১৯৮৩ সালে প্রথমবারের মতো অংশ নেয় জিম্বাবুয়ে। টেস্ট মর্যাদা না থাকা সত্ত্বেও ১৮৮২ সালে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় আফ্রিকা মহাদেশের এই দেশটি। নিজেদের প্রথম ম্যাচে পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়াকে ১৩ রানে হারিয়ে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। জানিয়ে রাখা দরকার, একইসঙ্গে এটি ছিল জিম্বাবুয়ের অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচ! সেই বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ে বাকি ম্যাচগুলোতে জয়ের দেখা না পেলেও অজিদের হারিয়ে রূপকথার জন্ম দিয়ে বেশ আলোচিত ছিল।
শক্তিশালী সব টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য জিম্বাবুয়েকে যথেষ্ট চরাই উতরাই পার হতে হয়েছিল। নিয়মিত জয় পাওয়া তাদের জন্য মারাত্মক কঠিন ছিল। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে তারা একটি জয়েরও দেখা পায়নি। ১৯৯২ বিশ্বকাপে লো স্কোরিং ম্যাচে মাত্র ১৩৪ রান করেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৯ রানের নাটকীয় জয় পায় তারা। সেবারের টুর্নামেন্টে পাওয়া একটি মাত্র জয় তাদেরকে ওই বছরই টেস্ট মর্যাদা পেতে দারুণ সহায়তা করেছিল।
১৮ অক্টোবর ১৯৯২, হারারে ক্রিকেট গ্রাউন্ডে টেস্ট ইতিহাসের নবম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো জিম্বাবুয়ে। ভারতের বিপক্ষে শুরুটা হলো টসে জিতে আগে ব্যাটিং নিয়ে। টপ অর্ডার ও মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের দারুণ দক্ষতায় প্রথম ইনিংসে ৪৫৬ রান করে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দেয় জিম্বাবুয়ে। অধিনায়ক ডেভ হটনের ১২১ রানের ইনিংসটি ছিল টেস্টে ধৈর্য নিয়ে ব্যাট করার আদর্শ এক উদাহরণ। জিম্বাবুয়ে তো বটেই ক্রিকেট ইতিহাসের দুই বিখ্যাত ভাই গ্র্যান্ড ফ্লাওয়ার ও অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের অভিষেকও এই ম্যাচেই হয়েছিল এবং প্রথম ইনিংসে তারা দুইজনই ফিফটি তুলে নিয়েছিলেন। জবাবে প্রথম ইনিংসে ভারত ৩০৭ রানে অলআউট হলে ১৪৯ রানের বড় লিড পেয়ে যায় স্বাগতিকরা। মিশরে জন্ম নেয়া অফব্রেক বোলার জন ট্রাইকস একাই ভারতের ৫ ব্যাটসম্যানকে প্যাভিলিয়নে ফেরান। তার বলে শচীন টেন্ডুলকার কোনো রান না করেই ফিরতি বলে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে জিম্বাবুয়ে ৪ উইকেটে ১৪৬ রান করার পর ম্যাচটি ড্র হয়ে যায়। নিজেদের অভিষেক টেস্টে ড্র করে নতুন ইতিহাসের জন্ম দেয় জিম্বাবুয়ে। আর কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের এখন পর্যন্ত এমন কৃতিত্ব নেই। শুধুমাত্র ১৮৭৭ সালে ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া।
১৯৯৬ বিশ্বকাপে প্রথম খেলতে আসা কেনিয়ার বিপক্ষে জয় পেলেও গ্রুপ পর্বের বাকি পাঁচ ম্যাচে হেরেছিল জিম্বাবুয়ে। তবে নব্বইয়ের দশকে যারা ক্রিকেটকে কঠিনভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন- তাদের কাছে জিম্বাবুয়ের এই ফলাফল মূল্যায়নের মাপকাঠি কোনোভাবেই হতে পারে না। এই দলটি ওয়ানডে ও টেস্ট র্যাংকিংয়ের নয় নম্বরে ওইসময় অবস্থান করলেও বড় দলগুলোর ঘাম ঝরানো, কয়েকজন বিশ্বমানের খেলোয়াড়ের নৈপুণ্য জিম্বাবুয়েকে অন্যরকম এক সমীহ জাগানিয়া দলে পরিণত করেছিল। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্র্যান্ড ফ্লাওয়ার, অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, গাই হুইটাল, নেইল জনসন, মারে গুডউইন, স্টুয়ার্ট কার্লাইল, হিথ স্ট্রিক, হেনরি ওলাঙ্গা, এডু ব্র্যান্ডেজ, পল স্ট্রাং, পমি মাবাঙ্গুয়া- এসব নাম এখনো অনেক ক্রিকেটপ্রেমীর স্মৃতির মণিকোঠায় সজীব রয়েছে।
তিন বছর পর ১৯৯৯ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ে বিশ্বকে বার্তা দিয়ে রেখেছিল- এবার তারা ক্রিকেট পরাশক্তি হওয়ার পথে রয়েছে। নিজেদের প্রথম ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষে প্রত্যাশিত জয় পাওয়ার পর ভারতকে নাটকীয়ভাবে ৩ রানে হারিয়ে দিয়ে তারা বিশ্বকাপকেই জমিয়ে তোলে। পরের দুই ম্যাচে শ্রীলঙ্কা ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হারলেও হ্যান্সি ক্রনিয়ের শিরোপা প্রত্যাশী দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে তারা সুপার সিক্স পর্বে চলে যায়। পরের পর্বে কোনো ম্যাচ না জিতলেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটি ম্যাচে নেইল জনসন বোলিংয়ের পর ব্যাট হাতেই ওপেন করার ঘটনা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অজিদের বিপক্ষে ২ উইকেট পাওয়ার পর তিনি ১২৩ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে জনসন নিজেকে বিশ্বমানের অলরাউন্ডার হওয়ার পথেই নিয়ে যাচ্ছিলেন।
২০০৩ বিশ্বকাপেও সুপার সিক্সে উঠেছিল জিম্বাবুয়ে। যদিও নিউজিল্যান্ড, কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হেরে তাদের শেষ চারে যাওয়া হয়নি। কেউ ভাবতেও পারেননি এই বিশ্বকাপের একটি ঘটনা তাদের পতনের সূচনা ঘটাবে। জিম্বাবুয়ের তৎকালীন স্বৈরশাসক রবার্ট মুগাবের শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে বিপক্ষে অবস্থানের কারণে খেলতে যায়নি ইংল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে পেয়ে যায় ওয়াকওভার। মুগাবে সরকারের বিপক্ষে নিজেদের অবস্থান জানানোর জন্য কালো আর্মব্যান্ড পরে মাঠে নেমেছিলেন হেনরি ওলাঙ্গা এবং অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। আর তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল মুগাবে সরকার। ফলাফল, ওলাঙ্গা ও অ্যান্ডির অপ্রত্যাশিত এবং দুঃখজনক অবসর। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই তারা ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। তাতেও নাটকের শেষ হয়নি, পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের পর পুলিশ খুঁজছে এমন খবর কানে পৌঁছানো মাত্র ড্রেসিং রুম থেকে পালিয়ে যান ওলাঙ্গা, ছেড়ে যান জিম্বাবুয়ে। স্বৈরশাসক হিসেবে গোটা বিশ্বে নিন্দিত মুগাবে কটাক্ষ করে বলেছিলেন- ওলাঙ্গা জাম্বিয়ার নাগরিক এবং অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার একজন ব্রিটিশ। তারা জিম্বাবুইয়ান নন!
২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ওয়ানডে সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হেরে আসলেও জিম্বাবুয়ের সর্বশেষ শক্তিশালী দলটির বিপক্ষে জয়ের কীর্তি নিয়ে দেশে ফিরেছিল টাইগাররা। তার কয়েকদিন পর জিম্বাবুয়ে সফরে যায় শক্তিশালী শ্রীলঙ্কা। কিন্তু তার আগেই ঘটে যায় ভয়ানক এক ঘটনা। অতি মাত্রায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে জিম্বাবুয়ের জাতীয় দলের প্রায় সব খেলোয়াড় না খেলার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তারা আর কখনোই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলতে নামেননি। পরে খর্ব শক্তির দল নিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অসহায় আত্মসমর্পণ করে বসে জিম্বাবুয়ে। ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বনিম্ন ৩৫ রানে অলআউট হওয়ার রেকর্ডও তারা গড়ে সেই ওয়ানডে সিরিজেই। এখনো সেই রেকর্ড অক্ষত আছে।
পরবর্তীতে ৫ বছর টেস্ট খেলা থেকে তারা আইসিসির সঙ্গে করা এক সমঝোতার মাধ্যমে নিজেদের গুঁটিয়ে রাখে। টাইবু, মাসাকাদজা, চিগাম্বুরা, টেলর, জারভিসদের নিয়ে জিম্বাবুয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। যদিও আগের সেই শক্তি তারা কখনোই ফিরে পায়নি। ২০০৭, ২০১১ এবং ২০১৫ বিশ্বকাপে তাদের উল্লেখযোগ্য সফলতা নেই। ২০১৯ বিশ্বকাপে তো বাছাইপর্ব পার হতে না পারাতে টেস্ট খেলুড়ে দল হয়েও অংশই নিতে পারলো না।
মাঝে মাঝেই ক্রিকেট বোর্ডে অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে আলোচনায় এসেছে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ড। মুগাবে সরকারের পতনের পর দৃশ্যপটে এখন রয়েছেন এমারসন এমনানগাওয়াও। জিম্বাবুয়ের এই বর্তমান প্রেসিডেন্টের হাত থেকেও রক্ষা পায়নি ক্রিকেট। গত ২২ জুন জিম্বাবুয়ে সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বাধ্য হয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এনে সেদেশের ক্রিকেট বোর্ডকে বহিষ্কার করে বলে খবর প্রকাশিত হয়।
স্পোর্টস এ্যান্ড রিক্রিয়েশন কমিশন (এসআরসি) নামক জিম্বাবুইয়ান সরকারের একটি তদন্ত কমিটি জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট (জেডসি) এর বিরুদ্ধে তাদের বোর্ড নির্বাচনে অসদুপায় অবলম্বনের কথা উল্লেখ করে একটি রিপোর্ট দাখিল করে। সেই রিপোর্টের জের ধরেই তাৎক্ষণিক এই সিদ্ধান্ত নেয় জিম্বাবুয়ের ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সভাপতির পদে তাভেঙ্গোয়া মকুহলানির পুনরায় চার বছর মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ ও বোর্ডের নীতিবিরুদ্ধ বলে রায় দেয় এসআরসি।
পরে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ডকে শাস্তি দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি আইসিসি। সরকারের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকায় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থাটির সদস্যপদ হারায় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২.৪ (সি) এবং (ডি) লঙ্ঘন করায় সভামণ্ডলীর সকলের সর্বসম্মতিক্রমে জিম্বাবুয়েকে ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইসিসি। এই আইনে বলা হয়েছে, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিকভাবে দল নির্বাচন এবং যথাযথভাবে ক্রিকেটের শাসন অথবা প্রশাসনে কোনো সরকারের হস্তক্ষেপ থাকতে পারবে না।
জিম্বাবুয়ের কাছ থেকে সদস্যপদ কেড়ে নেয়ার পর আইসিসির চেয়ারম্যান শশাঙ্ক মনোহর বলেছেন, আমরা সহজে আমাদের কোনো সদস্যদের নিষিদ্ধ করতে চাই না। কিন্তু আমাদের অবশ্যই খেলাধুলা থেকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দূরে রাখার বিষয়টি নজরে রাখতে হয়। জিম্বাবুয়েতে যা ঘটেছে তা আইসিসি সংবিধানের গুরুতর লঙ্ঘন এবং আমরা এটি সহ্য করবো না।
সকল ঘটনাপ্রবাহ বিচার-বিশ্লেষণ করে হয়তো এখন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াই যায়, বিশ্ব ক্রিকেট মানচিত্র থেকে জিম্বাবুয়ের হারিয়ে যাওয়া এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার মাত্র। হয়তো পরের প্রজন্ম ইতিহাসে এই দেশটিকে খুঁজে পাবে, ক্রিকেট মাঠে নয়! ক্রিকেট সভ্যতার বিকাশে যেমন দলটির অবদান ইতিহাস কখনো অস্বীকার করতে পারবে না, তেমনি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ একটি দলকে কীভাবে বিলুপ্ত করে দিতে পারে সেই নিকৃষ্ট ঘটনাও জানান দেবে ইতিহাসের পাতা।
আরআইএস