গত এক বছরের বেশি সময় ধরে সমালোচনা যেন পিছু ছাড়ছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। কখনো করোনার সংক্রমণ মোকাবেলায় ব্যর্থতা, কখনো বা স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনা, কখনো অনিয়ম-দূর্নীতি, কখনোবা টিকার সংগ্রহ ও চুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা। সব মিলিয়ে করোনার সংকটকালে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়টি এখন আলোচনার শীর্ষে!
সর্বশেষে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের ঘটনায় শুধু দেশে নয়, বিদেশের গণমাধ্যমেও এখন খবরের বিষয় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। করোনা ও রোজিনা ইসলামকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যখন আলোচনার তুঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, তখন সেই আলোচনার পালে হাওয়া দিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গত সোমবার (১৭ মে) পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হাতে নির্যাতন ও হেনস্তার শিকার হন সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম। তাকে মন্ত্রণালয়ের মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। এক পর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাত ৮টার দিকে রাজধানীর শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরির অভিযোগে মামলা এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এই ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে পুরো সাংবাদিক সমাজ। রোজিনা ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তি ও হেনস্তাকারীদের শাস্তির দাবিতে গত কয়দিন ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করছে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। এমনকি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল।
সাংবাদিক নেতারা মনে করেন, সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ কয়েকটি আলোচিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করায় রোজিনা ইসলাম রোষের শিকার হয়েছেন। তবে এত কিছুর পরও নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষ নিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি এই ঘটনার জন্য ভুক্তভোগী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকেই দায়ী করেছেন।
গত মঙ্গলবার (১৮ মে) এক ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেন, সম্প্রতি করোনার টিকা বিষয়ে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যে চুক্তি হয়েছিল, সেসব গোপন চুক্তির নথির ছবি তোলা ও কিছু নথি চুরি করে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন রোজিনা ইসলাম। যা প্রকাশ হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও টিকা না পাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতো। তাই তাকে আটক করে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা করা হয়েছে।
তবে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা ও গ্রেপ্তারের ঘটনাকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। বৃহস্পতিবার (২০ মে) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সঙ্গে হওয়া ঘটনা দুঃখজনক। সাংবাদিকরা সরকারের অংশ। সরকারের লুকানোর মতো কিছু নেই।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, “স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গুটিকয়েক কর্মকর্তার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের বদনাম শুনতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে আর এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে।”
এ সময় সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম আদালতে সুবিচার পাবেন বলেও আশা করেন এ কে আব্দুল মোমেন।
শুধু রোজিনা ইসলামের ঘটনা নয়, টিকা নিয়ে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির বিষয়েও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী। তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কারণে চীন ও রাশিয়া থেকে করোনাভাইরাসের টিকা পেতে দেরি হচ্ছে। কারণ, দেশ দুটির কাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে টিকা পেতে যেসব প্রক্রিয়া শেষ করার কথা, তা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেরি করেছে।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চীনের সঙ্গে টিকা ক্রয়সংক্রান্ত চুক্তির কাগজে ইংরেজির পরিবর্তে চীনা ভাষার অংশে স্বাক্ষর করেছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, “আমরা চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা করছি। চীনের বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। চীন আমাদের কাছে তিনটি ডকুমেন্ট পাঠিয়েছিল। এর মধ্যে আমরা দুটি ডকুমেন্ট তাদের ফেরত পাঠিয়েছি। দুটির মধ্যে একটি কালকে ফেরত পাঠিয়েছি, যেখানে একটি অংশ ছিল ইংরেজিতে এবং আরেকটি ছিল চীনা ভাষায়। আমরা (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়) সই করে ফেরত পাঠানোর সময়ে চীনা ভাষার অংশে সই করেছি।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই ভুলের জন্য একজন চীনা ভাষার অভিজ্ঞ অধ্যাপককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, “ডকুমেন্টটি সংশোধনের জন্য একজন অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়েছে। দিস আর লাউজি ওয়ার্ক এবং এটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু যোগাযোগ করিয়ে দেয়। অন্য সব বিষয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেখে। সেখানে একটু দেরি হচ্ছে।”
রাশিয়ার কাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে টিকা ক্রয়ের বিষয়েও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সময়ক্ষেপণ করছে বলে জানান এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, “রাশিয়ার সঙ্গে কিছু ডকুমেন্ট সই হয়েছে এবং কিছু হয়নি। শুরুতে তাদের কাছে থেকে টিকা নিতে একটি সংখ্যা বলা হয়েছিল এবং পরে আবার সংখ্যা বদল করা হলো। রাশানরা এটি পছন্দ করে না। আপনি বললেন আমি এত আনব। পরে বললেন আমি কমিয়ে আনব। এগুলো নিয়ে আমরা ব্যস্ততায় আছি।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এসব সমালোচনার জবাবে অবশ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোন মন্তব্য করেনি।