একটি ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে বিভেদ নেই; জাত-ধর্ম-বর্ণের বালাই নেই; উঁচু-নিচু, নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। আর সেটি হলো দুর্নীতি। দুর্নীতিতে ধার্মিক-অধার্মিকের পার্থক্য নেই; হিন্দু-মুসলমান বলে কথা নেই; দাড়ি-টুপি-টিকি-লুঙ্গি-প্যান্ট-শার্টে আলাদা নেই; কেরানি-সচিব-আমলা-পুলিশ, বিচারক-আইনজীবী, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যক্ষ-ভিসি, ব্যবসায়ী-ঠিকাদার সবাই এক। দুর্নীতিতে আপস নেই, আছে প্রতিযোগিতা। কে কত বেশি দুর্নীতি করতে পারে, কে কত দ্রুত ধনী হতে পারে? যে দুর্নীতি করতে পারে না বা যার দুর্নীতি করার সুযোগ নেই, সে সমাজে অপাংক্তেয়, অবহেলিত। যে চাকরিতে ঘুষ নেই তার কাছে লোকে মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। বলে- ওই চাকরিতে উপরি কামাই নেই। সমলেবেলের, সমবেতনের চাকরির মধ্যে মানুষ পছন্দ করে ঘুষের চাকরিকে এবং তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে চায়। দুর্নীতি যখন নীতি হয়ে যায় তখন তাকে মাৎস্যন্যায় ব্যতীত কী বলা যায়? কার কাছে কী চাব, কার কাছে কী প্রতিকার পাব?
শিক্ষিত মানুষ দুর্নীতিপরায়ণ। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি অফিস দুর্নীতির একেকটি আখড়া। ভূমি অফিস বলেন, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস বলেন, থানা-কোর্ট-কাচারি, গ্যাস-বিদ্যুৎ, সড়ক-জনপথ, যেখানে যাবেন সেখানেই হয়রানি, দুর্নীতির ফাঁদ। শিক্ষিত মানুষ যে কত নিচু, কত দুর্নীতিপরায়ণ হতে পারেন তা কোনো সরকারি অফিসে না গেলে বোঝা যায় না। সংবিধানে লেখা আছে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণকে সেবা করার জন্য রাষ্ট্র বেতনভুক্ত কর্মচারী নিযুক্ত করেছেন। কিন্ত কর্মচারীরা জনগণের সেবা করেন না; বরং তারা জনগণের সেবা গ্রহণ করেন। জনগণ তাদেরকে সেবা করতে বাধ্য হয়। কেননা, যারা প্রজাতন্ত্রের চাকর, বাস্তবে তারা হচ্ছেন জনগণের প্রভু। তারা জনগণকে স্যার বলবে কি, উল্টো জনগণকে তারা স্যার বলতে বাধ্য করেন।
২৬ মার্চ ১৯৭৫ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শিক্ষিত সমাজের উদ্দেশে বলেন, ‘শিক্ষিতদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন। আমি এই যে দুর্নীতির কথা বললাম, তা কারা করে? আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্ল্যাক মার্কেটিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান দেয়, হোর্ড করে কারা? এই আমরা যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই রয়েছেন ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে, আত্মশুদ্ধি করতে হবে। দুর্নীতিবাজরা এই শতকরা ৫ জনের মধ্যেই রয়েছেন, এর বাইরে নয়।'
এখন দেশে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেড়েছে, দুর্নীতিবাজদের সংখ্যাও বেড়েছে। দুর্নীতি শিক্ষিত লোকদের নিকট থেকে অশিক্ষিত, কম শিক্ষিত লোকদের নিকট, শহর থেকে গ্রামে পৌঁছে গেছে। আগে গ্রাম্য সালিশে ন্যায় বিচার পাওয়া যেত। এখন তা কল্পনাতীত। গ্রাম্য মাতুব্বররা টাকা ছাড়া সালিশ করেন না। টাকা নেই যার বিচার নেই তার। দুর্বলের কোনো জায়গা নেই, আশ্রয় নেই। পুঁজিবাদে সব কিছুই অর্থের কাছে জিম্মি।
দর্শনতত্ত্বে প্রাচীনকালে এরিস্টটল, আধুনিককালে কার্ল মার্কস দুই মহান দিক পাল। এরিস্টটল বলেছেন, ‘Man is by nature political animal.’ আর কার্ল মার্কস বলেছেন, ‘Man is obviously economic animal.’ মার্কসের মতে, ‘মানুষ অর্থকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।’ অর্থের জন্যই রাজনীতি, অর্থের জন্যই ধর্ম, অর্থের জন্যই সবকিছু। অর্থের ভিত্তিতেই সমাজে মানুষের সামাজিক অবস্থান নির্ণীত হয়। তাই ধর-মার-কাট যে যেভাবে পারে অর্থ উপার্জনে উঠে পড়ে লেগেছে। ন্যায়-নীতির বালাই নেই। এক সময় ধার্মিকরা এ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ছিল, এখন তারাও পিছিয়ে নেই। সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাদের একাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন পরিলক্ষিত হয়। বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমদ মানিকের নেতৃত্বে এক বেসরকারি গণতদন্ত কমিশন গঠিত হয়। তারা ১০১ জন ধার্মিক আলেমের হিসাব নিকাশ তদন্ত করে দুদকে জমা দেন। এতে আলেমরা ক্ষিপ্ত হয়ে গণতদন্ত কমিশনকে ইসলাম বিরোধী, মুরতাদ, নাস্তিক হিসেবে অভিহিত করেন। দুর্নীতি না করলে হিসাব দিতে বা হিসাব দেখাতে সমস্যা কোথায় তা বোধগম্য নয়। দুর্নীতি না করলে তো সাহস থাকার কথা, প্রকাশ্যে হিসাব দেয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার কথা। তা না করে হিসাব লুকোচুরি করতে নানা ফন্দি ফিকিরের আশ্রয় নেয়া হয়। সুশীল সমাজ নুরুল হুদা নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতির তদন্ত করতে দুদককে, রাষ্ট্রপতিকে আহবান জানাল, চিঠি দিল। কিন্ত তদন্ত হলো না। নির্বাচন কমিশনাররা যদি সৎ হয়ে থাকেন, তাহলে তদন্ত মোকাবিলা করতে তাদের বাঁধা কোথায়?
এ প্রসঙ্গে রবার্ট ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের উদাহরণ না দিলেই নয়। রবার্ট ক্লাইভ ব্রিটিশ জাতির জন্য কিনা করেছেন। তিনি ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে, ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে নবাব মির কাসিমকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। তিনি ১৭৬৫ সালে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে এলাহাবাদ চুক্তি করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার জমির মালিকানা তুলে দিয়েছেন। তিনি হয়তো দুর্নীতি করে কিছু পয়সা কামিয়েছিলেন। এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে শুরু হয় তার বিচার। তখন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বিচারকার্য পরিচালনা করত। দীর্ঘদিন ধরে বিচার চলতে থাকলে রবার্ট ক্লাইভ ক্ষোভে দুঃখে আত্মহত্যা করেন। ব্রিটিশের প্রতি তাঁর ক্ষোভের কারণও ছিল। তিনি ব্রিটিশকে দিয়েছেন সাম্রাজ্য, অর্থ, মর্যাদা, সেই ব্রিটিশই তাঁকে করেছে অপমান, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেছে এবং তার বিচার করেছে। অবাক করার বিষয় হলো, ভারতবর্ষ থেকে কেউ তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশের কাছে অভিযোগ করেনি, বিচারও চায়নি। কেননা, সেসময় এদেশের কেউ ইংরেজি ভাষা জানত না, এদেশের কারো পক্ষে লন্ডনে যাওয়াও ছিল কল্পনাতীত। আবার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ দেশের কারোর যোগোযোগও ছিল না। ক্লাইভের বাড়ি করা, বাজার করার সামর্থ দেখে ব্রিটিশদের মনে সন্দেহ জাগে তিনি এত টাকা কোথায় পান? শুরু হয় তদন্ত, শুরু হয় বিচার। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল। দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধেও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিচার চলছিল। পার্লামেন্টের দীর্ঘ শুনানিতে তিনিও সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন।
লর্ড ক্লাইভ বা ওয়ারেন হিস্টিংস দুর্নীতি করেছে স্বদেশে নয়, বিদেশে। তারা বিদেশ থেকে টাকা স্বদেশে নিয়েছেন, স্বদেশকে সমৃদ্ধ করেছেন। তারপরেও ব্রিটিশরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করেন এবং বিচার করেন। ব্রিটিশের আইনের শাসন দেখলে অবাক হতে হয়। আর আমার দেশের মানুষ অবাধে দুর্নীতি করে, ঘুষ খেয়ে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয় কিন্ত তার তদন্ত হয় না, বিচার তো দূরের কথা। তদন্তের দাবি করা হয়, তদন্তের জন্য মানববন্ধন করা হয়, তারপরেও তদন্ত হয় না। বাংলাদেশের আইনসভায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো আলোচনা হয় না। কারণ, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দুর্নীতি মজ্জাগত, দুর্নীতিই তাদের নীতি। মানুষ দুর্নীতিবাজদের পছন্দ করে, ভালোবাসে, সম্মান করে। দুর্নীতিবাজকে তারা বাপের বেটা বলে অভিনন্দিত করেন আর বলেন- তিনি খাইতে পারেন এবং খাওয়াতেও পারেন। সুতরাং, ভোট তাকেই দিবেন। কোনো সৎ মানুষকে কেউ ভোট দেন না। সৎ মানুষ মারা গেলে তার জানাজা নামাজ বা অন্ত্যেস্টিক্রিয়ায় মানুষের তেমন সমাগম হয় না। আর অসৎ দুর্নীতিবাজ মারা গেলে তার জানাজায় হাজার হাজার মানুষ পিপীলিকার মতো ছুটে যায়। আদালতের দ্বারা দণ্ডপ্রাপ্ত হলে তো কথাই নেই। তার জানাজায় ঢল নামে।
ফরাসি বিপ্লবের নায়ক রোবসপিয়ার বলেছিলেন, “সমাজ যখন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন সভ্যতা বলতে কিছু থাকে না।” মাঝেমধ্যে ভাবি, বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি কেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন না? আবার ভাবি, সবাই যেখানে দুর্নীতিগ্রস্ত সেখানে তিনি কাকে নিয়ে এ যুদ্ধ করবেন? বঙ্গবন্ধুও এ দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজকে আঘাত করতে চেয়েছিলেন। কিন্ত সে আঘাত হানার পূর্বে তাঁকেই আঘাত করে শেষ করে দেয়া হয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর তৈলদান প্রবন্ধে বলেছেন, “বাঙ্গালীর বল নাই, বিক্রম নাই, বিদ্যাও নাই, বুদ্ধিও নাই। সুতরাং বাঙ্গালীর একমাত্র ভরসা তৈল। এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর মনও ফেরে।” কিন্ত এখন দুর্নীতিই একমাত্র ভরসা। এখন সব হয় টাকায়। টাকায় চাকাও ঘোরে, মনও ফেরে। যে সমাজ জ্ঞান ও প্রেমের চেয়ে অর্থ ও ক্ষমতাকে বড় করে দেখে, সে সমাজ বর্বর সমাজ।
লেখক : সমাজ বিশ্লেষক ও গবেষক।
দ্রষ্টব্যঃ প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।