সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের মূল উৎপাটন এবং জঙ্গিবাদ ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের কঠোর হস্তে দমনে বিশ্বের অন্যতম সফল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে 'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক অনবদ্য সাফল্য গাঁথা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ফ্রান্সের ঐতিহ্যবাহী বার্তা সংস্থা লা ক্রইক্স।একই সঙ্গে সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের আপোষহীন লড়াইকে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।
বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বার্তা সংস্থাটির প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক বিশ্বের প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, যদিও কিছুটা উদ্বেগ এখনও বিরাজমান তবে দক্ষিন এশিয়ার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও তার সরকার যেভাবে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদকে দমন করেছে তা নিশ্চিতভাবেই দেশটির ইতিহাসে এক অনবদ্য সাফল্যের গল্প হিসেবে লেখা থাকবে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত খৃষ্টান মিশনারী ও চার্চগুলোতে দায়িত্বরত ক্যাথলিক মতাবলম্বী ধর্মযাজকদের বরাতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত এক অনুসন্ধানে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের এই সাফল্যের কথা নিজেদের প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরে ফরাসী বার্তা সংস্থা লাক্রইক্স।
প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশে অবস্থানকারী ক্যাথলিক মতাবলম্বী খৃষ্টান ধর্মযাজকদের অভিজ্ঞতার আলোকে আরও তুলে ধরা হয়, ২০১৫-২০১৬ সালে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর তৎপরতা সৃষ্টি ও সন্ত্রাসী ভয়াবহতার বিপরীতে সেই উগ্রবাদীদের নির্মূলে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ও তার প্রশাসনের যুদ্ধ জয়ের নানা তথ্য।
প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য মতে, তৎকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটের তুলোনামূলক বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চের উত্তর রংপুর বিভাগের প্রধান যাজক ব্যারনাবাস হেমব্রম (৪৫) বলেন, আমি রীতিমত চার্চ প্রাঙ্গণের বাইরে চলাচল বন্ধই করে দিয়েছিলাম। কারণ, আমাকে পর পর তিনবার প্রাণনাশের হুমকি সম্বলিত উড়ো চিঠি পাঠানো হয়েছিলো। আমার অপরাধ আমি একজন খৃষ্টীয় ধর্মযাজক। তবে এই হুমকির কথা প্রশাসনকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই পুরো চার্চ চত্বরজুড়ে কঠিন পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। টানা অনেক রাত আমি ভয়ে নির্ঘুম কাটিয়েছে। আমার দিনও কাটতো ভয়ে ভয়ে। আমার ২০ বছরের যাজক জীবনে এতটা আতঙ্কিত সময় আর কখনও কাটাইনি। কিন্তু বর্তমান সময়টা একেবারে বদলে দিয়েছে সবকিছু। বাংলাদেশ সরকারকে এর কৃতিত্ব দিতেই হবে। তারা যেভাবে এই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদকে দমন করেছে তা রীতিমত বিস্মকর।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ যে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ, সেই মতবাদকে অক্ষুন্ন রাখতে এবং এদেশের মানহানি বা অস্তিত্ব ম্লান করতে পারে এমন যে কোনো কিছুর বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের তৎপরতা দৃষ্টান্তমূলক। ২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর একটি বেনামি চিরকুট প্রেরণের মাধ্যমে প্রথম এই ধর্মযাজককে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয় বলেও জানান তিনি।
এই অভিজ্ঞ ধর্মযাজক দাবি করেন যে, বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট একেবারে ভিন্ন। সেজন্য বাংলাদেশ সরকারকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তারা অসাধারণ। তারা সন্ত্রাসবাদী কোনো প্রকার তৎপরতাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেয় না। তাই এখন আর এদেশে সাম্প্রদায়িক কট্টরতা তিক্ততা ছড়ায় না। পাশাপাশি তিনি বলেন, এখনও কিছুটা উদ্বেগ হয়তো রয়েছে। যার কারণ, ব্যর্থ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হিংসাত্মক মনোভাব এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের প্রভাব। তবে বাংলাদেশ সরকার ও এদেশের প্রশাসনের তৎপরতার কারণে সে সকল উদ্বেগও হয়তো শীঘ্রই দূরীভূত হবে।
তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদীতারা ভয়াবহতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হেমব্রম- ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর উত্তর দিনাজপুর জেলার একটি ক্যাথলিক মিশনারীর ইতালিয় ধর্মযাজক ফাদার পিয়েত্রো প্যারোলারির উপর ধর্মীয় সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস দাবিকৃত হামলার প্রেক্ষাপটটি তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন ২০১৬ সালে লুক সরকার ও সুনীল গোমেজ নামক দু'জন ক্যাথলিক ব্যক্তির উপর উগ্রবাদী গোষ্ঠীর হামলার বিষয়টিও।
তিনি বলেন, খৃষ্টান মিশনারীগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষাপ্রসারে নিবেদিত। তারা উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবেই খৃষতান মিশনারী ও চার্চে কর্তব্যরত ব্যক্তিদের উপর হামলা পরিচালনা করে। যেহেতু বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, সেক্ষেত্রে এধরণের সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা ও আগ্রাসন চলতেই থাকবে বলেই এক সময় মনে হতো। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার প্রমাণ করেছে যে, ধ্বংসাত্মক কাজ যে বা যারাই করুক ধর্ম বা জাতীয়তা, কোনো হিসেবেই তাদের ছাড় দেয়া হবে না।
বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, যদিও এই উগ্রবাদীতার প্রভাব ২০১৫-১৬ বছরজুড়ে ব্যাপকতা ছড়ায় কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধর্ম সন্ত্রাসের উত্থান হয় মূলত ২০১৩ সাল থেকে। সে সময় লাগামহীনভাবে যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের বিস্তার শুরু হয় তা এদেশের অস্তিত্বকে প্রায় গ্রাস করে নিচ্ছিলো। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সন্ত্রাসীদের সেই নেটওয়ার্ক একেবারে ভেঙে পড়েছে। একথা সুস্পষ্টভাবেই বলা যায় যে, ইসলামকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে এই উগ্রবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তাদের গোড়াপত্তনের চেষ্টা চালায়, এদেশের মানুষের ধর্মীয় স্পর্শকাতরতাকে পুঁজি করে। তবে রাষ্ট্রকে এই ঘৃণ্য সন্ত্রাসবাদের হাতা থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশের সরকার, প্রশাসন ও জনগণ যেভাবে সমন্বিত প্রতিরোধ গড়েছে তা পৃথিবীর যেকোন রাষ্ট্রের জন্য সন্ত্রাস মোকাবিলার একটি অনুসরনীয় প্রক্রিয়া।
প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের হলিআর্টিসান ক্যাফেতে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার ইস্যুটি তুলে ধরে বলা হয়, এই ঘটনায় অনেক বিদেশী নাগরিকের প্রাণহানি ঘটে যা আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে পারতো। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতা ও বিভিন্ন প্রশাসনিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়।
হলিআর্টিসানে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা রোধে সে সময় সমন্বিত বাহিনীর একটি বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দুইজন দুঃসাহসী বীরসেনানি সেই অভিযানে শহীদও হন। যা এই প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের প্রতি দেশটির সেনা ও পুলিশসহ প্রশাসনের সকল শাখার সদস্যদের নিবেদিত দেশপ্রেমের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখিত হয়। পাশাপাশি এই সফল অভিযানের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সন্ত্রাসী তৎপরতা রোধে যে সাফল্যের নজির স্থাপন করেছে তা বিশ্বের অনেক বড় বড় রাষ্ট্রের পক্ষেও দুঃসাধ্য ব্যাপার।
বাংলাদেশের (ঢাকা ভিত্তিক) নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এম. সাখাওয়াত হোসেনের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সামগ্রিক প্রেক্ষপট বিচারে এ কথা সত্যি যে এখনও হয়তো বাংলাদেশ থেকে এসকল ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনগুলো একেবারে বিলুপ্ত হয়নি তবে দেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের যে লাগামহীন উত্থান শুরু হয়েছিলো তা বর্তমান সরকারের দৃঢ়তার ফলে সম্পূর্ণ নিয়নন্ত্রে আনা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে এ ধরনের অপতৎপরতা সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের ব্যাপারে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, যতদিন পর্যন্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বুক থেকে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণভাবে নির্মূল না হচ্ছে ততোদিন পর্যন্ত এদেশের সরকার, প্রশাসন এবং জনগণকে সোচ্চার থাকতে হবে । আর একান্ত যদি কোনো দুর্যোগ আসে, তাহলে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, এদেশের সেনা ও প্রশাসনের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলবে বাংলাদেশের কোটি জনতা। ঠিক যেভাবে একটি শক্তিশালী নেতৃত্বের অধীনে এক সময় সর্বস্তরের মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় অর্জিত হয়েছিলো বাংলাদেশেরম স্বাধীনতা।
সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার, নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, এখন পর্যন্ত এধরনের সন্ত্রাসবাদী হামলা মোকাবিলায় বিশ্বের সফলতম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও এদেশের সরকারের বিশেষ কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি 'অনবদ্য সাফল্যের গল্প' হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। যা সন্দেহাতীতভাবে সারা বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ, এদেশের জনগণ এবং দেশের সুযোগ্য নেতৃত্ব তথা বর্তমান সরকারের জন্য বিশেষ মর্যাদার।
সূত্র: লা ক্রইক্স ইন্টারন্যাশনাল