করোনা মহামারি নিয়ে বর্তমান বিশ্ব এক ভয়াবহ সময় পার করছে। এ ছাড়া নাগরিক জীবনের ক্রমবর্ধমান বিলাসিতার চাহিদা, ভোগসর্বস্ব মূল্যবোধের অগ্রাধিকার এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণ আমাদের জীবনকে খণ্ডিত করে তুলেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক চিহ্নিতকরণ বিভক্তি। ফলে বিশ্বাসের আড়ালে লালিত হচ্ছে অবিশ্বাস, দয়ার আড়ালে নিষ্ঠুরতা এবং মুখোশের আড়ালের মুখ। ভোগসত্তা, স্বার্থপরতা বা আত্মকেন্দ্রিকতা প্রায় উলঙ্গ হয়ে উঠেছে। মানুষ-মানুষকে, বন্ধু-বন্ধুকে, প্রেমিক-প্রেমিকাকে, ভাই-ভাইকে হত্যা করার পথ আবিষ্কৃত হয়েছে। আবার ধর্মের ভেক ধারণ করে শয়তানি-খেলা খেলারও অবকাশ ঘটেছে সমাজে। এসবই আত্মদৈন্যের পরিচায়ক। বিশ্বব্যাপী এমন অনিশ্চিত এক সংকটের মধ্যেও বাঙালি জাতির সামনে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়েছে। যেদিন বাঙালির মহান মুক্তিদাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং স্বীয় প্রজ্ঞাবলে কালক্রমে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারি। প্রত্যেক বাঙালিই জানেন, মুজিব মানেই বাঙালির মুক্তির পবিত্র ঘোষণা। পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে সত্তরের দশকে বাঙালি জাতিসত্তার ক্রমোত্তরণে, প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনে এবং পরিণামে একটি মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র নির্মাণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই ছিলেন ইতিহাসের পুরোধা পুরুষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যতিরেকে বাঙালির জাগরণ ও স্পন্দন ছিল কল্পনাতীত। অসীম সাহসী বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির মুক্তি ও সমৃদ্ধির জন্য নিবেদিতপ্রাণ বঙ্গবন্ধু, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু, রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু-বাঙালির রক্তকণিকায়, প্রতি নিশ্বাসে, প্রতি পদক্ষেপে নানান ব্যঞ্জনায় মিশে আছেন। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বাঙালির অবিনশ্বর আলো’ চিহ্নিত করার মধ্যে কোনো অতিশয়োক্তি নেই।
বঙ্গবন্ধু এমনই একজন শক্তিধর নেতা, যার নেতৃত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার আপামর জনতা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলির সামনে বুক পেতে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি বরাভয় দিয়েছিলেন বলেই ভয় পায়নি বাঙালি জাতি। ২৩ বছরের পাকিস্তানি শোষণ-জুলুম-নির্যাতন-নিষ্পেষণের জিঞ্জির ভাঙতে এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য যার কথাই হয়ে উঠেছিল আইন। যে কারণে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর নাম অবিচ্ছিন্ন। বিষয়গত ও বিষয়ীগত যে মূল্যায়নই করি না কেন মুজিবের বৈশিষ্ট্য, তাঁর কাজের স্টাইল, দূরদৃষ্টি এবং সাহস—কীভাবে একটি পিছিয়ে পড়া জাতির ভাগ্য গড়ে দিতে পেরেছিল, তা বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে সজ্জিত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ এবং ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠে এর সাক্ষ্য মেলে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিসহ বিশ্বের কোটি মানুষের হৃদয়ে জেগে আছেন স্বীয় ধী-শক্তি এবং জাদুকরি নেতৃত্বের দক্ষতায়। যে নেতৃত্বের পরশ পাথর বুলিয়ে তিনি বিরূপ পরিস্থিতিকে নিজের করায়ত্বে এনেছেন। এই দক্ষতা দেখতে পাওয়া যায়, উইনস্টন চার্চিল, জর্জ বার্নার্ড শ’, রবীন্দ্রনাথ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখের মধ্যে। যাঁরা তাদের জাদুকরি ক্ষমতা ব্যবহার করে জনতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে সক্ষম হন, তাঁরা চলনে বলনে, বচনে-ভাষণে প্রচুর রসের উপাদান সন্নিবেশ করেন। রসবোধ থেকেই প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের মতো জরুরি ও অসাধারণ গুণের সূচনা হয়। বঙ্গবন্ধু ভাষণে এবং আড্ডায় প্রচুর রসের উপাদান রাখতেন বলেই মানুষের মনের গভীরে তাঁর কথাগুলো দাগ কেটে যেত। অনেক ক্ষেত্রে তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতেও বক্তব্যের মধ্যে বৃদ্ধিবৃত্তিক এলিমেন্ট ব্যবহার করতেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর দেশ গঠনে মনোনিবেশ করেন। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সংক্ষেপে তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সবাই পায় হীরার খনি, সোনার খনি আর আমি পেলাম চোরের খনি।’ প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু ছোট্ট এই বাক্যে যুদ্ধকালীন লুণ্ঠনের শব্দচিত্র উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন সার্থকতার সঙ্গে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের প্রতিটি ঘটনা এবং পরিপার্শ্বকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং সেই অনুযায়ী তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতেন। যে কারণে তাঁর জীবনের প্রতিটি ঘটনা কোনো না কোনো কারণে উল্লেখযোগ্য। একবার এক কৃষক বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। নিচতলার সিকিউরিটি তাকে কিছুতেই যেতে দিতে চাইছে না। শেষমেশ কৃষক ওপরের তলায় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া বিশ টাকা থেকে দশ টাকা নিচের গার্ডকে দিয়ে চলে যান। কথাটি বঙ্গবন্ধু জানার পর সখেদে বলেছিলেন, ‘যে দেশে দুইতলা থেকে নিচতলায় যেতে বিশ টাকা দশ টাকা হয়ে যায়, সে দেশে উন্নয়ন কঠিন।’ স্বাধীনতার পর এক বক্তব্যে তিনি ভুট্টোকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘ভুট্টো সাপ এখন দাঁড়াস হয়ে গেছে।’ বলা বাহুল্য বঙ্গবন্ধুর এমন রসিকতাময় বাক্য শ্রোতার মনের গভীরে অতি সহজেই ঢুকে যায়।
বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বারবার শাসকদের রোষানলে পড়েছেন। ফলে তাঁকে কারা প্রকোষ্ঠে বন্দি থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। তথ্য অনুযায়ী, জাতির পিতা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারা ভোগ করেন। বিশ্বের খুব কমসংখ্যক নেতার জীবনেই এমনটি ঘটেছে বোধ করি। তবে কারাগারে বন্দি থাকলে বঙ্গবন্ধুর রসিকতা এতটুকু কমেনি। সেলের ডেফিনেশন প্রসঙ্গে একবার ঠাট্টার ছলে তিনি বলেছিলেন, ‘জেলের মধ্যে জেল তাকেই বলে সেল।’ শেখ মুজিব কারাজীবনে যেবার দীর্ঘ মেয়াদে আটক ছিলেন, সেবার তাঁকে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে গোপালগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হলো। গোপালগঞ্জ থেকে যাবেন মাদারীপুর। রাতে গোপালগঞ্জ থানায় তাঁকে রাতযাপন করতে হলো। থানার এক কামরায় ঘটাং ঘটাং তীব্র আওয়াজে চলছিল ওয়্যারলেস মেশিন। অন্য কামরায় মুজিবের শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু মশার জ্বালায় ঘুমানো সম্ভব নয়। সেই রাতে তিনি পাহারায় থাকা পুলিশ সদস্যকে বললেন, ‘গোপালগঞ্জের মশা নামকরা। একটু সুযোগ পেলেই আর রক্ষা নেই।’ গোপালগঞ্জ থেকে মাদারীপুর যাওয়ার সময় সিন্ধিয়াঘাটে ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের ডাকবাংলোতে রাত যাপন করছেন বঙ্গবন্ধু। তিন নদীর মোহনায় এবং তিন নদীর পাড়ে অবস্থিত এ ডাকবাংলোর বারান্দায় বসে শেখ মুজিব অনেক সময় ধরে নদীতে নৌকার আনাগোনা লক্ষ করছেন। সেদিন ছিল পূর্ণিমা রাত। তিনি হঠাৎ করেই পাহারারত পুলিশদের বললেন, ‘আমার জন্য চিন্তা করবেন না। ঘুমিয়ে থাকেন। আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিলেও যাব না।’ এ কথা শুনে কর্তব্যরত সবাই হেসে বলেছিলেন, আমরা তা জানি।
