স্থানীয় সময়ের ঘড়িতে তখন সকাল ৯টা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের বিশ্বকাপে টিকে থাকার লড়াইয়ের বাকি তখন অল্প কিছুক্ষণ। সেই সময় প্যাড পড়ে এক হাতে ব্যাট বগলদাবা করে অন্য হাতে হেলমেট নিয়ে ড্রেসিংরুম ছাড়লেন দেশসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। টসের বাকি তখন মাত্র ১ ঘণ্টা। আর সাকিব যাচ্ছেন নেটে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করতে।
আগের ম্যাচেই শক্তিশালী ইংলিশ বোলিং লাইনআপকে শাসন করে বিশ্বকাপে নিজের প্রথম শতরান তুলে নিয়েছিলেন সাকিব। যেই মুহূর্তে নিজের ব্যাটিংটা নিয়ে অন্তত তার নির্ভার থাকার কথা, তখনই দলের ব্যাটিং কোচ নেইল ম্যাকেঞ্জি কে নিয়ে সাকিব নেটে নেমে গেলেন নিজের ব্যাটিং আরো ঝালিয়ে নিতে! কোন নেট বলার কিংবা সতীর্থ কোন পেসার নয়, ম্যাকেঞ্জির ছুঁড়তে থাকা একের পর এক বলে কাট, ড্রাইভ ও পুল শটে সাকিবের চোখ মুখ ঠিকরে বেরলো নিজেকে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা।
দলের জন্যও সাকিবের এই ডেডিকেশন কাজে লাগলো বেশ। তার ১২৪ রানে ভর করেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেয়া ৩২২ রানের টার্গেট সহজে উতরে গেল টাইগাররা। এই ম্যাচে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ৬ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন শাকিব। আর তার ইনিংসটাকে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম কার্যকরী ইনিংস তো বলাই যায়!
ইংল্যান্ড এরকম কীর্তি সাকিব আগেও করেছেন। ২ বছর আগেই কার্ডিফে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের দেয়া ২৬৬ রানের টার্গেট পেরিয়ে গিয়ে সেই টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছিল বাংলাদেশ । ওই ম্যাচে ১১৫ বল খেলে ১১৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন সাকিব। তার সঙ্গী মাহমুদুল্লাহ খেলেছিলেন ১০৭ বলে ১০২ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২২৪ রানের জুটি গড়ে কিউইদের টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে দিয়েছিলেন এই দুই ব্যাটসম্যান।
এবার যদিও পুরো ভিন্ন মঞ্চ। সেমিফাইনালের ওঠার লড়াইয়ে থাকতে হলে ম্যাচটা জিততেই হতো বাংলাদেশকে। কন্ডিশন ব্যাটসম্যানদের অনুকূলে থাকলেও স্কোরবোর্ডে ছিল ৩২২ রান তোলার চাপ। তবে কোনো কিছুকেই আমলে নেননি সাকিব। নিজস্ব ছন্দে খেলে লিটনকে নিয়ে ১৮৯ রানের জুটি গড়ে জয়ের বন্দরে নোঙর করেছেন। বল হাতে দুই উইকেটের পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও দুর্দান্ত সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে আবারও দেখিয়েছেন, কেন তিনি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।
৪১ ওভার ৩ বলে জেতা ম্যাচটিতে সাকিব চার মেরেছেন ১৬ টি। অধিকাংশ শটই খেলতে পেরেছেন ব্যাটের মাঝ ব্লেডে। ম্যাচের শুরুতে করা নেট প্র্যাকটিসের মতোই সাকিবের কাট ও ড্রাইভগুলো ছিল দুর্দান্ত।
বিশাল লক্ষ্য তাড়া করার চাপ নিয়ে খেলতে নেমে একটুও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন না সাকিব। উইকেটে এসেই প্রথম বলে অসাধারণ ড্রাইভে ৩ রান নিয়ে ইনিংসের সূচনা করেন, কাভারে থাকা দুই ফিল্ডারের গ্যাপ গলিয়ে বাউন্ডারিতে তুলে নিয়ে করেন নিজের নবম সেঞ্চুরি। ইনিংসের শুরুতে ওশানে টমাসকে পুল শটে যে চারটা মারলেন, এক কথায় চোখ জুড়ানো! ৯৯ বিশ্বকাপের ল্যান্স ক্লুজনার হয়ে যেন ২০১৯ বিশ্বকাপে আবির্ভূত হলেন সাকিব!
সংবাদ সম্মেলনে এসে সাকিব বললেন, 'তারা কেবল দুইটি লেংথে বল করেছে আমাদের; হয় ফুল নয়তো শর্ট। আমরা জানতাম এসবই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তাই আমরা এই চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তাদের শর্ট বল মোকাবিলা করার জন্য আমাদের সব ব্যাটসম্যানদেরই আলাদা পরিকল্পনা ছিল। দারুণভাবে সবার গেমপ্ল্যান কাজে লেগেছে। আমার মনে হয় একের পর এক ভালো লেংথে বল করার মতো ধৈর্যশীল ছিল না তারা।'
দলের হয়ে তিন নম্বরে নেমে এখন আরও বেশি সময় পাচ্ছেন সাকিব। তিন নম্বরে সুযোগ পেয়ে দুর্দান্ত খেলে সেই জায়গাটা সম্ভবত নিজের করেই নিয়েছেন সাকিব। সংবাদ সম্মেলনেও বললেন, বল এখন আগের থেকে অনেক ভালো দেখছেন তিনি।
সাকিব সবসময়ই বলেন, বোলিংটা তার সহজাত আর ব্যাটিংটা তার প্রচেষ্টার ফসল। সেই ফসলকে নিজের অধ্যাবসায় দিয়ে এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন তিনি, যেখানে তাকে নিয়ে এক চুল প্রশ্নও তোলার অবস্থা নেই আর!
এমএইচএস
।