• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১৩, ২০২১, ০১:৪৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১৩, ২০২১, ০১:৫৬ পিএম

বেপরোয়া ঈদযাত্রা

ফের করোনা সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা

ফের করোনা সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা

করোনার সংক্রমণের মধ্যেই সরকারি ‘বিধিনিষেধ’ উপেক্ষা করে বাড়ির পথে ছুটছে লাখ লাখ মানুষ। ঈদ কেন্দ্র করে মার্কেট-শপিং মলগুলোতেও দেখা যাচ্ছে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। অথচ দুই জায়গার কোথাও মানা হচ্ছে না ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি। ফলে ঈদের পর ফের সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। এরই মধ্যে আবার দেশে শনাক্ত হয়েছে করোনার ‘ভারতীয় ধরন’। ফলে প্রতিবেশী দেশটির মতো মানবিক বিপর্যয়ের উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে দেশে আছড়ে পড়ে করোনার সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ। ৫ শতাংশের নিচে থাকা দৈনিক শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ৪ শতাংশে। প্রতিদিন ভাঙতে থাকে সংক্রমণ ও মৃত্যুর রেকর্ড। এমতাবস্থায় গত ৫ এপ্রিল ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ জারি করে সরকার। কিন্তু নানা কারণে সেটি ফলপ্রসূ না হওয়ায় গত ১৪ এপ্রিল থেকে জারি করা হয় ‘সর্বাত্মক লকডাউন’। এতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে সংক্রমণ।

করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার যখন নিম্নমুখী, তখন জীবন ও জীবিকার কথা চিন্তা করে মার্কেট ও শপিং মলগুলো খুলে দেয় সরকার। অনুমতি দেওয়া হয় জেলার ভেতর গণপরিবহন চলাচলের। কিন্তু সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পর মার্কেটগুলোতে ঢল নামে ক্রেতাদের। পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করতে বাড়ির পথে ছুটতে থাকে মানুষ। যাত্রীবাহী ট্রেন, লঞ্চ ও দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় ভেঙে ভেঙেই গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে তারা।এ জন্য গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়াও।

সাধারণ মানুষের এই ঈদযাত্রায় পুরোপুরি উপেক্ষিত ছিল স্বাস্থ্যবিধি। যানবাহনগুলোতে গাদাগাদি করে ঢাকা ছেড়েছে লাখ লাখ মানুষ। ফেরিগুলোতে মানুষের এত চাপ ছিল যে তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত ছিল না। এরই মধ্যে ৮ মে দেশে শনাক্ত হয় করোনার ভারতীয় ধরন। ভারতফেরত দুইজনের শরীরে (বি ১.৬১৭.২) ধরনটি পুরোপুরি পাওয়া যায়। আরও চারজনের শরীরে এই ধরনটির কাছাকাছি ভাইরাস শনাক্ত হয়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার এই ভারতীয় ধরন সাধারণের চেয়ে ২০ গুণ দ্রুত সংক্রমিত হয়। এটি করোনার টিকা নেওয়া মানুষকেও সংক্রমিত করতে পারে। তাই সাধারণ মানুষের এই ঈদযাত্রার মধ্যে এটি যদি একবার ছড়িয়ে পড়ে তাহলে দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে যাবে। মানবিক বিপর্যয়ের মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে।

১১ মে অনলাইনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “ঈদকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ যেভাবে বাড়ি ফিরছে, এতে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। আমরা নিজেদের সর্বনাশ নিজেরা ডেকে আনছি। অথচ দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল।”


করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ হচ্ছে মানুষের ভিড়, একজনের সঙ্গে অরেকজনের গাদাগাদি। যেটা ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটা এবং ঈদযাত্রাতে সর্বত্র হচ্ছে। এই অবস্থায় ঈদের পরে সংক্রমণের একটি বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ। জাগরণ অনলাইনকে তিনি বলেন, “স্বাস্থ্যবিধি না মেনে সাধারণ মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে দলে দলে বাড়ি যাচ্ছে, এতে ঈদের পর সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ আসার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। মে মাসের শেষ সপ্তাহ বা জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে।”