শুধু দেশেই নয়, বিদেশে গিয়েও বঙ্গবন্ধু সুযোগ পেলেই এমন রসিকতায় মেতে উঠতেন। ১৯৫৭ সালে সফরসঙ্গী নিয়ে মুজিব গেলেন চীন সফরে। চীন যাওয়ার আগে হংকং ছুঁয়ে গেলেন তাঁরা। কিন্তু হংকংয়ের বাজার ঘুরে মুজিবের মনে এলো বিরক্তি। তিনি হংকংয়ের অবস্থা দেখে বললেন, ‘হংকংয়ের নাম হওয়া উচিত ছিল ঠগিবাজি শহর। রাস্তায় হাঁটবেন পকেটে হাত দিয়ে, না হলে পকেট খালি। পরে নয়াচীন দেখে মুজিব এত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে সেখান থেকেই দ্বিতীয় বিপ্লবের বীজ নিয়ে আসেন মাথায় করে। এ সময় তিনি দেখলেন, চীনে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই, হাঙ্গামা নেই। যে যার কাজের মাধ্যমে দেশ গঠনে অবদান রাখছে। এই চীন দেখে মুজিবের সেন্স অব হিউমার জাগ্রত হয়ে গেছে যেন। তিনি খুশিতে বলে উঠলেন, ‘আফিং খাওয়া জাত যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। আফিং এখন আর কেউ খায় না, ঝিমিয়েও পড়ে না।’
পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর বিচার করছে। তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারও কথা বলাতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমন সময় সাংবাদিক ফয়েজ গিয়েছিলেন আদালতে সংবাদ কাভার করতে। স্নেহভাজন ফয়েজকে দেখে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফয়েজ কেমন আছিস?’ কিন্তু নিষেধাজ্ঞার ভয়ে ফয়েজ উত্তর দেওয়া দূরে থাক চোখ তুলেও তাকানোর সাহস করেনি। এতে মুজিব বিচারকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘এ দেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলেই থাকতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর আপদ-বিপদ-মুসিবত ছিল। তবে তারা তাঁর তিনজন অতি স্নেহভাজন সাংবাদিক। সাংবাদিক ফয়েজের নাম স্নেহভরে তিনি রেখেছিলেন আপদ, এ বি এম মুসা ছিলেন বিপদ আর আব্দুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন মুসিবদ। এদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর স্নেহ ছিল ফল্গুধারার মতো।
১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী সফরে গিয়েছিলেন চাঁদপর। দুপুরে আহারের সময় রুই মাছের মাথাটা খন্দকার মোশতাকের পাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুই তো সব সময় আমার মাথা খাস, নে এবার এই রুই মাছের মাথাটা খা।’ এই খন্দকার মোশতাকই পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর সত্যিকারের প্রাণ সংহারকারী হয়েছিলেন। প্রশ্ন জাগে, রসিকতার ছলে দৈব কি বঙ্গবন্ধুকে কোনোভাবে ভবিষ্যৎ জানিয়ে দিয়েছিল? যাহোক, বঙ্গবন্ধু যে তাঁর কর্মের মাধ্যমে বাঙালির আত্ম-উন্নয়ন ও দেশের সমৃদ্ধির জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, তা অস্বীকারের সুযোগ নেই। মূলত বঙ্গবন্ধুর জাদুকরি নেতৃত্বের ভিত্তি আর নেপথ্যে ছিল তাঁর সাহস, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সততা এবং সর্বোপরি সঠিক স্থানে সঠিক কথাটি উচ্চারণ করতে পারার অনন্য গুণ। এই গুণই বঙ্গবন্ধুকে করে তুলেছিল প্রজ্ঞাবান। তিনি হয়ে উঠেছিলেন জনতার মুজিব ভাই, বাঙালির অনিঃশেষ আলোর ফল্গুধারা। বাঙালির ভাগ্য এতটাই সুপ্রসন্ন যে শেখ মুজিবের মতো মহান নেতা বাংলায় জন্ম নিয়েছিলেন। তাই কবি জীবনানন্দ দাশের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলা যায়, ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে বিনত শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক