বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটিমাত্র পরিচয় দিয়ে আটকে রাখা যায় না। তিনি একাধারে বাঙালি জাতির মুক্তির পথপ্রদর্শক, একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়লে তাঁর লেখনশৈলীতে অবাক হতে হয়। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ে যেভাবে ভ্রমণকাহিনি বর্ণনা করেছেন, তা রীতিমতো অতুলনীয়। কিন্তু খেলোয়াড় হিসেবে তিনি কলকাতার মোহামেডানের ও এরিয়ান্সের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, শিরোপা জিতিয়েছিলেন ওয়ান্ডারার্সকে—সেই গৌরব খুব একটা সামনে আসেনি। তবে দেশ গঠনের পর এই সফল রাষ্ট্রনায়কের হাতেই গড়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলার ক্রীড়াকাঠামো।
বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন ক্রীড়াপ্রেমী। তিনি ছিলেন গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাবের ফুটবল দলের দলনেতা। পাশাপাশি সংগঠক হিসেবে অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি। পিতার ছোঁয়া বঙ্গবন্ধু পেয়েছেন বাল্য বয়সেই। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। খেলতেন ভলিবলও। তাঁর উদ্যোগেই ১৯৩৭ মিশন স্কুলে গড়ে উঠে ফুটবল ও ভলিবল দল। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লেখেন “মহকুমায় যারা ভাল খেলোয়াড় ছিল তাদেরকে মিশন স্কুলে ভর্তি করাতাম আর বেতন ফ্রি করিয়ে দিতাম।”
পিতার অফিসার্স ক্লাবের বিপক্ষে খেলে মিশন স্কুল ড্র করে পাঁচ দিন। বঙ্গবন্ধু বলেন “ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। সব নামী খেলোয়াড়রা খেলতো। তবে আমাদের দলের ১১ জনই ভালো খেলতো। আমরা নিয়মিত খেলতাম।” কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় প্রস্তাব পান কলকাতার বিখ্যাত দুটি ক্লাব এরিয়ান্স ও মোহামেডানের। যদিও তিনি প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। তবে দেশে ঢাকার একটি শৌখিন ক্লাবে যোগ দেন প্রথমে। পরবর্তী সময়ে খেলেছেন ঢাকার বিখ্যাত ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে। জিতেছেন বগুড়ার জনপ্রিয় এক টুর্নামেন্ট।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ক্রীড়ার উন্নয়নের প্রতি নজর দেন। ১৯৭২ সালে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিবি), যা বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নামে পরিচিত। একই সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট একাদশ বনাম প্রধানমন্ত্রী একাদশের ফুটবল ম্যাচ। বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরী মাঠে গিয়ে খেলা উপভোগ করেন।
১৯৭২ সালে কলকাতার মোহনবাগান ক্লাব ঢাকা সফরে আসে। ঢাকা ক্লাব বনাম মোহনবাগান ক্লাবের ম্যাচে ঢাকা ক্লাব বর্তমান বাফুফে সভাপতি সালাউদ্দিনের গোলে ১-০ ব্যবধানে জয় পায়। বঙ্গবন্ধু খেলা শুরুর আগেই মাঠে ছিলেন। ১৯৭৩ সালে রাশিয়ান ক্লাব মিনস্ক ডায়নামো খেলতে রাজধানীতে এসেছিল। ম্যাচটিতে বঙ্গবন্ধু মাঠে উপস্থিত থেকে ঢাকা ক্লাবের খেলোয়াড়দের উৎসাহ প্রদান করেন।
এ ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ক্রীড়াকে এগিয়ে নিতে শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে গড়ে তোলেন ক্রীড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা। যেটি বর্তমানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ১৯৭৪ সালে জাতীয় সংসদে পাস হয় বাংলাদেশ স্পোর্টস কাউন্সিল অ্যাক্ট। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। বঙ্গবন্ধু নিজে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতেন।
ফুটবলপ্রেমী বঙ্গবন্ধুর আমলেই ১৯৭২ সালে গড়ে উঠে বাংলাদেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাফুফে। ১৯৭৪ সালে বাফুফে ফিফা ও এফসির সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ায় মারদেকা টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু সবাইকে গণভবনে ডেকে নেন। বলেন, “খেলায় জয়লাভের চেয়েও দেশের মানসম্মান অনেক বড়।” ১৯৭৫ সালের ৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব অনুমোদন করেন। যদিও জীবদ্দশায় সেটি পূর্ণাঙ্গ করার আগে ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন বিশ্বের অন্যতম সেরা এই রাজনীতিবিদ।
ছোট থেকেই বঙ্গবন্ধু গণমানুষের সঙ্গে মিশেছেন, তাদের চিনেছেন তার বড় প্রমাণ তাঁর বর্ণাঢ্য ক্রীড়াজীবন। ক্রিকেটে উদীয়মান পরাশক্তির তালিকায় থাকা বাংলাদেশ ফুটবল এবং জাতীয় খেলা হা-ডু-ডুতে এখনো বেশ পিছিয়ে। সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার ক্রীড়াক্ষেত্রে আরও উন্নতি করা সম্ভব, যা পূরণ করবে জাতির পিতার স্বপ্ন।