ডা. এম এ আজিজ আরও বলেন, “ভারত টিকা ও অক্সিজেন উৎপাদন করে। সেগুলো রপ্তানিও করে। কিন্তু তারপরও তাদের দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সেখানে আমাদের দেশে যদি করোনার ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের আরও ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হতে পারে।”

সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারের যেমন করণীয় আছে, তেমনি সাধারণ মানুষেরও দায়িত্ব আছে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, “করোনা মোকাবিলায় সরকার বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু মানুষ সেটা মানছে না। সবার উচিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সরকারকে সহযোগিতা করা। তা না হলে নিজেরাও বিপদে পড়বে, সঙ্গে পরিবার ও দেশকে বিপদে ফেলবে।”

তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলে জাগরণ অনলাইনকে জানিয়েছেন হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি জানান, যখন সংক্রমণ টানা তিন থেকে চার সপ্তাহ ৫ শতাংশের নিচে থাকে, তখন এটাকে নিয়ন্ত্রণে আসা বলে। নিয়ন্ত্রিত হওয়ার পর যদি আবার সংক্রমণ বাড়ে, তাহলে সেটাকে আরেকটি নতুন ঢেউ বলা যায়। কিন্তু দেশে এখনো দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে তৃতীয় ঢেউয়ের কথা এখনই বলা যাবে না।

ঈদের পর সংক্রমণের একটি বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে মনে করেছেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ হচ্ছে মানুষের ভিড়, একজনের সঙ্গে অরেকজনের গাদাগাদি। যেটা ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটা এবং ঈদযাত্রাতে সর্বত্র হচ্ছে। এই অবস্থায় ঈদের পরে সংক্রমণের একটি বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই যদি কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের দেশেও ভারতের মতো ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি হতে পারে।”

ডা. লেলিন চৌধুরী আরও বলেন, “ঈদ বাঙালির একটি আবেগের জায়গা। যার কারণে মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। সরকারের উচিত, একেবারেই সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া অথবা স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষকে যেতে দেওয়া। কিন্তু সরকার দুটোর একটিও করল না। বরং জনচলাচল সীমিত করার নামে একধরনের হযবরল অবস্থা তৈরি করা হয়েছে।”

সাধারণ মানুষকে ঠিকমতো মাস্ক পরিধান করার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, “কারও শরীরে করোনার ন্যূনতম লক্ষণ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করা উচিত। পাশাপাশি সরকারের উচিত দেশের সর্বত্র বিশেষ করে ভারতীয় সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে বেশি করে করোনা পরীক্ষা করা। যাতে সংক্রমণ কম ছড়ায়। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা প্রদান ও ঘন ঘন করোনার জিনোম সিকোয়েন্স করা প্রয়োজন। যাতে করে করোনার ভারতীয় ধরন সারা দেশে না ছড়ায়।”

করোনার ভারতীয় ধরন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. বে-নজির আহমেদও। জাগরণ অনলাইনকে তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দেখছে, আশঙ্কা প্রকাশ করছে। কিন্তু তাদের শুধু দেখলে বা আশঙ্কা প্রকাশ করলে হবে না। তাদের কাজ করতে হবে। পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।”

মানুষের বাড়ি যাওয়া ঠেকাতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা মোটেও যথাযথ হয়নি। ধরতে গেলে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী যখন ঘোষণা দিলেন, যে যেখানে আছে, সেখানে ঈদ করতে হবে, তখন আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচিত ছিল অন্যান্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার, প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নিয়ে মাঠে নামা। একটা পরিকল্পনা করা। আমাদের আর্থসামজিক ও পারিবারিক অবস্থা বোঝা। কিছু মানুষ বাড়ি যাবেই। যার বাড়িতে ছেলেমেয়ে আছে, সে হেঁটে হলেও বাড়ি যাবে। তাই সরকারের উচিত ছিল এসব মানুষকে নিরাপদে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া।

প্রশাসনে ক্রমান্বয়ে যোগ্য ব্যক্তির অভাব বাড়ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সরকার যদি সত্যিই মনে করত, ঈদে মানুষ বাড়ি গেলে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে, তাহলে তাদের উচিত ছিল কারফিউ দেওয়া। যাতে কেউ রাস্তায় না নামতে পারে। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। আমরা ধনে-মানে এগোচ্ছি। কিন্তু ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে আমরা আগের চেয়েও খারাপ আছি।”