‘‘হাওয়া ভবনের বিতর্কিত কর্মকর্তাদের মধ্যে অধিকাংশই এখনও বিদেশেই বহাল তবিয়তে অবস্থান করছে। কেউ কেউ দেশে দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও এখন আবার খোলস ছেড়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছে’’
.....................................
নানান চাপে বিপর্যস্ত দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপিতে ফের সক্রিয় হচ্ছেন হাওয়া ভবনের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ও ক্ষমতাধর বিতর্কিত সিন্ডিকেট নেতারা।
ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপটে গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেলেও এখন আবার তাদের অনেকে দেশে ফিরে এসেছেন। আর বাকিরা বিভিন্ন কৌশলে দেশে আসার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ বিদেশে অবস্থান করেও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ও নানানভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
প্রসঙ্গত, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের নাম ভাঙিয়ে হাওয়া ভবনের যেসব প্রভাবশালী কর্মকর্তা দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়ে তোলেন তাদের কথা দেশের মানুষ এখনও ভুলতে পারেনি। তাই তো ঘুরে ফিরে বার বার মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে হাওয়া ভবনের সেই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখন কে কোথায?
তারা আবার সক্রিয় হচ্ছেন জানতে পেরে খোদ বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যেই ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেই সঙ্গে তাদের মনে একটি প্রশ্ন বড় করে দেখা দিয়েছে যাদের কারণে বিএনপিকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত হতে হয়েছে তারা কি আবারও বিএনপির ছায়াতলে আসার সুযোগ পাবে?
জানা যায়, হাওয়া ভবনের বিতর্কিত কর্মকর্তাদের মধ্যে অধিকাংশই এখনও বিদেশেই বহাল তবিয়তে অবস্থান করছে। কেউ কেউ দেশে দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও এখন আবার খোলস ছেড়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। বিএনপি কার্যালয় কিংবা দলীয় কোনো কর্মসূচিতে তাদের তেমন সক্রিয় দেখা না গেলেও দলীয় নেতাদের উপর তারা অবৈধভাবে নানা রকম প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বিএনপির অনেক সিনিয়র ও প্রভাবশালী নেতাও তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন বলে জানা গেছে।
রাজধানীর বনানীর ১৩ নম্বর সড়কের ৫৩ নম্বর বাড়িটির নাম ছিল ‘হাওয়া ভবন’। বাড়িটির মালিক ছিল খুলনা অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও বিএনপির মৌসুমী নেতা আলী আজগর লবী। লবী মালিক হলেও বাড়িটি পরিচিত পায় ‘তারেক রহমানে’র রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে। যদিও বাড়িটি নেয়া হয়েছিল মূলতঃ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে। তবে সেখানে বিএনপি চেয়ারপারসন নিয়মিত অফিস না করলেও বা নিয়মিত না বসলেও তাঁর ছেলে দলের তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান তার ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে ছিলেন নিয়মিত। আর জনশ্রুতি আছে, আলোচিত-সমালোচিত-বিতর্কিত এই হাওয়া ভবন থেকেই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নিয়ন্ত্রিত হতো দেশের রাজনীতি, ব্যবসা, সন্ত্রাসসহ অনেককিছু। হাওয়া ভবনের অনুকম্পা ছাড়া দেশের কোনো ব্যবসায়ী মহল করতে পারত না ব্যবসা। সরকারি বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসের চাকরিজীবীরাও নিজেদের অবৈধ স্বার্থে হাওয়া ভবনের অনুকম্পা পাওয়ার আশায় লাইন ধরে বসে থাকতেন বলে গুঞ্জন আছে।
.....................................
‘‘মামুন ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পুত্র তারেক রহমানের স্কুল বন্ধু। সেই সুবাদে চতুর মামুন তারেকের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন’’
.....................................
