রাত পুরোপুরি পোহাইতে পারিল না অমনি মন্ত্রীর দরজায় মুহুর্মুহু করাঘাত। ধড়ফড় করিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিল মন্ত্রী গবুচন্দ্র। ঘুম ভাঙিয়া গেল মন্ত্রীপত্নীরও। মন্ত্রী উঠিয়া দরজা খোলার উপক্রম করিতেই মন্ত্রীপত্নী টানিয়া ধরিয়া বলিল—না, না। তুমি দরজা খুলতে যেও না। কে না কে এসেছে, জানাশোনা নেই। তোমাকে যদি কেউ কিছু করে!
মন্ত্রী—(একটু থতমত খাইয়া) কি-কি-কিন্তু, আমাকে কেন? আমি কার কী ক্ষতি করলাম!
মন্ত্রীপত্নী—তা আমি কী করে বলব!
মন্ত্রী—তাহলে কি আমি চুপ করে থাকব? তুমি বরং একটু উঁকিঝুঁকি মেরে দেখো, কে এত সকালে উৎপাত করছে।
—আচ্ছা, দেখছি তুমি চুপ করে থাকো। (উচ্চৈঃস্বরে)—কে? দরজা ধাক্কাচ্ছে কে এই ভোরবেলা।
কোনো প্রকার সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। মন্ত্রী একটু চিন্তিত হইয়া বলিল—কে হতে পারে বলো তো বউ। এখন আর কোনো শব্দও শুনছি না, কেউ উত্তরও দিচ্ছে না। তাহলে কি কেউ সত্যিই আসেনি, পুরোটাই মনের ভুল!
—তা কেন হবে? আমি তো পরিষ্কার শুনলাম আর তুমিও শুনলে। তাহলে মনের ভুল কেন হবে?
—তা তো ঠিক। কিন্তু এখন আমি কী করি? ইতিমধ্যেই আবার দরজায় ধাক্কা শুরু হইল। মন্ত্রী অতিদ্রুত স্নানঘরে প্রবেশ করিল। মন্ত্রীর স্ত্রী অত্যন্ত সতর্ক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল—
—কে ওখানে? এই সাতসকালে কে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে?
—আমি, দরজা খোলো।
—আমিটা কে?
—আমি ভগবান।
—ভগবান! ভগবান তো এখানে কেন, ভগবান তো থাকেন ঠাকুরঘরে আর আকাশে।
—আরে সেই ভগবান নয়, আমি ভগবানচন্দ্র বণিক, গবুচন্দ্র কোথায়? এখনো ঘুমুচ্ছে নাকি! ডাকো, ডাকো ওকে। জরুরি কথা আছে।
মন্ত্রীর স্ত্রী দরজা খুলিতেই ভগবানচন্দ্র হুড়মুড় করিয়া ঘরে ঢুকিল—
—এক গ্লাস জল দাও তো বৌমা, এতদূর আসতে আসতে জল-তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, আর পারলে দুটো বাতাসাও দিও, খালি পেটে জল খেলে যদি অম্বল হয়!
মন্ত্রীপত্নী ঘর হইতে ভেতরের কক্ষে প্রবেশ করার একটু পরেই সেই কক্ষে মন্ত্রীর প্রবেশ ঘটিল।
মন্ত্রী—কী ভগবানচন্দ্র, এই সাতসকালে গরিবের ঘরে যে, ব্যাপার কী বলো তো!
ভগবান—হাসালে বন্ধু, তোমার এ অট্টালিকাটা হয়ে গেল গরিবের ঘর! রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ভান্ডার তো বেশ ভালোই লুটপাট করেছ দেখছি। তাহলে তো আমার কাজের রেটটাও বাড়িয়ে দিতে হবে! যাকগে, যা হবার তখন হবে, এসো এবার কাগজ-কলম নিয়ে, আমাদের দুজনের চুক্তিটা পাকাপাকিভাবেই লেখাপড়া হয়ে যাক।
মন্ত্রী—চুক্তি হতে গেলে তো আগে কাজের হদিস জানতে হবে। কী কাজ, কতটা ঝামেলার কাজ, কতখানি ঝুঁকি—এসব জেনে তারপর তো চুক্তি হবে, না কি!
ভগবান—শোনো মন্ত্রী, তোমাকে তো আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। তুমি আগে কী ছিলে, কোথায় ছিলে, কী করতে তখন, কীভাবে মন্ত্রীর পদ বাগালে তার পুরো ইতিহাস তো আর কেউ জানুক আর না জানুক, আমি জানি। তা ছাড়া মন্ত্রী হওয়ার পর তোমার কীর্তিকলাপ, তোমার আয়-রোজগার সবই জানা আছে আমার। কাজেই কথা বাড়িয়ে তো লাভ নেই। তুমি যে তলে তলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর গোপালকে পাকাপাকি শেষ করে দেওয়ার মতলব এঁটেছ, তাও আমি স্পষ্টভাবে জানি। এসব নিয়ে কথা বলার জন্য আমি এই কাকভোরবেলায় এখানে আসিনি। আমি চাই তোমার আমার চুক্তি। যদি আমাদের কাজ শুধু লুটপাট হয়, তাহলে একরকম শর্ত আর যদি তুমি সিংহাসনে বসার ব্যবস্থা করো তখন হবে আর একরকম শর্ত। বলো মন্ত্রী, কোন ধরনের চুক্তি করতে চাও। সেই অনুযায়ী ঠিক হবে আগাম কত দেবে।
মন্ত্রী—কী মুশকিল! তুমি দেখছি একনাগাড়ে বলেই চলেছ—আরে, কীসের ওপরে চুক্তি তা তো বলবে। তার ওপরই তো হবে হিসাব-নিকাশ। তুমি এত জানো, এত বোঝো আর এটা বোঝো না! চুক্তি আমার তোমার সঙ্গেই হবে। তবে কাজের ধরনটা তো বুঝতে হবে আগে। আর আগাম তো দেবই, আগেও দিয়েছি, এখনো দেব আর পরেও দেব। শুধু এখন বলো পরিকল্পনাটা কী? এই নাও আরও পঞ্চাশ হাজার। মূল হিসাব হবে পরে। চলো—
ভগবান—বাহ মন্ত্রী! তুমি তো বেশ দিলদরিয়াই হয়ে গেছো দেখছি। বেশ বেশ! শোনো তবে, আমাদের হবে দুই ধরনের পরিকল্পনা—একটা স্বল্পমেয়াদি আর একটা দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্পমেয়াদি হচ্ছে জিনিসপত্রের দামের ওপর নজর রেখে একটা সিন্ডিকেট বানানো।
মন্ত্রী—কী কেট? কেট, না ক্যাট মানে বিড়াল, কোনটা?
ভগবান—ধুর মূর্খ মন্ত্রী—এখানে বিড়াল আসবে কোত্থেকে? ক্যাট না, কেট-সিন্ডিকেট, বুঝলে?
মন্ত্রী—না, বুঝিনি।
ভগবান—শোনো, তুমি আর আমি একটা সিন্ডিকেট। মন্ত্রী হিসেবে তোমার একটা ক্ষমতা আছে, আর বণিক হিসেবে আমার এক ধরনের ক্ষমতা। আমাদের দুজনের চুক্তি হলে বাজারের জিনিসপত্রের দাম ঠিক করব আমরাই, কখনো মাল গায়েব করে দাম বাড়াব আবার মাল ছেড়ে দাম কমাব, বুঝলে ব্যাপারটা? চাল, ডাল, পেঁয়াজ, নুন, তেল, মরিচ, মাছ, মাংস সবকিছুর দামের সুতো থাকবে তোমার আমার হাতে।
মন্ত্রী—বাহ বাহ, দারুণ ব্যাপার। যতদিন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কিংবা গোপাল ভাঁড় কৃষ্ণনগরে না আসেন ততদিন পর্যন্ত চলবে আমাদের এ সিন্ডিকেট—খুব রমরমাভাবেই চলবে, কী বলো! হা-হা-হা...
ভগবান—হা-হা-হা...
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ এবং প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা