বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় যোগাযোগ প্রকল্প পদ্মাসেতু। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এই সেতুর মাধ্যমেই দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে জোড়া লাগল রাজধানীর। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষায়। একদিন পরই জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে খুলবে দিন বদলের করিডোর।
২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বরে মূল সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রমত্ত পদ্মার মাটির গভীর থেকে শুরু হয় কাজ। এরপর নানা উপকরণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে পদ্মাসেতুর পূর্ণাঙ্গ অবয়ব। স্বপ্ন এখন সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। উদ্বোধন হবে একদিন পরই; ২০২২ সালের ২৫ জুন। সে হিসাবে, পুরো সেতু নির্মাণে সময় লেগেছে মোট ২ হাজার ৭৬৮ দিন। আরেকটু বিস্তারিত বললে, ৬৬ হাজার ৪৩২ ঘণ্টা!
পদ্মাসেতুতে সর্বমোট ৬০টি দেশের উপকরণ ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে চীন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, লুক্সেমবার্গ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ উপকরণ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আরো প্রায় ৫০টি দেশের কিছু না কিছু উপকরণ এতে ব্যবহার হয়েছে।
এই নদীতে প্রবাহিত পানির পরিমাণ, নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা এবং তলদেশে মাটির ধরন - এসব কিছুর কারণে এর উপর সেতু নির্মাণ করা ছিল অসম্ভব রকমের কঠিন এক কাজ। এটি কত বড় প্রজেক্ট ছিল, তা বোঝা যায় বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখেই। এই প্রকল্পে একসঙ্গে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার মানুষ কাজ করেছে।
পদ্মাসেতু নির্মাণ করতে গিয়ে ধাপে ধাপে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে এবং সেসব সামাল দিতে পরিবর্তন করতে হয়েছে সেতুর নকশাও। প্রায় নয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু (মূল সেতু ৬.১৫ কিলোমিটার) নির্মাণে বিশ্বের অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
শুধু মূল সেতুতে প্রায় ২ লাখ ৮৯ হাজার টন স্টিলের প্লেট লেগেছে, যার সবই এসেছে চীন থেকে। এছাড়া মূল সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণে রডের ব্যবহার হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার টন। গর্বের বিষয় হচ্ছে, এসব রডের সবই দেশীয়। পদ্মাসেতুকে ভূমিকম্প সহনীয় করতে সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিশেষ ধরনের বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। মোট বিয়ারিং লেগেছে ৯৬ সেট। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, সবচেয়ে বড় বিয়ারিংটির ওজন ১৫ টন।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় সাত লাখ টন; এর সবই দেশে উৎপাদিত। সব সিমেন্ট একসঙ্গে ৫ টন ক্ষমতার ট্রাক দিয়ে পরিবহন করা হলে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার ট্রাকের প্রয়োজন হতো। পুরো নির্মাণকাজে মোট বালু ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় ৬৫ লাখ ঘনমিটার, যা দিয়ে ১৯ কোটি ১২ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুট আয়তনের ভবন তৈরি করা যাবে। এছাড়া সেতুর ওপর রাস্তার ঢালাইয়ের প্রায় ২ হাজার ১০০ টন বিটুমিন লেগেছে। এই উপকরণও দেশ থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে।
সেতুতে ব্যবহার করা কংক্রিটের কিছু পাথর দেশ থেকে নেয়া হয়েছে। বেশিরভাগই আনা হয়েছে ভারত, ভুটান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। কংক্রিটের গুণগত মান যাচাই করে তারপর কাজ করা হয়েছে।
সেতুর নিচে নদীতে ৪০টি ও দুই পাড়ে দুটি পিয়ার (খুঁটি) বসানো হয়েছে। সেতুকে টেকসই করতে নদীর অংশের খুঁটির নিচে চীন থেকে আনা তিন মিটার ব্যাসার্ধের ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত ইস্পাতের পাইল বসানো হয়েছে; যা বিশ্বের সবচেয়ে গভীর ও মোটা পাইল।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বসুনিয়া বলেন, “দেশীয় যে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করেছে, তারা খুব স্মার্টলি কাজ করেছে। তাদের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। শুধু তারা যথাযথ ইকুইপমেন্ট পাচ্ছে না।”
পদ্মাসেতু বাংলাদেশের জন্য এটি নেশন বিল্ডিং প্রজেক্ট। দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সড়ক পথে যুক্ত করবে এই সেতু। বদলে দেবে অর্থনীতির চেহারা।