জোট সরকারের আমলে হাওয়া ভবনের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তারেক রহমান তাঁর আস্থাভাজন কিছু লোককে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেন। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখানে বসে তারেক রহমানের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য ও মনোনয়ন বাণিজ্য থেকে শুরু করে আর্থিক সুবিধা আদায়ের জন্য হেন কোনো কাজ নেই যা করতেন না। আর নিজেদের ধান্ধা ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে হাওয়া ভবনের ওইসব কর্মকর্তারাই হাওয়া ভবনকে দুর্নীতি ও অনিয়মের ভবন হিসেবে দেশবাসীর কাছে পরিচিত করে তোলেন। এর ফলে এই ভবনের প্রতি মানুষের মনে ঘৃণা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
হাওয়া ভবনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন তারেক রহমানের বাল্যবন্ধু ও হঠাৎ ব্যবসায়ী বনে যাওয়া বহুল বিতর্কিত গিয়াস উদ্দিন আল মামুন।
মূলত হাওয়া ভবনের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত এবং বিতর্কিত হয়ে ওঠার পেছনের মূল কারিগর এক সময়ে রাজধানীর একটি মহল্লার গলিতে ওষুধের দোকানদার মামুন।
মামুন ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পুত্র তারেক রহমানের স্কুল বন্ধু। সেই সুবাদে চতুর মামুন তারেকের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন।
এই মামুন ছিলেন তারেক রহমানের অত্যন্ত বিশ্বস্ত। ঘনিষ্ঠ বন্ধু মামুন যা বলতেন তারেক রহমান তাই করতেন। জোট সরকারের আমলে তারেক যেখানে যেতেন মামুনও সেখানে। এই সুযোগে মামুন তারেকের নাম ভাঙিয়ে দাপটের সঙ্গে যেখানে যা করার করে ফেলতেন। তারেকের বন্ধু হওয়ায় কেউ অভিযোগ করারও সাহস পেতেন না। এমনকি খালেদা জিয়ার মন্ত্রী পরিষদের সিনিয়র মন্ত্রীরাও মামুনের দাপটের কাছে ছিলেন নস্যি। মামুনের বিরুদ্ধে নদীপথে লঞ্চ চলাচলে অনিয়ম ও অবৈধ পন্থার অভিযোগ তোলেন তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদের সিনিয়র মন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন। তিনি মামুনের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে এ অভিযোগ আনেন। ক্ষিপ্ত ও ক্ষমতার দম্ভে মামুন মন্ত্রী আকবরকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আল্টিমেটাম দেয়। এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য কর্নেল আকবর প্রকাশ্যে মামুনের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পার পান।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় বিদ্যুতের খাম্বা কেলেংকারিসহ হাজারও কেলেংকারির হোতা মামুন যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে বেশ ক’টি মামলা হয়। এখনও সেখানেই অবস্থান করছেন বিএনপিকে বিতর্কে ফেলা সেই সময়ের প্রতাপশালী গিয়াসউদ্দিন মামুন।
হাওয়া ভবনের আরেক কুশীলব আশিক ইসলাম। মূলত হাওয়া ভবনের মুখপত্র ছিলেন আশিক ইসলাম। তার ক্ষমতার দাপটের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সেক্রেটারি ও ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তখন চিত্রজগত ও বিটিভি চলতো তাঁর ইশারায়। এ ছাড়া তার অনুমতি ছাড়া তারেক রহমানের সঙ্গে কেউ দেখা করতে পারতো না। হাওয়া ভবনে বিএনপির কোনো অনুষ্ঠান হলে কোন সাংবাদিক সেখানে তার পেশাগত দায়িত্বপালনের জন্য প্রবেশ করবে আর কোন সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারবে না তা আশিকই ঠিক করে দিতেন। তারেক রহমানের নাম ভাঙিয়ে টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ও মনোনয়ন বাণিজ্য থেকে শুরু করে অর্থ লোভে এমন কোনো কাজ নেই যা তিনি করেননি। পরবর্তীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আশিক ইসলাম তথ্য প্রতিমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে তিনি ঢাকার ফকিরাপুলের মেসে থাকতেন। কিন্তু জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাত্র ৫ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। সে সময়ই তিনি আমেরিকায় একটি পেট্রোল পাম্প ও একটি বাড়ি নির্মাণ করেন।
ওয়ান-ইলেভেনের পর দেশ ছেড়ে আমেরিকায় পালিয়ে যান দুর্নীতির এই বর পুত্র। বর্তমানে সেখানেই সপরিবারে বহাল তবিয়তে অবস্থান করছেন। কয়েক বছর আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে আশিক ইসলাম তাঁর সফরসঙ্গীদের সঙ্গে দেখা করেন। তবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি। মূলতঃ আমেরিকায় বাস করলেও আশিক আবার লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। মাঝে মাঝেই তিনি লন্ডনে তার পুরনো ‘বস’ এর সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করেন। পাশাপাশি তিনি কিছু ‘শিবির’ ব্যাক গ্রাউন্ডধারী ব্যক্তিদের নিয়ে তারেক রহমানের প্রেস উইং সক্রিয় রেখেছেন বলে সূত্রে জানা যায়।
হাওয়া ভবনের আরেক দাপুটে কর্মকর্তা মিয়া নুরুদ্দিন অপু। তিনি ছিলেন তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সচিব। তার অনুমতি ছাড়া মন্ত্রী-এমপিরাও তারেক রহমানের সাক্ষাৎ পেতেন না। কিন্তু বড় রকমের আর্থিক লেনদেন হলে যে কাউকে তারেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কাজ বাগিয়ে দিতেন অপু। ওয়ান ইলেভেনের সময় মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুরে নিজের ‘সেকেন্ড হোমে’ পালিয়ে যান অপু। সেখানে দীর্ঘদিন তিনি বহাল তবিয়তে অত্যন্ত বিলাসিতার সঙ্গে দিন যাপন করেন। মালয়েশিয়া থেকেই শরীয়তপুরের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান অপু তার সিন্ডিকেট সক্রিয় রাখেন। বিএনপির বিভিন্ন কমিটিতে স্থান পেতে নেতারা দেশ থেকে অর্থ নিয়ে অপুর কাছে নিয়মিত ধরনা দিতে হাজির হতো। মালয়েশিয়ায় থেকেই অপু তারেক রহমান বা ‘ভাইয়া’র সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন বলে দলীয় নেতাদের কাছে জানা যায়। তারেক রহমানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বলে প্রচার চালিয়ে বিএনপি নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতেন। এর ফলে বিএনপির যেসব নেতারা দলে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে চান তারা মালয়েশিয়া গিয়ে অপুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। সেই বিতর্কিত অপু হঠাৎ করেই গত বছর দুয়েক আগে দেশে ফিরে আদালতের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করেন। তার দেশে আগমনে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে তখন চাঞ্চল্যও দেখা দেয়। এরপর বিগত ৩০ ডিসেম্বর আলোচিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে দলের পরীক্ষিত নেতাদের হটিয়ে শরিয়তপুর-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়ন বাগিয়ে নেন অপু। গত ২৫ ডিসেম্বর মতিঝিলে তার ব্যবসায়িক কার্যালয় থেকে র্যাব নগদ ৮ কোটি টাকা জব্দসহ কয়েকজন অফিস স্টাফকে আটক করে। এরপর ৪ জানুয়ারি রাজধানীর অভিজাত ইউনাইটেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অর্থ পাচার ও সন্ত্রাস বিরোধী আইনে র্যাব তাকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে অপু কারাগারে।
হাওয়া ভবনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন সাবেক ছাত্রদল নেতা রকিবুল ইসলাম বকুল। তারেক রহমান ও হাওয়া ভবনের নাম ভাঙিয়ে প্রশাসনে নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি ও পদায়নের কাজ করতেন তিনি। এক সময় বিদেশে পালিয়ে গেলেও বর্তমানে দেশেই আছেন। দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকলেও বর্তমানে বকুল হাওয়া ভবন সিন্ডিকেটকে সক্রিয় করে বিএনপির রাজনীতিতে আবারও প্রভাব বিস্তার করছেন বলে জানা গেছে।
হাওয়া ভবনের আরেক প্রতাপশালী কর্মকর্তা ছিলেন বগুড়া থেকে নির্বাচিত বিএনপির সাবেক এমপি হেলালুজ্জামান তালুকদার লালুর ছেলে জয়। ওয়ান-ইলেভেনের পর বিদেশে পালিয়ে গেলেও বর্তমানে দেশেই অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে তাকে তেমন কোথাও দেখা যায় না। তবে বিএনপির কিছু নেতার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।
হাওয়া ভবনের আরেক কর্মকর্তা ও তারেক রহমানের বন্ধু ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবাল। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এসাইনমেন্ট অফিসার ছিলেন। এর ফলে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে একদিকে হাওয়া ভবন ও অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী অফিসে দাপটের সঙ্গে অবস্থান করতেন। নিয়োগ বাণিজ্য ও টেন্ডার বাণিজ্যসহ বিভিন্নভাবে দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়েছেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর বিদেশে পালিয়ে যান। বর্তমানে দেশ থেকে পাচার করা অর্থে মালয়েশিয়া, দুবাইয়ে রাজকীয় জীবন যাপন করছেন। সেখানে অবস্থান করেই তারেক রহমান ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বিএনপির কর্মকাণ্ডে প্রভাব বলয় সৃষ্টি করছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
হাওয়া ভবনের আরেক প্রতাপশালী কর্মকর্তার নাম কামরুল ইসলাম। তিনি তারেক রহমানের এপিএস হিসেবে কাজ করতেন। তারেক রহমানের নাম ভাঙিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সব ধরনের কাজই করতেন তিনি। বর্তমানে দেশে অবস্থান করলেও লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছেন। তবে বিভিন্ন কৌশলে আবার বিএনপির কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের দাপটশালী মন্ত্রী শাজাহান সিরাজের ছেলে অমিতাভ সিরাজ অপু তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে হাওয়া ভবনের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদ পান। এখানে বসেই অপু একদিকে হাওয়া ভবন ও অপরদিকে বাবার প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্নভাবে দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়ে তোলেন। বর্তমানে তিনি দেশে না বিদেশে তেমন জানা যায় না। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শাহজাহান সিরাজ অসুস্থতা ও বয়সের ভাড়ে বিএনপির রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। তবে মা রাবেয়া সিরাজ বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য।
ভাড়া সূত্রে হাওয়া ভবনের মালিক ছিলেন সাবেক এমপি আলী আজগর লবি। তিনি লন্ডন প্রবাসী হাওয়া বেগমের কাছ থেকে বনানীর বাড়িটি কিনে নিয়ে ভাড়া হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক সচিবালয় হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি তারেক রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠেন। নিয়মিত হাওয়া ভবনে যাওয়া-আসার কারণে তিনিও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হয়ে উঠেন। এই সুযোগে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্নভাবে তিনি টাকার কুমিরে পরিণত হন। রাজনৈতিক ব্যাক গ্রাউন্ড তেমন না থাকলেও তিনি বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে স্থান পেয়ে যান। বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের পোড় খাওয়া দলের নেতাদের উপর খবরদারি করে ওই অঞ্চলের প্রধান নেতায় পরিণত হন। ওয়ান ইলেভেনে লবী তার পাকিস্তানি স্ত্রীসহ দুর্নীতির দায়ে আটক হন। মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে কিছুদিন জেলও খাটেন। পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে দেশীয় রাজনীতিতে ‘অভিশপ্ত হাওয়া ভবন’ বিক্রি করে দিয়ে সপরিবারে দেশ থেকে চলে যান। বর্তমানে তিনি আমেরিকাতে বসবাস করেন বলে জানা যায়।
তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সুবাদে আরেক বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি এমএএইচ সেলিম (সিলভার সেলিম নামে ব্যাপক পরিচিত) হাওয়া ভবনে নিয়মিত বসতেন। এই সুবাদে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে আদম ব্যবসার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রক ছিলেন সিলভার সেলিম। ওয়ান ইলেভেনে নানা অর্থনৈতিক ও নারী কেলেংকারীর হোতা সিলভার সেলিম আটক হন। পরে বের হয়ে বিএনপির রাজনীতি থেকে ঘোষণা দিয়ে সরে দাঁড়ান। বর্তমানে বিএনপির কোনো কর্মসূচিতে তাকে দেখা যায় না। তবে তিনি তারেক রহমানের দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে হাওয়া ভবন ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সঙ্গে ‘কানেকটিং লিংক’ হিসেবে কাজ করতেন তৎকালীন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও প্রধানমন্ত্রীর ১ নম্বর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী। হাওয়া ভবনের নাম ভাঙিয়ে টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, পদায়ন ও বদলি থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই যা তিনি করতেন না। ওয়ান-ইলেভেনের পর বিদেশে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে বেশ ক’টি দুর্নীতির মামলা হয়। এ ছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলারও তিনি আসামি। এক পর্যায়ে তার নামে হুলিয়া জারি হয়। ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকে সিলেট থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের আসামের করিমগঞ্জে মামার বাড়িতে অবস্থান করলেও বর্তমানে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। আবার শোনা যায়, স্কিন ক্যান্সারে ইতোমধ্যেই বিতর্কিত এই হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন। আবার বেঁচে থাকলেও বিএনপি ও জিয়া পরিবারের সঙ্গে এখন তার কোনো যোগাযোগ নেই বলে জানা গেছে।
এছাড়াও, হাওয়াভবনের ছত্রছায়ায় লাইম লাইটে ছিলেন সাবেক এমপি রশিদুজ্জামান মিল্লাত এমপি, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, কাজী কামাল, লুৎফর রহমান বাদল, আতিকুর রহমান রুমন, বেলায়েত হোসেন, শাহরিন ইসলাম তুহিন, সাইফুল ইসলাম ডিউক, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, সাজ্জাদ হোসেন নাইট, লুৎফুজ্জামান বাবর, জহিরউদ্দিন স্বপন, ইলিয়াছ আলী এমপি, মফিকুল হাসান তৃপ্তি, এমরান সালেহ প্রিন্স, আসাদুল হাবিব দুলু, সাতক্ষীরার সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিব, সায়মন আকবরসহ আরও অনেকে।
এদের অনেকেই যেমন ছিলেন বিএনপির নেতা আবার অনেকেই ছিলেন নিরেট হাওয়া ভবনের কর্মচারী। আর কর্মচারী হয়েও তারা মূলত অবৈধ পন্থায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন।
এ ব্যাপারে বিএনপির বেশ ক’জন সিনিয়র নেতার মন্তব্য চাওয়া হলে তারা কোনো কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, হাওয়া ভবনের বিতর্কিতদের কারণে বিএনপির অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাই তারা যেন আর বিএনপির কাছে আসতে না পারে সে জন্য দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকতে হবে।
টিএস/আরআই