ইসলামি মৌলবাদী সংগঠন ও জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর প্রধান টার্গেট নারী। তারা যখনই কোনো দেশে ক্ষমতার স্বাদ পায় তখনই তারা নারীর উপর বিধিনিষেধ জারি করে, নারীদের ঘরের বাইরে বেরুতে নিষেধ করে। কোনো প্রয়োজনে নারীকে বাইরে বেরুতে হলে সঙ্গে পুরুষ অভিভাবক থাকতে হবে; মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়; মেয়েদের স্কুলে তালা ঝুলিয়ে দেয়; কট্টর পর্দা প্রথা আরোপ করে; ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি নারীর জন্য হারাম ঘোষণা করে। যেমন, সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাবর্তন করায় তালেবানরা বিভিন্ন অঞ্চলের দখল নিচ্ছে। দখল নিয়ে প্রথমেই তারা নারীর উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ ও ফতোয়া জারি করছে, মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দিচ্ছে।
১৯২১ সালে বাদশাহ আমানুল্লাহ খান কাবুলে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। মোল্লারা তখনও নারী শিক্ষার ব্যাপারে ঘোর আপত্তি জানায়। বাদশাহ তাতে কর্ণপাত না করে আরো পাঁচটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। নারীদের পর্দা প্রথায় শিথিলতা আনেন। এ কাজে বাদশাহর স্ত্রী রানী সোরাইয়া তারজি তাঁকে উৎসাহিত করেন। মোল্লারা মেয়েদের স্কুল বন্ধ করার জন্য বিক্ষোভে নেমে যায় এবং তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার দাবি করে। আমানুল্লাহ খান তাতে রাজি না হওয়ায় গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হন এবং ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন (১৪ জানুয়ারি, ১৯২৯)। ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো তাদের সে চিন্তা থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি।
নারীর উপর বিধি নিষেধ আরোপ করতে পারলেই যেন ইসলাম কায়েম হয়ে গেল, রাষ্ট্র ইসলামি হয়ে গেল। মানুষের বড় শত্রু হল অজ্ঞতা ও দারিদ্র্য। অজ্ঞতা দূর করতে দরকার শিক্ষা। দারিদ্র্য দূর করতে দরকার উৎপাদন। উৎপাদনের জন্য দরকার শ্রম। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ নারী। অর্ধেক মানুষকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রেখে কি অজ্ঞতা দূর করা সম্ভব? উৎপাদনের অর্ধেক শ্রমিককে চার দেয়ালে অবরুদ্ধ রেখে কি দেশের উন্নয়ন সম্ভব? নারীকে অজ্ঞতার অন্ধকারে রেখে তার কাছ থেকে কি আলোকিত সন্তান আশা করা যায়? আশা করা যায় না বলেই ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিব (Give me an educated mother, I will give you an educated nation)। আলোকিত জাতি গড়তে হলে আলোকিত নারী দরকার। আলোকিত নারী পেতে চাইলে তাকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। আধুনিক শিক্ষার জন্য দরকার আধুনিক উপকরণ, মুক্ত জীবন, দরকার নারী স্বাধীনতা। অথচ মৌলবাদীরা নারী স্বাধীনতার ঘোরবিরোধী। তারা নারীকে চার দেয়ালে বন্দি করে রাখতে চায়। নারী অসূর্যস্পর্শা থাকতে পারলে আরও ভালো হয়। তাদের দৃষ্টিতে নারী হলো সন্তান উৎপাদনের খামার, নারীর কর্মক্ষেত্র রান্নাঘর- এর বাইরে যাওয়ার নারীর কী দরকার? তারা ভুলে যায়, নারীও একজন মানুষ, তারও যে আবেগ-অনুভূতি আছে, শখ-আহলাদ আছে। সেও স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়, উপার্জন করতে চায়। তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কি মানবাধিকার লংঘন নয়?
যারা ইসলামকে শ্রেষ্ঠ বলেন, ইসলামের পূর্ব যুগকে অন্ধকার যুগ বা আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ বলেন- সে যুগেও তো নারীদের উপর এত বিধিনিষেধ ছিল না। বরং নারীরা ছিলেন মুক্ত, স্বাধীন। তার উদাহরণ বিবি খাদিজা রাঃ। বিবি খাদিজা সে আমলেও লেখাপড়া জানতেন, আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্য করতেন। এমন কি হযরত মুহাম্মদ সঃ ছিলেন তাঁর ব্যবসায়িক কাজের কর্মচারী। সে যুগে নারী স্বাধীনতা না থাকলে, এটা কী করে সম্ভব হল? আবার বলা হয়, সে যুগে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। হযরত মুহাম্মদ সঃ প্রথম নারীদেরকে পিতা-মাতার সম্পত্তিতে অর্ধেক উত্তরাধিকারী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। তৎকালীন সমাজ, ধর্ম যেখানে নারীদেরকে কোনো মালিকানা দিচ্ছে না, সেখানে রাসুলুল্লাহ সঃ অর্ধেক দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস রাসুলুল্লাহ সঃ এ যুগে আবির্ভূত হলে নারীদেরকে পুরুষের সমান অধিকার দিতেন, নারী পুরুষে কোনো ভেদ রাখতেন না। তাছাড়া, যেসব ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র নারীদেরকে সম্পত্তিতে বিন্দুমাত্র উত্তরাধিকারী হওয়ার সুযোগ দেয়নি, আজ তারা সমান অধিকার দিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা নারীদেরকে সমান অধিকার দিয়েছে আগেই। হিন্দু ধর্মে নারীদের উত্তরাধিকারী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারপরেও পৃথিবীর বৃহত্তম হিন্দু রাষ্ট্র ভারত (অবশ্য সাংবিধানিকভাবে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র) সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়ার ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছে। তাহলে এ ক্ষেত্রে ইসলাম কেন পিছিয়ে থাকবে? অন্য ধর্মগুলো যখন নারীদের কিছুই দেয়নি, তখন ইসলাম অর্ধেক দিয়েছে। আজ অন্য ধর্মগুলো নারীদের পূর্ণমাত্রায় উত্তরাধিকার দিতে পারলে ইসলাম কেন পারবে না? ইসলাম তো পিছিয়ে পড়া ধর্ম নয়, ইসলাম হচ্ছে অগ্রগামী ধর্ম।
ইসলাম ধর্মে তো নারীদের নিরাপত্তা দেয়ার কথা আছে। অথচ ইসলাম কায়েমের নামে নারীদের অপহরণ করা, গনিমতের মাল হিসেবে ট্রিট করা ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর রুটিন ওয়ার্ক হয়েছে। বিশেষ করে, নাইজেরিয়ার বোকো হারাম এ কাজ প্রায় করে থাকে। তারা স্কুল আক্রমণ করে শত শত বালিকাদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে আইএসও এসব থেকে বিরত থাকেনি। তালেবানরা আফগানিস্তানের যেসব এলাকার দখল নিচ্ছে সেসব এলাকার ১৫ বছর উর্ধ্ব বয়সী মেয়েদের এবং ৪৫ বছরের নিচের বিধবা নারীদের তালিকা করছেন তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্যে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সৈয়দ আহমদ বেরেলভি (১৭৮৬-১৮৩১) এর নেতৃত্বে ওহাবিরা যখন শিখ ও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে করতে ক্লান্ত তখন ইমাম সৈয়দ আহমদ এক ফতোয়া জারি করেন- তা হলো, যেসব আফগান উপজাতির যুবতী মেয়েদের ১২ দিনের মধ্যে বিয়ে না হবে তারা জিহাদিদের সম্পত্তিতে পরিণত হবে (William Hunter, The Indian Musalmans, p. 10)। এসব বিয়ে ব্যবস্থা করা হলো জিহাদি যোদ্ধাদের মনোরঞ্জনের জন্য। কে, কোন ধর্মের তারও কোনো বাছবিচার নেই। বিয়ের পর পাকিস্তানের ওয়ারিস্তানে নিয়ে গিয়ে ননমুসলিম মেয়েদের ধর্মান্তরিত করে মুসলমান করা হবে। তালেবান জিহাদিদের ভয়ে আফগান পিতামাতারা তাদের কন্যাদের নিয়ে আতঙ্কে আছেন।
আবার মৌলবাদীরা ব্যভিচারের নামে নারীদের শাস্তি দিতে উৎসুক হয়ে থাকেন। অথচ ইসলামে ব্যভিচারকে যেমন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, তেমনি তার বিচার করাকেও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এ জন্য ইসলামে ব্যভিচারের বিচারের ক্ষেত্রে চারজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী থাকার কথা বলা হয়েছে (সুরা নিসা ৪ : ১৫)। অথচ ইসলামে অন্যান্য অভিযোগের বিচারের ক্ষেত্রে দুইজন সাক্ষীর কথা বলা হয়েছে। (সুরা বাকারা ২ : ২৮২)। অপবাদ আরোপ করে তার সপক্ষে চার জন সাক্ষী হাজির করতে না পারার জন্য এবং মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারীর জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে ৮০ বেত্রাঘাত। ভবিষ্যতে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না। (সুরা নূর ২৪ : ৪)। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, চারজন সাক্ষীর বিধান কেন? ব্যভিচার তো হয় গোপনে, চারজন সাক্ষীর সামনে কি কেউ ব্যভিচার করে বা করা যায়? মূলত চারজন সাক্ষীর বিধান রাখা হয়েছে এসব বিষয়কে নিরুৎসাহিত করার জন্য। কিন্তু মোল্লারা অতি উৎসাহে এসব বিষয় খুঁজে বেড়ায়। তবে ব্যভিচারের জন্য ভুল স্বীকার করে তওবা করলে তাদের (শাস্তি দেয়া) থেকে সরে দাঁড়াও। (সুরা নিসা ৪ : ১৬)।
দেশে কত অন্যায়-অবিচার, ঘুষ-দুর্নীতি, খুন-ধর্ষণ-মুক্তিপণ অহরহ বিরাজমান- তা নিয়ে মোল্লাদের মাথা ব্যথা নেই। তাদের মাথা ব্যথা নারী, দাঁড়ি, পর্দা, যৌনাচার নিয়ে। দেশকে কিভাবে এগিয়ে নিতে হবে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হবে, বেকারত্ব দূর করতে হবে, মানুষের জীবনমান উন্নত করতে হবে, এসব ব্যাপারে তাদের মাথা ব্যথা নেই, পরিকল্পনা নেই। মাথা ব্যথা আছে কিভাবে বোমা ফোটাবে, অস্ত্র সংগ্রহ, সরবরাহ, ব্যবহার করবে তা নিয়ে। এরা দেশকে অস্থিতিশীলতা ও গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। একটা স্থিতিশীল পরিবেশ, জ্ঞান গবেষণা, পড়াশোনা ব্যতীত দেশ কি সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারে? পারে না। আর পারে না বলেই পৃথিবীতে ২০০ কোটি মুসলমান কিছুই করতে পারে না। অথচ দুই কোটি ইহুদি বিশ্ব নাচিয়ে বেড়ায়।
রাসুল সঃ এর উপহার পৃথিবীর প্রথম সংবিধান মদিনা সনদ। সেখানে কি শরিয়া আইন, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার কোনো অপশন ছিল? তালেবানরা আফগানিস্তানে শরিয়া আইন চালু করতে চায়। তারা যে অঞ্চল দখলে নিচ্ছে সে অঞ্চলেই শরিয়া আইন চালু করছে। এ যুগে কি শরিয়া আইন সম্ভব? এখন এককভাবে কোনো রাষ্ট্র কি স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকতে পারে বা ভালোভাবে টিকতে পারে? বাঁচার মত বাঁচতে চাইলে বহির্বিশ্বের সহযোগিতা দরকার, ব্যবসায়িক লেনদেন দরকার। শরিয়া আইন চালু করলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি তাকে স্বীকৃতি দিবে? তার সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করবে? এমনিতেই আফগানিস্তান একটি পশ্চাৎপদ দেশ, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত একটি দেশ। তালেবানরা হয়ত আফগানিস্তানের ক্ষমতা নিতে পারবে, শরিয়া আইন জারি করতে পারবে, নারীদের ঘরে অবরুদ্ধ করে রাখতে পারবে। কিন্তু তারা দেশের কোনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারবে না। দেশের উন্নয়ন, মঙ্গল নির্ভর করে নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার উপর। নারী পুরুষের সম্মিলিত শ্রম ও প্রচেষ্টায় ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, জাপানের এত উন্নয়ন।