আজ ১০ ডিসেম্বর। এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্মভূমি টাঙ্গাইলের মাটি।
সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের একেবারে শুরু থেকেই রণাঙ্গনে শত্রুর বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে রুখে দাড়িয়েছিলো টাঙ্গাইলের মুক্তিসেনারা। হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্তিত্বের সবটুকু নিঙড়ে দিয়েছিলো তারা। রেসকোর্সের ময়দান থেকে ভেসে আসা সেই বজ্র হুঙ্কারের জবাবে সে সময় একযোগে গর্জে উঠেছিলো ৭ কোটি বাংলার বাঘ। তাতে পিছিয়ে ছিল না টাঙ্গাইলের দামাল সন্তানেরা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে লেখা এই দিনটি টাঙ্গাইল জেলার উত্তরাঞ্চলের জন্য স্মরণীয় একটি দিন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দেশের মত রক্তে মুক্তির বাণ জেগেছিলো এই জেলার সূর্য সেনাদের।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর টাঙ্গাইলের মধুপুর, ধনবাড়ী, ঘাটাইল, কালিহাতী হতে এলেঙ্গা পর্যন্ত মুক্ত করেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আকাশে সেদিন লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে টাঙ্গাইল জেলার মুক্তিযোদ্ধারা জানান দিয়েছিল আরো একটি বিজয় অর্জনের কথা। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতেই টাঙ্গাইলে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ। যার অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন ধনবাড়ী আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা (স্বাধীনতা পরবর্তী পাইস্কা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) মাওলানা কছিমউদ্দিন খান। ২৬ মার্চ থেকে গ্রামে গ্রামে সংগঠিত হতে শুরু করে ছাত্র, শিক্ষক, কৃষকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ।
এ অঞ্চলে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা মুক্তিকামী বাঙালিদের দমন করতে ৩ এপ্রিল প্রথম পাক-হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবরোধ ভেঙ্গে টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করে। জায়গায় জায়গায় শুরু হয় খণ্ড যুদ্ধ। পাকবাহিনী ঘরে ঘরে হানা দিয়ে খুজতে শুরু করে মুক্তিসেনাদের। লুট করে বহু মা-বোনের সম্ভ্রম। হত্যা করে বহু নিরীহ মানুষকে। আর বীভৎস নির্যাতনের বর্বরতা চালায় মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতাকারীদের।
১৪ এপ্রিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে দুর্বার প্রতিরোধটি গড়ে ওঠে মধুপুর ও ধনবাড়ী অঞ্চলে। সেখান থেকেই শুরু হয় পাকিদের পিছু হটা। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এমনটাই জানান ধনবাড়ী পৌরসভার পাইস্কা গ্রামের অধিবাসী এম এ খালেদ খান।
১৭ এপ্রিল কালিহাতীতে সংঘটিত ঐতিহাসিক প্রতিরোধ যুদ্ধে মধুপুরসহ আশপাশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। ৯ মাস নানা ঘটনাবহুল যুদ্ধ এ অঞ্চলে সংঘটিত হয়। শেষে ১০ ডিসেম্বর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মধুপুরের পাক-হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান-সেনাসহ অসংখ্য রাজাকার আলবদরকে গ্রেফতার করে ঘাঁটিটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। এ সময় মুক্তি বাহিনীর দখলে আসে বিপুল অস্ত্র। ফলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুহূর্তে হানাদার বাহিনী ও তার সেনাদের মনোবল সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে যায়। তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এভাবেই ১০ ডিসেম্বর শত্র“ মুক্ত হয় উত্তর টাঙ্গাইলে ধনবাড়ী, মধুপুর, ঘাটাইল অঞ্চল।
এর আগে এই বিশেষ অপারেশনের অন্যতম সহযোগী মওলানা কছিমউদ্দিন খানকে ৩ ডিসেম্বর তুলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর কতিপয় সদস্য। ধনবাড়ী এলাকায় সংগঠিত মুক্তিসেনাদের রসদ সরবরাহ করার অপরাধে স্থানীয় আলবদর সদস্যদের মাধ্যমে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। টানা ৩ দিন পাক বাহিনীর বর্বর অত্যাচার ও বেয়োনেটের খোচায় ক্ষত-বিক্ষত দেহ নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি।
বাবার সেই দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই দেশপ্রেমিক বৃদ্ধের সন্তান, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্নকর্তা ও সোনালী ব্যাংক বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য এম এ খালেদ খান।
বৃদ্ধ বয়সে এই বর্বর অত্যাচার সহ্য করার পরেও মুক্তিসেনাদের সম্পর্ক তথ্য না দেয়ায় এবং আত্মসমর্পনের স্বীকারোক্তি প্রকাশ না করায় তাকে নির্যাতনের পর বিবস্ত্র-অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে যায় পাক বাহিনী। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ধনবাড়ী এলাকায় এক জনসমাবেশে তার সেই দুঃসাহসী অবদানের জন্য তাকে সম্মানিত করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
১০ ডিসেম্বর প্রথম প্রহরে এক সুপরিকল্পিত গেরিলা হামলা পরিচালনার মাধ্যমে পাক শিবিরে মরণপ্রলয় জাগিয়ে তোলে বীর মুক্তিসেনারা। সেদিনই একযোগে শত্রু শিবিরে হামলে পরে গেরিলা বাহিনীর প্রতিটি ইউনিট। যার নেতৃত্ব দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বর্তমান সরকারের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী জনাব আব্দুর রাজ্জাক।
ধনবাড়ী ইউনিয়নের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ওয়াজেদ আলী খান দৈনিক জাগরণকে বলেন, "সেদিন যে দুঃসাহসী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক তা অবিশ্বাস্য। সেদিন শত্রুদের পরাজয় নিশ্চিত করার পর টাঙ্গাইলের বীরসেনা, ধনবাড়ীর মুর্শুদ্দি গ্রামের সূর্য সন্তান জনাব আব্দুর রাজ্জাকের হাতেই টাঙ্গাইলের বুকে প্রথম উত্তলিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।"
দৈনিক জাগরণের সঙ্গে আলাপকালে পৌর আ’লীগের সভাপতি সিদ্দিক হোসেন খান, উপজেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সদস্য জনাব সাত্তার খান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উপজেলা কাউন্সিলের কমান্ডার পরিমল কান্তি গোস্বামী, মধুপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ বজলুর রশীদ খানের বক্তব্যেও সেদিনের সেই রোমাঞ্চকর সশস্ত্র যুদ্ধের নানা তথ্য জানা যায়।
এসকে/বিএস