত লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হলো! চীনে তাকার সময় আমার মনে বার বার একটা প্রশ্ন জেগেছে—এত রাস্তা, ব্রিজ, বাঁধ একবারও ভাঙে না, কিন্তু আমাদের দেশে এত ঘন ঘন ভাঙ্গনের কারণ কি? এর জন্য দায়ী কি? আমাদের অদৃষ্ট? না দুর্নীতিতন্ত্র?” (মাও সে-তুঙ এর দেশে, মওলানা ভাসানী, সংহতি প্রকাশনী)
খ. “শুধু স্টেশনে বা রেলগাড়িতেই নয়, এই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা চীনের সর্বত্রই চোখে পড়ে। এত বড় একটা দেশ, এতগুলো মানুষ, অথচ সামাজিক জঞ্জাল ঝেটিয়ে বিদায় করার সঙ্গে সঙ্গে ঘর-দোর, কল-কারখানা, সর্বসাধারণের ব্যবহার্য যানবাহন প্রভৃতি সব জায়গা থেকে আবর্জনাকেও নতুন চীনের মানুষেরা ঝেড়ে পুছে সব সাফ করে ফেলেছে অতি সহজে। এর পাশাপাশি যখন আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে পরিচালিত ‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান’ এর ব্যর্থতার কথা ভাবি, তখনই মনে হয় সামাজিক জঞ্জালকে দূর করতে না পারলে অন্যান্য জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাওয়া কত কঠিন। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ উদযাপন উপলক্ষে পথের জঞ্জাল একবার সাফ করলেও দেখতে দেখতেই তা আবার স্তূপীকৃত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হবার অব্যবহিত পরে নতুন ক্ষমতাসীন একদল ওপরওয়ালা হুকুম জারি করে এবং শাস্তির ভয় দেখিয়ে যে পরিচ্ছন্নতা কার্যকরী করতে চেয়েছিলেন, তাদের সেই আত্মম্ভরী মূঢ় প্রচেষ্টার সুফল কিছুই ফলেনি; শুধু কিছু সংখ্যক নিরীহ গৃহস্থের কপালে জুটেছিল নিরতিশয় লাঞ্ছনা।“(মাও সে-তুঙ এর দেশে, মওলানা ভাসানী, সংহতি প্রকাশনী)
গ. “আমি ট্রেনের ভিতর ঘুরতে শুরু করলাম। ট্রেনে এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত যাওয়া যায়। নতুন চীনের লোকের চেহারা দেখতে চাই। ‘আফিং’ খাওয়া জাত যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। আফিং এখন আর কেউ খায় না, আর ঝিমিয়েও পড়ে না। মনে হল, এ এক নতুন দেশ, নতুন মানুষ। এদের মনে আশা এসেছে, হতাশা আর নাই। তারা আজ স্বাধীন হয়েছে, দেশের সকল কিছুই আজ জনগণের। ভাবলাম, তিন বছরের মধ্যে এত বড় আলোড়ন এরা কি করে করল!” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, ইউপিএল)
ঘ. “কালোবাজার বন্ধ। জনগণ কাজ পাচ্ছে, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ হয়ে গেছে। কঠোর হাতে নতুন সরকার এইসব দমন করেছে। যে কোন জিনিস কিনতে যান, এক দাম।... আমি একাকী বাজারে সামান্য জিনিসপত্র কিনেছি। দাম লেখা আছে। কোনো দরকষাকষি নাই। রিকশায় চড়েছি। কথা বুঝতে পারি না। চীনা টাকা যাকে ‘ইয়েন’ বলে, হাতে করে বলেছি, ‘ভাড়া নিয়ে যাও কত নেবা।‘ তবে যা ভাড়া তাই নিয়েছে, একটুও বেশি নেয় নাই। ” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, ইউপিএল)
চারটি উদ্ধৃতিতেই দেখা যাবে উভয়েই চীনকে বারবার তুলনা করছেন পাকিস্তানের সাথে, মিলিয়ে দেখছেন পাকিস্তানেরও দুই বছর পর মুক্ত হওয়া একটা দেশ কত দ্রুত নিজেকে বদলে ফেলেছে। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু চীনের এই রূপান্তরটাকে আদৌ উপলদ্ধি করতে পারেননি, তার ধারণা ছিল প্রযুক্তিগত নৈপুন্যে চীন ভারতের চাইতে বহুগুন পিছিয়ে আছে। এটা আইয়ুব খানও উপলদ্ধি করতে পারেননি, আজকে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে আইয়ুব খান নেহেরুকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন একত্রে চীনের মোকাবেলা করার। আত্মবিশ্বাসী নেহেরু সেটা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু জনতার মাঝে থাকা এই দুইজন গণমানুষের নেতা চীন সফরে গিয়ে ঠিকই এই রূপান্তরকে হৃদয় দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন। এই দুটি গ্রন্থেই যে বিপুলভাবে বদলে যাওয়া জনগোষ্ঠীর পরিচয় মেলে, তার সারসংক্ষেপ হয়তো এভাবেই হতে পারে:
“চীন দেশের লোকের মধ্যে দেখলাম নতুন চেতনা। চোখে মুখে নতুন ভাব ও নতুন আশায় ভরা। তারা আজ গর্বিত যে তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক।“(অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, ইউপিএল)
অথচ সত্যেন বোস তার স্মৃতিকথায় ১৯৪৪ সালে চীনা এক রসায়নবিদের সাথে সাক্ষাতের পর চীনের জন্য করুণা অনুভব করেছিলেন, কেননা সত্যেন বোসের ছাত্র অধ্যাপক কালীপদ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে জৈব-রসায়নের গবেষণা কেন্দ্রে নতুন যেসব গবষণা চালাচ্ছেন, তা ‘স্বচক্ষে’ দেখতে এবং শিখতে সেই চীনা রসায়নবিদ ঢাকা পর্যন্ত এসেছিলেন। ওই চীন-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সেই স্মৃতিচারণ করে ভারতের পিছিয়ে পড়া নিয়ে বোসের আত্মউপলদ্ধি: 'শত্রুকে অশ্রদ্ধা করলেই বিজয়লক্ষী অঙ্কগত হন না। আমাদের ২৪ বছরের অগ্রগতির ছবির সঙ্গে চীনের তুলনা করে গর্ব করার মত কিছু খুঁজে পাই না। এর জন্য ভারতের বিজ্ঞানীরা কতটুকু দায়ী?'
বিজ্ঞানীরা দায়ী নন, সেটা সত্যেন বোস বারবার বলছেন। বরং বিজ্ঞানকে, সাধারণভাবে জ্ঞানকে জনগণের সংখ্যাল্পের মাঝে আটকে রেখে দেয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝেই এই বিষচক্রটা কার্যকর থাকে। আজীবন সত্যেন বোস কাজ করেছেন জ্ঞানচর্চাকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার গুরুত্ব নিয়ে, এবং দেখিয়েছেন জাপান হোক, চীন হোক, পৃথিবীর কোন জাতি মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার আমূল বন্দোবস্ত ছাড়া এই রকম আমূল রুপান্তর ঘটাতে পারেনি।
৩.
‘তখনই মনে হয় সামাজিক জঞ্জালকে দূর করতে না পারলে অন্যান্য জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাওয়া কত কঠিন’ কিংবা ‘গর্বিত স্বাধীন দেশের নাগরিক!’-- মুক্তির কিংবা সত্যিকারের স্বাধীনতার এই কষ্টিপাথরগুলো দিয়েই আসলে যাচাই করতে হয় রাজনৈতিক স্বাধীনতা কতদূর মুক্তির বার্তা বয়ে আনতে পেরেছে। কতদূর তা সকলের হয়ে উঠতে পেরেছে। আজকে আমরা একদিকে পদ্মাসেতুর অধিকারী (যার কারিগরি ও নির্মাণগত দিকটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে ওই চীনের করায়ত্তে), কিন্তু বৈশ্বিক জ্ঞান উৎপাদনে আমাদের অবস্থান তলানিতে, ঠিক এমনি সংবাদও একই সময়ে দৈনিকে প্রকাশিত হচ্ছে। শুরুতে বলা আয়ারল্যান্ডের সাথে মিলিয়ে বলতে পারি, সারা দুনিয়া ব্যাপী কীর্তিমান বাঙালী/বাংলাদেশীরও তো অভাব নেই। অন্যদিকে অভাব নেই দুনিয়া জুড়ে যে কোন কোনায় ঠাঁই পেতে মরিয়া বাঙালী তরুণেরও। কিছু একটা ঘটছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়, আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যেটা নিজের দেশে তরুণের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে দিচ্ছে না, দিচ্ছে না তার জীবনেরও বিকাশ ঘটাতে। যা কিছু সম্পদ আমরা চারদিকে দেখি, তা মূলত তৈরি করেন আমাদের দেশের কৃষক, পোষাক শ্রমিক আর প্রবাসী শ্রমিকরা। আর সেই সম্পদই জনগণের জীবনের বিকাশে খরচ না হয়ে অবিশ্বাস্য বিপুল পাচার, অপচয় আর লুণ্ঠনের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিক, সুস্থ পথে জীবনের বিকাশ ঘটবে, এটা এই দেশের মানুষ কি আজ আর বিশ্বাস করে? সেই আশাবাদ কোথাও অক্ষুণ্ণ আছে?
