বিশ্বকাপ জেতা মোটেও সহজ কোনো কাজ নয়। উদাহরণ আপনার সামনেই- সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারকে এক বিশ্বকাপ পেতে খেলতে হয়েছে ছয়টি বিশ্বকাপ। জীবনের শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচে গিয়ে তিনি পেয়েছিলেন বিশ্বকাপ নামক সোনার হরিণের দেখা।
তবে শচীনের মতো ভাগ্য এতো সুপ্রসন্ন নয় অনেক কিংবদন্তি ক্রিকেটারের। বিশ্বজুড়ে এমন অনেক ক্রিকেটার আছেন, যারা নিজের পুরোটা ক্যারিয়ার জুড়ে অসামান্য সব কীর্তি গড়লেও নিতে পারেননি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ। সেই তালিকায় যেমন রয়েছে গ্রাহাম গুচ তেমনি কিছুদিন আগে বিদায় নেয়া লঙ্কান কিংবদন্তি কুমার সাঙ্গাকারাও।
দৈনিক জাগরণের বিশ্বকাপ বাউন্ডারির আজকের আয়োজনে থাকছে দুর্ভাগ্য সেই ১০ ক্রিকেটারের বৃত্তান্ত যারা বিশ্ব ক্রিকেটে একের পর রেকর্ড গড়লেও কখনো জিততে পারেননি বিশ্বকাপ :
গ্রাহাম গুচ : খেলোয়াড়ি জীবনে বিশ্বকাপ জিততে আর কী-ই বা করতে পারতেন গুচ? বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের হয়ে মোট ৩টি ফাইনাল খেলেছেন তিনি। দলকে ১৯৯২ বিশ্বকাপে নেতৃত্বও দিয়েছেন। ১৯৮৭ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মুম্বাইয়ে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন গুচ। যা বিশ্বকাপ ইতিহাসে এখন পর্যন্ত অন্যতম সেরা ইনিংস ধরা হয়। প্রায় ২১ বছর ক্রিকেট খেলছেন তিনি। আর রান? লিস্ট এ ক্রিকেটে এই ইংলিশ ব্যাটসম্যানের রানসংখ্যা ২২,২১১- যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
ইয়ান বোথাম : ইংল্যান্ডের হয়ে দুইবার বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলেছেন ইয়ান বোথাম। ক্যারিয়ারে তার সেরা অলরাউন্ড পারফরম্যান্সগুলোর বেশির ভাগই এসেছে বিশ্বকাপের মঞ্চে। তবে বল হাতে ক্যারিয়ারের সূচনালগ্ন থেকে বেশ ধারাবাহিক ছিলেন বোথাম। ১৯৯২ বিশ্বকাপ নিজের সেরাটা দেন তিনি। ১০ ম্যাচ তুলে নেন ১৬ উইকেট। তবে ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস- এতো ভালো খেলেও বিশ্বকাপ আর কখনো ছোঁয়া হয়নি এই ক্রিকেটারের। হয়তো ভুল সময়ে জন্ম নিয়ে ভুল দলের হয়েই খেলেছিলেন এই কিংবদন্তি।
ওয়াকার ইউনুস : ক্রিকেট বিশ্বের যেকোনো যুগের সেরাদের একজন ওয়াকার ইউনুস। তবে বিধাতা বাম- ৯২ বিশ্বকাপ পাকিস্তান জিতল কিন্তু ইনজুরির কারণে খেলতেই পারলেন না তিনি। এরপর ৯৯ বিশ্বকাপে খেললেন এবং পাকিস্তান ফাইনালেও উঠলো তবে শিরোপা আর জেতা হলো না তার। পুরনো বলে রিভার্স সুইং করানোর পথিকৃৎ হলেন ওয়াকার ইউনুস। ডেথ ওভারে তাই বেশ কিপ্টে বোলিং করতে পারতেন তিনি। এজন্য সমর্থকদের কাছ থেকে নামও পেয়েছিলেন- বুরেওয়ালা এক্সপ্রেস। ওয়ানডে ক্রিকেটে ইউনুস যে সর্বকালের সেরাদের একজন তা একটি সমীকরণ সামনে আনলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত একদিনের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ফাইফার নেয়ার কীর্তি এই ফাস্ট বোলারের।
সৌরভ গাঙ্গুলি : ক্যারিয়ারে মোট ৩টি বিশ্বকাপ খেলেছেন সৌরভ গাঙ্গুলি। এর মধ্যে ২০০৩ আফ্রিকা বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দেন ‘ক্যালকাটা প্রিন্স’। সেই বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে রেকর্ডও গড়েন সৌরভ। এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ৩ ব্যক্তিগত সেঞ্চুরির রেকর্ড- যা এখন পর্যন্ত ভাঙতে পারেনি কেউ। ব্যক্তিগত সৌরভ কম-বেশি সফল ছিলেন প্রতিটি বিশ্বকাপেই। তাছাড়া তিনি সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত তার অধিনায়কত্বের জন্য। বলা হয়, ভারত দলে আগ্রাসী ক্রিকেট খেলার জন্ম দিয়েছেন সৌরভ। আর তা অনুসরণ করেই টিম ইন্ডিয়া আজ বিশ্ব শাসন করে বেড়াচ্ছে। তবে ভাগ্য বিধাতা মুখ তুলে চায়নি বাংলার সূর্য সন্তানের প্রতি। ২০১১ সালে শচীন-শেবাগ-ধোনির-যুবরাজরা বিশ্বকাপ জিতলেও, এই দল গড়ার কারিগর সৌরভ অবসরে যান সোনালি ট্রফির ছোঁয়া নে পেয়েই।
ব্রায়ান লারা : নতুন ক্রিকেট প্রেমিরাও টেস্টে ব্রায়ান লারার রেকর্ড সম্পর্কে জানে। তাই বলে ওয়ানডে ক্রিকেটেও কম যেতেন না প্রিন্স অব পোর্ট অব স্পেন। বহু রেকর্ড এসে লুটোপুটি খেয়েছে তার পায়ে। খুব কম সংখ্যক ক্রিকেটারই পেরেছেন একদিনের ক্রিকেটে ১০ হাজার রান করতে। সে তালিকায়ও রয়েছেন লারা। ক্যারিবিয়ানদের হয়ে ২৯৯টি ওয়ানডে খেলেছেন লারা। এর মধ্যে একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে আছে ৩টি দেড়’শ ছাড়ানো ইনিংস। তবে বিশ্বকাপের দুর্ভাগ্য- ট্রফিটা ছোঁয়া পায়নি ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানের।
ল্যান্স ক্লুজনার : ক্লুজনারের ডাক নাম ছিল জুলু। স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায়- অসম্ভব প্রতিভাধর অলরাউন্ডার। টেস্ট ক্রিকেটে বেশ সফল এই ক্রিকেটার ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজের নাম জানান দেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপে। দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়লেও তিনি হন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। বড় শট খেলার যোগ্যতা আর চতুর বোলিং ওই সময়ে তাকে করে তুলেছিল বিশ্বের সেরা বোলার। ২০০০ সালে উইসডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের মর্যাদায় ভূষিত হন ক্লুজনার। এরপর ২০০৩ সালে ঘরের মাঠে আয়োজিত বিশ্বকাপও প্রোটিয়াদের হয়ে খেলেন তিনি। যদিও দল গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়ার সর্বকালের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডারকে বিশ্বকাপ না জিতেই শেষ করতে হয় খেলোয়াড়ি জীবন।
জ্যাক ক্যালিস : ল্যান্স ক্লুজনারের পর আরেক অভাগা প্রোটিয়া অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিস। কী টেস্ট ক্রিকেট কী ওয়ানডে! ক্যারিয়ার জুড়ে ক্যালিস সমানতালে যেমন রান তুলে গেছেন, তেমনি উইকেটও পেয়েছেন। একদিনের ক্রিকেটে ১১ হাজার রানের পাশাপাশি ২৭৩ উইকেটের মালিক ক্যালিস। তিনি ছাড়া একমাত্র সনাৎ জয়সুরিয়া রয়েছে যিনি কিনা ওয়ানডে ক্রিকেটে ২৫০ উইকেটের পাশাপাশি ১০ হাজার রানের মালিক। রঙিন পোশাকে মোট 8৬টি ফিফটি আর ১৭টি সেঞ্চুরি আছে ক্যালিসের। তবে প্রোটিয়াদের সোনালি যুগের মধ্যে তিনি একজন যাকে বিশ্বকাপ না জিতেই ছাড়তে হয়েছে ২২ গজ।
কুমার সাঙ্গাকারা : বিশ্বকাপ জয়ের জন্য যা করতে হয় তার সবই করেছিলেন কুমার সাঙ্গাকারা। তবে ভাগ্যটা একবারও ফিরে তাকায়নি তার দিকে। নাহয় ২০০৭ ও ২০১১- টানা দুই বিশ্বকাপে রানার্স-আপ থাকতে হয় কেন? বিশ্ব ক্রিকেটে সাঙ্গাকারা যে কত উঁচু মাপের ব্যাটসম্যান তা তিনি নিজেই প্রমাণ করেছিলেন ২০১৫ বিশ্বকাপে। হাঁকিয়েছিলেন টানা ৪ সেঞ্চুরি। যে রেকর্ড আর কারও নেই। এ ছাড়াও ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহে তার চেয়ে এগিয়ে আছেন কেবল একজন। আর সে হলেন এই ফরম্যাটে সর্বোচ্চ রানের মালিক শচীন টেন্ডুলকার।
এবি ডি ভিলিয়ার্স : বিশ্ব ক্রিকেটে আরও এক অভাগা ক্রিকেটারের নাম এবি ডি ভিলিয়ার্স। সর্বকালের সেরাদের একজন হলেও তার ভাগ্য ল্যান্স ক্লুজনার আর জ্যাক ক্যালিসদের মতো পরিনতি লেখা থাকে। টেনিস, হকি আর গলফে সমান পারদর্শী ভিলিয়ার্স পুরো ওয়ানডে ক্যারিয়ার জুড়ে ৫৩.৫০ গড় আর ১০০ এর উপরে স্ট্রাইক রেট রেখে রানের ফুলঝুরি ছুটিয়ে গেছেন তিনি। তবে দলের ব্যর্থতায় বিশ্বকাপ শিরোপায় আর হাত দেয়া হয়নি মি. ৩৬০ ডিগ্রির।
শহীদ আফ্রিদি : পাকিস্তান ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন শহীদ আফ্রিদি। ক্যারিয়ারের শুরুতেই ধূমধাড়াক্কা ব্যাটিংয়ের জন্য পেয়ে যান ‘বুম বুম’ উপাধি। বাকিটা সময়ও এরকম আগ্রাসী ক্রিকেট খেলছেন এই অলরাউন্ডার। ১৯৯৬ সালে মাত্র ৩৭ বলে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বহুদিন যাবত ওয়ানডে ক্রিকেটে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড নিজের দখলে রেখেছিলেন তিনি। এদিকে বোলিংয়েও সমান দক্ষ ছিলেন আফ্রিদি। তার কব্জির স্পিনে বুকে কাঁপন ধরিয়েছে অনেক ক্রিকেটারের। তবে দলের হয়ে কখনো বিশ্বকাপটা আর জেতা হয়নি এই গ্রেটের।
এসএইচএস