পুরো পরিস্থিতি লইয়া চিন্তাভাবনা করার জন্য গবুচন্দ্র মন্ত্রী রাজদরবারে গমনের পরিবর্তে কিছুকাল তীর্থ ভ্রমণ করিয়া অবশেষে কৃষ্ণনগরে ফিরিল। দুই সপ্তাহ ধরিয়া সে চিন্তাভাবনা করিয়া লইয়াছে, রাজদরবারে কীভাবে কথাবার্তা বলিবে আর কেমন হইবে তাহার আচরণ! ইতোমধ্যে সে একবার কটা-ঘটার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়া কৃষ্ণনগরের এবং মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে যাবতীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করিয়াছে আর যোগাযোগ করিয়া জানিয়াও লইয়াছে ভগবানচন্দ্র বণিক কোথায় এবং কী অবস্থায় আছে। কটা জানাইয়াছে যে, ভগবানও অধীর আগ্রহে গবুমন্ত্রীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করার জন্য দিন গুনিতেছে।
কাজেই মন্ত্রী রাজদরবারে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করিল। কিন্তু সকালে ডালভাত খাওয়ার কথা বলিতে যাইয়া একটু থতমতও খাইল। মন্ত্রীগিন্নিও বোধহয় সেই আগের মতো নাই। ছোট একটা সাধারণ সংবাদ দেওয়ার জন্য যেভাবে মোচড় দিয়া একটা সোনার বিছা আদায় করিয়া লইল, তাহাতে সে বেশ বিচলিত বোধই করিল। কে জানে এখন ভাত-ডালের কথা বলিলে যদি আবার এক নতুন বায়না তুলিয়া ধরে!
কিন্তু তেমন কিছু অবশ্য ঘটিল না। স্নানাহার শেষে মন্ত্রী রাজদরবারের দিকে রওনা হইল এবং যাত্রাপথে কোনো প্রকার বাধাবিঘ্ন ছাড়াই দরবারে পৌঁছিল। শুধু তাহাই নহে, দেখা গেল রাজদরবারে সবাই উপস্থিত। সেনাপতি, রাজকবি, কবিরাজ, রাজজ্যোতিষী, পাত্র-মিত্র সকলেই। পুরো দরবারের সকলেই করতালি দিয়া মন্ত্রীকে স্বাগত জানাইল। মন্ত্রী যতখানি অভিভূত ততোধিক বিস্মিত! ব্যাপারটা কী! দীর্ঘ ছুটির পর এর আগেও তো মন্ত্রী দরবারে আসিয়াছে। কিন্তু কখনোই তো এ সম্ভাষণ পরিলক্ষিত হয় নাই।
অলংকরণ : আবু হাসান
মন্ত্রী মহারাজকে কুর্নিশ করিয়া আসন গ্রহণ করামাত্র রাজকবি উঠিয়া দাঁড়াইল। বিনীত কণ্ঠে কহিল, সকলের অতি প্রিয় মহামন্ত্রী গবুচন্দ্রের শুভ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আমি একটা ছোট্ট কবিতা লিখেছি। মহারাজ যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি কবিতাটি পাঠ করতে পারি।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র—সেটা তো অবশ্যই হবে। তবে আগে মন্ত্রীকে একটু শান্ত হয়ে বসতে দাও সবাই। মন্ত্রী শুধু একটু বিশ্রাম নিলে তখন তার কাছ থেকে আমরা শুনব তার অভিজ্ঞতার কথা।
রাজকবি—তাহলে আমার কবিতাটা কখন শুনাব?
—এখনই শুনাবে। অ্যাই, সবাই চুপ করে রাজকবির কবিতাটা শোনো।
রাজকবি—
অভিনন্দন, মন্ত্রীমশাই, স্বাগতম, স্বাগতম :
তুমি আমাদের চোখের মণি কটা-ঘটার প্রিয়তম
তুমি হলে কৃষ্ণনগরের রাজসভার অলংকার
তুমি হলে ভগবানের বাঁধ না মানা অহংকার
গবুচন্দ্র মন্ত্রী এ কবিতা শুনিয়া কিঞ্চিৎ বিব্রত বোধ করিল। ব্যাপারটা কী! হঠাৎ রাজদরবারে এমন ধরনের আয়োজন আবার রাজকবির এহেন ইঙ্গিতপূর্ণ কবিতা, আবার কবিতার মধ্যে কটা-ঘটার কথা এবং অতি কৌশলে ভগবানের নামটিও উল্লেখ মন্ত্রীর অস্বস্তি অনেক বাড়াইয়া দিল। তবু সে হাসিমুখে বিনয় প্রকাশ করিয়া বলিল—
আমাকে এমন অনবদ্য সম্ভাষণ জানানোর জন্য আমি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এবং রাজসভার সকল সদস্যকে আমার পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। এখন আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। কথায় আছে, আলস্য দুখের আকর। কাজে আলস্য পরিত্যাগ করে কৃষ্ণনগরের প্রজাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।
রাজজ্যোতিষী—মহারাজ, আমি গ্রহ-তারার অবস্থান নির্ণয় করে একটা বিষয়ে অবগত হয়েছি যে, কৃষ্ণনগরের ভাগ্যাকাশে এক বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন যদি ভালোর দিকে যায় অর্থাৎ মঙ্গল যদি বৃহস্পতির সঙ্গে একই অবস্থানে বিরাজ করে, তাহলে কৃষ্ণনগর স্বর্ণভূমিতে পরিণত হবে আর যদি শনি রাহুর নিকটবর্তী হয় তবে প্রলয়কাণ্ড ঘটার আশঙ্কা আছে। কাজেই আমাদের কৃষ্ণপক্ষের দিকেও অতিশয় গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করতে হবে।
গোপাল ভাঁড় এতক্ষণ চুপচাপ সকলের কথাবার্তা শুনিতেছিল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এবার তাহাকে নির্দেশ করিয়া বলিলেন—
—ও গোপাল, এবার তুমি কিছু বলো।
—আমি আর কী বলব মহারাজ। মন্ত্রীমশাই ফিরে এসেছেন, এ তো আমাদের জন্য অত্যন্ত সুখের সংবাদ। কৃষ্ণনগরে তো তার অবস্থান মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পরেই, সে কথা উনি সবসময়ই বলে থাকেন এবং আমরাও সেভাবেই তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করি। মহারাজ, রাজধর্ম অতিশয় পবিত্র দায়িত্ব। আমরা সকলেই জানি, রাজা এবং রাজন্যবর্গের সুকর্ম ও সুচিন্তা রাজ্য ও প্রজাসাধারণের জন্য মঙ্গলদায়ক। কাজেই কেউ কখনো নিজের স্বার্থে রাজ্যকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবেন না, আমি একজন দরিদ্র প্রজা হিসেবে এই আশা করতেই পারি। আজ রাজদরবারে মন্ত্রী বাহাদুরের শুভ প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। যদি আর কারও অন্য কোনো বক্তব্য না থাকে আমাদের পরমপ্রিয় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন।
গোপাল ভাঁড়ের বক্তব্য প্রদানের পর সকলে উদগ্রীব হইয়া প্রতীক্ষা করিতে থাকিল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বক্তব্য শোনার জন্য। গোপাল লক্ষ করিল, মন্ত্রীর কপালে স্বেদবিন্দু এবং দৃষ্টি কিঞ্চিৎ বিহ্বল ও চঞ্চল। সেই চঞ্চল দৃষ্টি যেন কিছু একটা অন্বেষণ করিতেছে। গোপালের মুখে অত্যন্ত রহস্যময় হাসির রেখা ক্ষণকালের জন্য ফুটিয়া উঠিল।
পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বলিলেন,
—আজ আমি যে কথা বলতে চেয়েছিলাম তা আমি পরবর্তী সভায় অবশ্যই বলব। যেহেতু মন্ত্রী আজ অনেক দিন পর রাজসভায় এসেছে, তাই আমি আজ এমন কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন করব না, যা রাজসভার সদস্যদের কাউকে কোনোভাবে বিচলিত না করে। আজ আমাদের আনন্দের দিন। দীর্ঘ বিরতির পর মন্ত্রীর প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। ইতোমধ্যে কৃষ্ণনগরে এমন কিছু কিছু ঘটনা আমাদের মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে ঘটে গেছে, যা এই রাজ্যের জন্য সুসংবাদ নয়। আমার বিশ্বাস, মন্ত্রী উপস্থিত থাকলে এ ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা এড়ানো যেত। সকলের অবগতির জন্য এটুকু বলতে পারি, গোপালের দূরদর্শী ভূমিকার কারণে কৃষ্ণনগরের অস্তিত্ব রক্ষা পেয়েছে। বিস্তারিত বিষয় পরবর্তী দিনে জানানো হবে। এখন সকলে প্রাণভরে মিষ্টিমুখ করুন এবং মন্ত্রীর প্রত্যাবর্তন উদযাপন করুন। সভার কাজ আজ এ পর্যন্তই।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ এবং প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা