বাজারে প্রচলিত ৭টি পাস্তরিত দুধে মানব চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। এ ছাড়াও দুধে ফরমালিন ও ডিটারজেন্টের উপস্থিতিও পেয়েছেন। অন্যদিকে, বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্রান্ডের ঘি, ফ্রুট ড্রিংকস, গুঁড়া মশলা-শুকনা মরিচ ও হলুদ, পাম অয়েল, সরিষার তেল ও সয়াবিন তেল বিএসটিআই এর শর্ত পূরণ করেনি বলে জানান তারা। মঙ্গলবার (২৬ জুন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি লেকচার থিয়েটারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেন গবেষকরা।
ফার্মেসি অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের একদল শিক্ষক সম্প্রতি বাজার থেকে এসব খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করে সেগুলোর গুণগত মান পরীক্ষা করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। বিএসটিআই মানের সঙ্গে তুলনা করে এসব খাদ্যপণ্যের পরীক্ষা চালানো হয় বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়।
সম্প্রতি খাদ্যপণ্যের গুণগত মান নিয়ে সরকার ও জনগণের উদ্বেগের কথা চিন্তা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার এবং ফার্মেসি অনুষদের বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে এসব খাদ্যপণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে এসব খাদ্যপণ্যের উপর পরীক্ষাকৃত ফলাফল উপস্থাপন করেন বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক এবং ফার্মেসি অনুষদের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক।
সংবাদ সম্মেলনে পাস্তরিত দুধে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার করা হচ্ছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ফারুক বলেন, পাস্তরিত দুধে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। আমাদের পরীক্ষায় পাস্তরিত দুধের ৭টি নমুনার সবগুলোতেই মানব চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক লেভোফ্লক্সসিন ও এন্টিবায়োটিক সিপ্রোফ্লক্সাসিন এবং ৬টি নমুনাতে এন্টিবায়োটিক এজিথ্রোমাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও অপাস্তরিত দুধের একটি নমুনাতে ফরমালিন এবং পাস্তরিত এবং অপাস্তরিত দুধের ৪টি নমুনায় ডিটারজেন্ট পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, আমরা যে ফলাফল দিয়েছি তা নমুনার ফলাফল। তার মানে এই না যে ঐসব কোম্পানির সব পণ্যই এরকম। এসময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ফার্মেসির অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ, অধ্যাপক রায়হান সরকার প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে সংগৃহিত নমুনা খাদ্যপণ্যের পরীক্ষার ফলাফল:
পাস্তরিত ও অপাস্তরিত দুধ :
পাস্তরিত দুধের ৭টি নমুনা হলো- মিল্কভিটা, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ, প্রাণ, ইগলু, ইগলু চকোলেট এবং ইগলু ম্যাংগো। আর অপাস্তরিত দুধের ৩টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে রাজধানীর পলাশী, গাবতলী ও মোহাম্মদপুর বাজার থেকে।
বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী দুধে ফ্যাট ইন মিল্ক পাস্তরিত ৭টির মধ্যে ৬টিতে কম ছিল। পাস্তরিত এবং অপাস্তরিত ১০টি নমুনাতেই সলিড নট ফ্যাট যে পরিমাণ থাকার কথা পরীক্ষায় এসব দুধে তার থেকে কম পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও এসিডিটি এনালাইসিস বিবেচনায় পাস্তরিত দুধের ৩টি নমুনা এবং অপাস্তরিত দুধের ৩টি নমুনাই মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। টোটাল ব্যাকটেরিয়া মানদণ্ডে পাস্তরিত দুধের ৭টি নমুনার সবগুলোই মানোত্তীর্ণ হতে পারেনি। কলিফর্ম কাউন্টে পাস্তরিত দুধের ২টি মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে এবং স্টেফাইলোকক্কাস স্পেসিজ জীবাণুর উপস্থিতি থাকার কথা না থাকলেও পাস্তরিত দুধের ৫টিতে এটি পাওয়া গেছে।
ঘি :
বাজারে প্রচলিত ৮টি ঘিয়ের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালানো হয়। এগুলো হলো- আড়ং, বাঘাবাড়ি, প্রাণ, মিল্কভিটা, মিল্কম্যান, সমির এবং টিনে বিক্রি হওয়া নামবিহীন দুটি নমুনা। বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ঘিতে জলীয় উপাদান ও আয়োডিন ভ্যালু যতটুকু থাকার কথা রয়েছে এসব নমুনায় তার থেকে বেশি পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও তিলের তেলের কোন উপস্থিতি থাকতে পারবে না উল্লেখ থাকলেও এসব পণ্যের সবগুলোতেই এর উপস্থিতি ছিল। এই বিবেচনায় পরীক্ষায় ৮টি নমুনার সবগুলোই মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে।
ফ্রুট ড্রিংকস :
ফ্রুট ড্রিংকস এর ১১টি নমুনা সংগ্রহ করে বিএসটিআই এর শর্ত পূরণ করে কি না তা পরীক্ষা করা হয়। যেসব পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয় সেগুলো হলো- স্টার শিপ ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংক, সেজন ম্যাংগো ড্রিংক, প্রাণ ফ্রুটো, অরেনজি, প্রাণ জুনিয়র ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংক, লিটল ফ্রুটিকা ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংক, সানড্রপ, চাবা রেড এপল, সানভাইটাল নেকটার ডি ম্যাংগো, লোটে সুইডেন্ড এপল ড্রিংক এবং ট্রপিকানা টুইস্টার।
গবেষকগণ বলেন, বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ফ্রুট ড্রিংকসে টোটাল পেল্ট কাউন্ট থাকতে পারে সর্বোচ্চ ৫০টি। কিন্তু বিশ্লেষণে ১১টি পণ্যের ৭টিতে এই সীমা ছিল ১০০-৩০০টি। কলিফর্ম কাউন্ট না থাকার কথা থাকলেও ১১টি পণ্যের ৩টিতে এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। এ ছাড়াও ফ্রুট ড্রিংকসে ক্ষতিকারক কৃত্রিম মিষ্টিকারক সাইক্লামেট ব্যবহার করা যাবে না উল্লেখ থাকলেও ১১টি পণ্যের সবগুলোতেই এর ব্যবহার ছিল।
গুঁড়া মশলা-শুকনা মরিচ, হলুদ :
বাজারে প্রচলিত ৮টি শুকনা মরিচের গুঁড়া মশলা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালানো হয়। সেগুলো হলো- আরকো, বিডি, ড্যানিশ, ফ্রেশ, প্রাণ, রাধুনি এবং প্লাস্টিক ব্যাগে খোলা অবস্থায় বিক্রি হওয়া নামহীন ২টি।
বিএসটিআই স্টান্ডার্ড অনুযায়ী শুকনা গুঁড়া মরিচে জলীয় উপাদান সর্বোচ্চ ১০ থাকার কথা থাকলেও এসব নমুনার ২টিতে বেশি ছিল। এসিড ইনসল্যুবল এ্যাশ সবগুলোতেই ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।
একই কোম্পানির হলুদের নমুনায়ও বিএসটিআই স্টান্ডার্ড মানা হয়নি। ৮টির ৬টিতে জলীয় উপাদান বেশি পাওয়া গেছে। আর মেটানিল ইয়েলো নামের টেক্সটাইল কালারের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য না হলেও বেশ কয়েকটিতে তা পাওয়া গেছে।
পাম অয়েল :
বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বলে প্রতীয়মান এমন ১০টি নমুনা ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। সেগুলা হলো- মিজান এবং টিনে খোলা বিক্রি হওয়া ৯টি নমুনা। বিএসটিআই স্টান্ডার্ড অনুযায়ী পাম অয়েলে স্যাপনিফিকেশন ভ্যালু, ইনসল্যুবল ইমপিউরিটিজ, পারক্সাইড ভ্যালু ও জলীয় উপাদান সবগুলো নমুনাতেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। এই বিবেচনায় ১০টির সব নমুনাই মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে।
সরিষার তেল :
সরিষার তেলের ৮টি বিভিন্ন নামের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালানো হয়। সেগুলো হলো- রূপচাঁদা, রাঁধুনি, তীর, ফ্রেশ, পুষ্টি, সুরেশ, ড্যানিশ এবং বসুধা। বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সরিষার তেলের স্যাপনিফিকেশন ভ্যালু যত থাকার কথা তার থেকে বেশি রয়েছে ৮টি নমুনার ৩টিতে। পারক্সাইড ভ্যালু ১০ থাকার কথা থাকলেও ৪টি নমুনাতে এর পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ। আর রিলেটিভ ডেনসিটির পরিমাণও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল ৪টিতে। এছাড়া জলীয় উপাদানও বেশি পাওয়া গেছে ৮টি নমুনার সবগুলোতেই।
সয়াবিন তেল :
সয়াবিন তেলের ৮টি নমুনার ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। সেগুলো হলো- রূপচাঁদা, ফ্রেশ, পুষ্টি, তীর, এসিআই পিওর, ভিওলা, মুসকান এবং মিজান।
বিএসটিআই স্টান্ডার্ড অনুযায়ী তেলের এসিড ভ্যালু যতটুকু থাকার কথা দুটি নমুনায় তার থেকে বেশি পাওয়া গেছে। স্যাপনিফিকেশন ভ্যালুর বিবেচনায় ৮টির মধ্যে ৭টি নমুনা মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। ৫টি নমুনায় পারক্সাইড ভ্যালু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। আয়োডিন ভ্যালু ৮টি নমুনায় প্রয়োজনের তুলনায় ৪টিতে কম এবং একটিতে বেশি পাওয়া গেছে। আর রিলেটিভ ডেনসিটি বেশি পাওয়া গেছে ৩টি নমুনাতে। জলীয় উপাদান ৮টি নমুনাতেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। এছাড়া মেটাল কনটেন্ট কপারের ক্ষেত্রে সবগুলোতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি এবং আয়রণের ক্ষেত্রে ৬টিতে বেশি ছিল।
এমআইআর/ এফসি