আমরা তো আয়ারল্যান্ডের মত পরাধীন রাষ্ট্র নই। তাহলে এই কথাটা কেন আমাদের জন্যও একভাবে সত্যে পরিণত হয়েছে? কেন অপরিচ্ছন্নতা, অশিক্ষা, অপচিকিৎসা এবং সর্বোপরি অগণতন্ত্র আমাদের নিয়তি হবে?
১৯৭১ সালের পর কয়েক বছর পর্যন্ত এই তর্কটা চলেছিল, যুদ্ধটা মুক্তির না স্বাধীনতার। মুক্তি আর স্বাধীনতার আলাদা আলাদা তাৎপর্য যে আছে, সেটা আজ আমরা এক প্রকার ভুলতেই বসেছি। একটাকে ভাবা হয়েছে কেবল ‘ওদের’ বদলে ‘আমাদের’ শাসনের সংকীর্ণ অর্থে, আরেকটাকে ভাবা হয়েছে প্রতিটা নাগরিকের জীবনের বিকাশকে, জাতির সম্ভাবনার বিকাশকে। আজকে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, বেড়েছে গড় পুষ্টির মান। কিন্তু যদি বৈশ্বিক হার বৃদ্ধির সাথে তুলনা করি, বিমর্ষ হয়ে যেতে হয়। যুদ্ধপরিস্থিতিতে আটকে থাকা দেশগুলোকে বাদ দিলে প্রায় সকল সূচকেই আমরা ক্রমশঃ অন্যদের চাইতে পিছিয়ে পড়ছি। জ্ঞানচর্চা হোক, খেলাধূলা হোক, সর্বত্র এই কথা সত্য।
পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্য লড়াই করেছিলেন চীনের অগ্রগতি দেখে বিস্মিত এই দুইজন ব্যক্তিত্বই। কিন্তু কেন স্বাধীনতার কয়েক বছরেই পাকিস্তান দোজখখানায় পরিণত হলো, তার একটা ব্যাখ্যা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেই মিলবে:
“অন্যদিকে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ড ভেঙে দিতে হুকুম দিলেন। জহিরুদ্দীন, মির্জা গোলাম হাফিজ এবং আরও কয়েকজন আপত্তি করল। কারণ, পাকিস্তানের জন্য এবং পাকিস্তান হওয়ার পরে এই প্রতিষ্ঠান রীতিমত কাজ করে গিয়েছে। রেলগাড়িতে কর্মচারির অভাব, আইনশৃঙ্খলা ও সকল বিষয়েই এই প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে। হাজার হাজার ন্যাশনাল গার্ড ছিল। এদের দেশের কাজে না লাগিয়ে ভেঙে দেয়ার হুকুমে কর্মীদের মধ্যে একটটা ভীষণ বিদ্বেষ ভাব দেখা গেল। ন্যাশনাল গার্ডের নেতারা সম্মেলন করে । ঠিক করলেন তারা প্রতিষ্ঠান চালাবেন। জহিরুদ্দীনকে সালারে-সুবা করা হল। জহিরুদ্দীন ঢাকায় আসার কিছুদিন পরেই তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হল। মিস্টার মোহাজের, যিনি বাংলার ন্যাশনাল গার্ডের সালারে-সুবা ছিলেন তাকে নাজিমুদ্দীন সাহেব কি বললেন জানি না। তিনি খবরের কাগজে ঘোষণা করলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে, ন্যাশনাল গার্ডের আর দরকার নাই। এই রকম একটা সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান জাতীয় সরকার দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার না করে দেশেরই ক্ষতি করলেন। এই সংগঠনের কর্মীরা যথেষ্ট ত্যাগস্বীকার করেছেন, অনেক নেতার চেয়েও বেশি। অনেকে আমাদের বললেন, এদের দিয়ে যে কাজ করাব, টাকা পাব কোথায়? এরা টাকা চায় নাই। সামান্য খরচ পেয়েই বৎসরের পর বৎসর কাজ করতে পারত... ন্যাশনাল গার্ডদের বেতনও দেয়া হত না। ন্যাশনাল গার্ড ও মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে যে প্রেরণা ছিল পাকিস্তানকে গড়বার জন্য তা ব্যবহার করতে নেতারা পারলেন না।”
চীনের ওই বিকাশের শুরুর পর্বটিতে স্বেচ্ছাসেবী রাজনৈতিক কর্মীদের রাষ্ট্র বিপুল হারে ব্যবহার করেছিল বলেই পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী দখলদার বিরোধী যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষ পাড়ি দিয়েও জনগণের মাঝে আশাবাদ তৈরি করতে পেরেছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানের বিপর্যয়ের প্রধানতম লক্ষণটিকে মিলবে স্বেচ্ছাসেবী রাজনৈতিক কর্মীদের বাদ দিয়ে, তাদের তৈরি হওয়া সংগঠনকে ভেঙে দিয়ে আমলাতন্ত্রকে ফেরত আনার ঘটনার মধ্যে। এটা করা হয়েছিল, কেননা মুসলিম লীগের, তাদের দুর্নীতি ও লুণ্ঠন সম্ভব হতো না জনগণের ক্ষমতায়ন করলে। স্থানীয় পর্যায়ের তদারকির দায়িত্ব, পুনর্গঠনের দায়িত্ব তাদের হাতে থাকলে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধও এমন আশাবাদ তৈরি করেছিল। সেক্টর কমান্ডর কাজী নুরুজ্জামান তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে স্মৃতিচারণায় বলেছেন, এই মুক্তিযোদ্ধারা রাজি ছিল কয়েক বছর বিনা বেতনে দেশের কাজ করতে, কেননা তারা তো যুদ্ধে এসেছিল দেশের জন্য প্রাণ দিতেই, কয়েক বছরের স্বেচ্ছাসেবা তাদের জন্য কি আর এমন। তারা বিদ্যালয়ে শিক্ষকের কাজ করতে চায়, তারা নিরক্ষরতা দূর করার অভিযানে নামতে চায়, তারা বিধ্বস্ত দেশের সড়ক-সেতু মেরামত করতে চায়, তারা কৃষিতে সহায়তা করতে চায়। তারা আইন-শৃঙ্খলা আর জননিরাপত্তার কাজ করতে চায়। শুরুতেই যেটা বলেছিলাম, কোন বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দের পরিমান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার এই স্পৃহার মূল্যমান নির্ধারণ করা যায় না। সেটা কিন্তু হলো না, বরং সাবেকি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটাই পুনর্বহাল রইলো। জাতীয় পুনর্গঠনে যুক্ত না করে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার কথা এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোস্তাপ নিয়েই বারংবার বলেছেন।
বহিঃশত্রুর হাত থেকে স্বাধীনতা আমাদের নিশ্চয়ই হয়েছে। বহু রকম অগ্রগতির মাঝে তার চিহ্নগুলো আমরা দেখি। কিন্তু এমনকি পদ্মাসেতুর মত উল্লেখযোগ্য একটি সেতুর আমরা মালিক হবার পরও, এই দেশের অধিকাংশ আমলা, অধিকাংশ চিকিৎসক, অধিকাংশ প্রকৌশলী, অধিকাংশ সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, এবং অতিঅবশ্যই অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা এদেশকে তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ বাসস্থান হিসেবে গণ্য করেন? ব্যক্তিগতভাবে কেউ দেশত্যাগ করতেই পারেন, সেটা সকল দেশেই ঘটে। কিন্তু একটা দেশের গোটা উচ্চবিত্ত সমাজের বড় অংশটিই যখন নিজের দেশকে বাসযোগ্য মনে করেন না, তখন সেই দেশের সকল কার্যকলাপ, সকল ‘উন্নয়ন প্রকল্প’, সকল পরিকল্পনাই আসলে নির্ধারিত হয় এই পরবাসী ক্ষমতাবানদের স্বার্থের রূপরেখা অনুযায়ী।
কোন উচ্চতম স্থাপনাই আসলে উন্নয়নের স্মারক নয়। বরং দেশের প্রতিটা দেশপ্রেমিক মানুষের মনে যখন এই ভরসা আনতে পারবে দেশ, যখন “চোখে মুখে নতুন ভাব ও নতুন আশায় ভরা’ থাকবে, তখনই কেবল বলা যাবে মুক্তির সূচনা হয়েছে।
লেখক: রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন।