• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০১৯, ০৬:৫২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ২, ২০১৯, ০৬:৫২ পিএম

আইএসের খিলাফত প্রতিষ্ঠা! 

আইএসের খিলাফত প্রতিষ্ঠা! 

হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মদিনায় খেলাফতের ভিত্তি স্থাপন করেন। তার ইন্তেকালের পর অনেক তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে খেলাফতের প্রথম খলিফা নিযুক্ত হন হযরত আবু বকর (রা.)। সেই থেকে রাশিদুন খিলাফত নামে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। এর পর হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.), হযরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) এবং হযরত আলী (রা.) এ খিলাফতের কর্ণধার হন। কিন্তু মাত্র ৩০ বছরেই শেষ হয়ে যায় সেই রাশিদুন খিলাফতের শাসনকাল। 

এর পর হযরত মুয়াবিয়া (রা.) কর্তৃক উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠা, তারপর গড়ে ওঠে আব্বাসীয় ও উসমানীয় খিলাফত। বহু উত্থান-পতনের পর ১৯২৪ সালে সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদকে নির্বাসিত করে কামাল আতাতুর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে সেই খিলাফতের বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। ইসলামি খিলাফতের সেই সুখস্মৃতি মুসলমানরা আজও ভুলতে পারেননি। তাদের ভুলতে না পারার অনেক কারণও আছে। সেই স্বপ্নের খিলাফত প্রতিষ্ঠায় তাই তারা এখনও জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। আইএস (ইসলামি স্টেট) নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইরাক-সিরিয়াসহ সমস্ত বিশ্বে তারা সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন । 

কিন্তু আইএসের নিবেদিতপ্রাণ (!) কর্মীরা যে ধরনের খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন, তা ইসলামের স্বর্ণযুগের সেই খিলাফতের সঙ্গে কোনোভাবেই মেলে না। ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার নামে মধ্যপ্রাচ্যসহ সমস্ত বিশ্বে তারা যেভাবে নিরীহ মানুষজন হত্যাযজ্ঞে মেতেছেন, তা কিছুতেই বিবেকবান কোনো মানুষ সমর্থন করতে পারেন না। তাদের আত্মপ্রকাশ বা উত্থানের ঘটনাও একেবারে প্রশ্নহীন নয়। নব্বইয়ের দশকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ আর অস্ত্র ব্যবসা বিস্তারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হাতে একে একে তালেবান, আল কায়েদা কিংবা আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠনের জন্ম কীভাবে হয়েছে, তা এখন আর কারোর অজানা নয়। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পড়ন্ত অর্থনীতির লাগাম টেনে ধরা এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করাই ছিল এসব সংগঠনের মাধ্যমে অস্থির বিশ্ব তৈরি করা। যাতে অস্ত্রের জমজমাট ব্যবসা করা যায়। সে প্রক্রিয়াই এখন সারাবিশ্বে জারি রয়েছে।

বিশ্বব্যাপী এসব জঙ্গি-সন্ত্রাসের নতুন মাত্রা পায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার পর। অবশ্য বিশ্বমোড়লরা এর অনেক আগে থেকেই জঙ্গিবাদের মাত্রা বৃদ্ধি করতে নানা ক‚টকৌশল জারি রাখে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সেই সন্ত্রাস-কার্যক্রমের সূচনা। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ দখল এবং অস্ত্র বিক্রির উদ্দেশ্যেই পশ্চিমাবিশ্ব এ খেলা খেলে চলেছে। এর প্রেক্ষাপটে আমরা ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় একের পর এক আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করে চলেছি।

ধর্মীয় কুসংস্কার এবং তাদের দারিদ্র্যকে পুঁজি করে বিশ্বমোড়লরা এসব অঞ্চলের তরুণ সমাজকে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধের কাজ অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি তাদের দেখানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লোভ। এরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দ্বারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায়। আমরা দেখেছি, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে তালেবানরা শরিয়া আইনের নামে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। যার পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল পাকিস্তানের সোয়াত ভ্যালির কিশোরী শিক্ষার্থী মালালা ইউসুফজাই কিংবা আফগান নারীদের। বর্তমানে আইএস ইরাক ও সিরিয়া ইসলামিক রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও সেখানে তাদের মনোমতো ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠা করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশেও এ ধরনের জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলা শুরু হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় জেএমবির সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। সেই সময় দেশের আদালত চত্বর ও পুলিশ ফাঁড়ির সামনে বোমা বিস্ফোরণে বহু মানুষকে হতাহত করা হয়। এরপর আচমকা ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে একদল সশস্ত্র জঙ্গি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভয়াবহ হামলা চালায়। সেই হামলায় কয়েক ইতালীয়, জাপানি ও ভারতীয় নাগরিকসহ ২২ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। তারা এ ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডটি চালায় ‘ইসলামি খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার নামে এবং তারা নিজেদের মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের সদস্য বলে দাবিও করে। 

শুধু গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতেই এ ধরনের লোমহর্ষক ঘটনা নয়, শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে বোমা হামলায় বহু মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটায়। এ ছাড়া শিয়া মসজিদে হামলা, সংখ্যালঘু হত্যা, গির্জার পুরোহিতকে হত্যা কিংবা নোয়াখালীর মসজিদের ইমামকে গলা কেটে হত্যা- এসব সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কোনোই সম্পর্ক নেই। সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি জনগণের সহায়তায় এসব জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দমন করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। সম্প্রতি গুলশান হামলা ঘটনার রায় হয়েছে। শোলাকিয়া আক্রমণের বিচারও চলছে।

হলি আর্টিজানের হামলা মামলার রায়ে আমরা সবাই খুশি। রায়ে সাত জঙ্গিকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়েছে। একজন খালাস পেয়েছে। এ রায়ে গোটা জাতির প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে। এ হত্যাকাণ্ডে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজের প্রভূত ক্ষতিসাধিত হয়েছিল। কিছুদিন বাংলাদেশের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ থমকে গিয়েছিল। এ রায় দেশের সেই ভাবমূর্তি উদ্ধারে কিছুটা হলেও সহায়তা করবে।

জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসবাদ আজ বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা। সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা প্রমাণ করে যে- সন্ত্রাসীদের কোনো দেশ নেই, কোনো সীমানা নেই। যদিও আইএস ইরাক ও সিরিয়াকেন্দ্রিক; কিন্তু যে কোনো আত্মঘাতী হামলাকে আইএসের কাজ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফ্রান্সের প্যারিসে ভয়াবহ হামলা, জার্মানিতে হামলা, যুক্তরাষ্ট্রের সমকামীদের নাইট ক্লাবে বন্দুকধারীদের হামলা, ভারতের মুম্বাই হামলা, শ্রীলংকায় সিরিজ বোমা হামলা, আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনী ও সাধারণ মানুষের ওপর নিয়মিত হামলা প্রমাণ করে ইউরোপ থেকে এশিয়া- আজ কোনো দেশই এদের হামলা থেকে নিরাপদ নয়।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। প্রায় ১৪শ’ বছর আগে আরবজাহানে যখন জাহেলি যুগ ছিল; যখন মানুষে মানুষে হানাহানি-মারামারি এবং কন্যাসন্তান জন্ম নিলে জীবন্ত মাটিচাপা দেওয়া হতো- তখন মানবতার মহান দূত আল্লাহর রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব। যিনি দেখিয়েছেন- ইসলাম কীভাবে সমাজে নারীর অধিকার দেয়, মানুষের প্রতি মানুষের দয়ামায়া-ভালোবাসা বিনির্মাণ করা যায়। সুতরাং ইসলামে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই। আজকে যারা ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার নামে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় নিয়েছেন, বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন- তারা হয়তো বিপথগামী, নয়তো জেনেশুনে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থে মুসলমান তরুণদের চরমপন্থার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন।

তাদের এসব কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বিশ্বের মুসলমানরাই। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয়ভাবেই প্রতিনিয়ত মুসলমানরা তাদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছেন। এতে লাভবান হচ্ছেন কারা? কারা তাদের ভুলপথে চালিত করে এর সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন? টুইন টাওয়ার ধ্বংস এবং বিধ্বংসী অস্ত্র রাখার অজুহাতে ইরাকে ১০ লাখ মানুষের প্রাণ গেল। আফগানিস্তান যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত, লিবিয়া গৃহযুদ্ধে ছিন্নভিন্ন, মিসর আজ গণতন্ত্রের কবরে পরিণত। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশেই চলছে রক্তের হোলিখেলা।

এসব জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা যে ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন, জেলে যাচ্ছেন, ফাঁসিতে ঝুলছেন, শত্রুপক্ষের গোলাবারুদে বুক ঝাঁঝরা করছেন- সেই ইসলাম আর আল্লাহ-রসুলের ইসলাম এক নয়। বর্তমানে ইসলামের নাম করে আইএস, বোকো হারাম, আল কায়েদা, ইখওয়ান, তালেবানরা যা করছে- তার মধ্যে প্রকৃত ইসলামের ছিটেফোঁটাও নেই। সুতরাং একে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যারা জীবন দিচ্ছেন, সম্পদ দিচ্ছেন, পরিবারকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন- তারা যে ভস্মে ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন তাতে সন্দেহ নেই। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ঠাণ্ডা মাথায় দেখার অনুরোধ রইল।

লেখক : সাংবাদিক