কৃষ্ণনগরের রাজসভায় সকলেই উপস্থিত; কিন্তু মহারাজ তখনও আসিয়া পৌঁছান নাই। কিছুক্ষণ সভাসদদের মধ্যে গল্পসল্প চলিল, কুশল বিনিময়েও গেল কিছু সময়। মন্ত্রীকে দেখা গেল অতিশয় বিনীত এবং মধুরভাষ্যে সকলকে মুগ্ধ করিয়া চলিতেছে। সভাসদবৃন্দের একজন একটু তীর্যক কণ্ঠে মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিল,
— দেখেছেন, দেখেছেন মন্ত্রীমশাই, এখনো গোপালের কোনো পাত্তাই নেই। মহারাজ উপস্থিত থাকলেও সে দেরি করে আর আজ যদি সে কোনোভাবে খবর পায় যে মহারাজ এখনো দরবারেই এসে পৌঁছাননি, তাহলে তো সে ঘুমিয়ে দিন পার করে দেবে।
মন্ত্রী(কোমল কণ্ঠে)— না, না, ওরকম করে বোলো না, গোপাল একটু আলসে এবং পেটুক বটে; কিন্তু ওর মনটা বড় ভালো আর সবার জন্য ওর একটা বিশেষ দুর্বলতা আছে। বিশেষ করে মহারাজ-মহারানী আর কৃষ্ণনগরের ব্যাপারে ও খুবই দুর্বল। দেরি হলেও সে ঠিকই আসবে, দেখে নিও—
রাজকবি— এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে—মন্ত্রীমশাইয়ের কী হলো আজ! তিনি যে আজ তীর ধনুকের বদলে ফুলের মালা সাজাচ্ছেন।
মন্ত্রী— এভাবে বলছো কেন কবি! আমি তো তোমাদের সবাইকে অনেক অনেক ভালোবাসি। মহারাজের পরে আমি তো তোমাদের সব আশা-ভরসার মানুষ, বলো, ঠিক কিনা।
সেনাপতি— তা ঠিক মন্ত্রীমশাই, তবে আপনার যদি ওই, ইয়ে কী বলে যেন, কমিশন, মানে বখরার ব্যাপারটা ঠিক থাকে আর যদি দেওয়া-থোওয়ার ব্যাপারে নিজের মোটা ভাগটায় কোনো কমতি না থাকে তাহলে মন্ত্রীমশাই খুবই চিন্তাভাবনা করেন আমাদের সবার ব্যাপারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মন্ত্রী— কী বললে? কী বললে সেনাপতি! আমি কি কেবল নিজের স্বার্থ দেখি, তোমাদের স্বার্থ দেখি না! দেখো সেনাপতি, আমি এসব নিয়ে তোমার সঙ্গে তর্কাতর্কি করব না। তোমার অস্ত্রশস্ত্র আছে, সৈন্যসামন্তও আছে, গায়ে শক্তি আছে। কাজেই তুমি যা বলবে তা আমাকে সহ্য করতে হবে। তবে একটা কথা তো তোমাকে মানতে হবে যে, দেশ চালাতে গায়ের শক্তি বড় নয়, বুদ্ধি থাকতে হবে, তাই না। যাক বাদ দাও ওসব কথা! এখন তো বেশ চিন্তা হচ্ছে। মহারাজ তো কখনো এত দেরি করেন না!
রাজকবি— তাই তো, খুবই চিন্তার বিষয়—
রাজবৈদ্য— হ্যাঁ, চিন্তারই তো বিষয়। মহারাজের আবার কি শরীর-টরির খারাপ হলো? আমি তো আগের দিনই খেয়াল করেছিলাম মহারাজের চেহারার মধ্যে কেমন অসুস্থ অসুস্থ ভাব। আমি একবার ভেবেছিলাম, একটা পাঁচন-টাচন বানিয়ে দরবারে এনে মহারাজকে সেবন করিয়ে দিই, তা হলে মহারাজ আবার ফুরফুরে হয়ে উঠবেন।
রাজজ্যোতিষী— কি বৈদ্যমশাই, আপনার ওই পাঁচন খাওয়ানোর আগে একটা বিষয় তো নিশ্চিত হতেই হবে যে, এখন মহারাজের শনির অবস্থানটা কোথায়, রাহু এবং চন্দ্রের জায়গাটা যদি স্থান পরিবর্তন করে ফেলে তাহলে মহারাজের কঠিন কোনো বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা তৈরি হবে অচিরেই।
রাজপণ্ডিত— যস্মিন বিপদাশ্য নৈব পলায়নং
মন্ত্রী (বিরক্ত হইয়া)— আহ্পণ্ডিত, রাখো তো তোমার অং বং চং! এখন মহারাজের খবরটা আগে জানা দরকার। তিনি অসুস্থ কি না কিংবা কোথাও গেলেন কি না, এসব না জানলে রাজ্যটা চলবে কী করে! মন্ত্রী হিসেবে আমাকে তো এসব দেখতেই হবে।
(স্বগতোক্তি) বিরাট কোনো অঘটন যদি ঘটেই যায় তখন আর আমাকে পায় কে? ওই নির্বাচন-টির্বাচনের তখন কোনো দরকারই হবে না। আর তারপর এদের সবক’টাকে রাজ্য থেকে বের করে দেবো। কৃষ্ণচন্দ্র, গোপাল, বিজ্ঞানী, এদের সবাইকে শূলে চড়িয়ে তারপর আমি হবো কৃষ্ণনগরের মহারাজ—তখন আমাকেও সবাই ডাকবে মহারাজ গবুচন্দ্র বলে। হে, হে, কী মজা।
তারপর মন্ত্রী চেহারায় বিমর্ষভাব আনিয়া বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলিতে থাকিল—
: সত্যিই এখন খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। মহারাজের কোনো খবরই পাচ্ছি না, কিন্তু এভাবে তো চুপচাপ বসেও থাকা যায় না। আমরা রাজসভার কাজ শুরু করি, রাজ্য তো চালাতে হবে, প্রজাদের যেন কোনো অসুবিধা না হয় রাজধর্ম পালন করা তো তাই বলে।—
ঠিক এই সময়ই রাজদরবারে গোপাল প্রবেশ করিল। মন্ত্রীর শেষ বাক্য শুনিয়া সে বলিল—
গোপাল— মন্ত্রীমশাই যথার্থ বলেছেন, প্রজাদের মঙ্গলচিন্তাই রাজধর্ম। আর মন্ত্রীধর্ম হলো রাজা যে মঙ্গলচিন্তা করেন সেগুলো বাস্তবায়ন করা।—
মন্ত্রীর ললাটে এবার চিন্তার কুঞ্চন সুস্পষ্ট হইল। গোপাল যেমন ঠোঁটকাটা, কখন যে কী বলিয়া বসে কে জানে! কিন্তু গোপাল অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করিল,
— আমার দেরি হয়েছে এ কথা ঠিক মন্ত্রীমশাই, তবে আমি একটা বিশেষ সংবাদ নিয়ে এসেছি আজ। আমি জানি যে, আপনারা বেশ উদগ্রীব হয়েই আছেন। আমি কিন্তু বাসা থেকে আসিনি—এসেছি মহারাজের প্রাসাদ থেকে আর এখন সেই বিশেষ বার্তাটি আপনাদের জানাতে চাই।
(সকলে সমস্বরে)— কী সেটা?
গোপাল— বুঝতে পারছি না, কীভাবে কথাটা বলব! কথাটা, মানে এই বার্তাটা বলতে গিয়ে একদিকে খুব ভয় করছে, আবার একটু একটু আনন্দও লাগছে, গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না এই—এই—এই—
মন্ত্রী— কী এই—এই—এই করছো গোপাল! তুমি খোলা মনে সাহস করে বলো, কী সেই বিশেষ সংবাদ?
গোপাল— কৃষ্ণনগরের অত্যন্ত প্রিয় মানুষ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র জানিয়েছেন যে, নানাবিধ অনিবার্য কারণে তিনি বেশ কিছুদিনের জন্য রাজকর্ম সম্পাদন করবেন না।
সকলে আবার সমস্বরে— সে কি! তা কী করে সম্ভব!
রাজকবি— এ কি সঠিক কাজ?
মহারাজ। মহারাজ।
রাজজ্যোতিষী— গণনা করে করে যা পেয়েছিলাম দেখছি পুরোটাই ঠিক ঠিক মিলে গেছে। বলেছিলাম শনি আর রাহু একসঙ্গে বৃহস্পতিকে যেভাবে তাড়া করছে, তাতে তো মহারাজের প্রাণসংশয় হওয়ার কথা।
মন্ত্রী— গোপাল, এবার বলো তোমার আনন্দ বোধ হচ্ছে কেন?
গোপাল— মুর্শিদাবাদের নবাব এবং দিল্লির বাদশাহ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আপাতত একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কৃষ্ণনগর পরিচালনার দায়িত্ব নেবে আর সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করবেন মন্ত্রী মহাশয়।
গোপালের এই বার্তা পরিবেশন করার সঙ্গে সঙ্গে রাজদরবারের অধিকাংশই হাহাকার করিয়া উঠিল আর মন্ত্রী উল্লাস সম্বরণ না করিতে পারিয়া লাফাইতে শুরু করিল। মুহূর্তের মধ্যে দরবার জুড়িয়া হুলস্থুল শুরু হইল। সেনাপতি কটিবন্ধে রক্ষিত তলোয়ারের বাঁট শক্ত করিয়া ধরিল, রাজপণ্ডিত মন্ত্রীর পদ স্পর্শ করিয়া শাস্ত্রবাক্য আওড়াইতে থাকিল, রাজকবি মূর্ছা গেল।
এক কোনায় গোপাল ভাঁড় সমস্ত পরিস্থিতি অবলোকন করিতে থাকিল, তাহার শান্ত মুখে দুর্বোধ্য হাসির রেখা!
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ এবং প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা