‘বাংলাদেশের সবুজ ভূখণ্ড অবশ্যই লাল করে দিতে হবে’ পাকিস্তানি সেনাদের প্রতি জেনারেল রাও ফরমান আলীর এটা ছিল লিখিত আদেশ। হানাদাররা ১৯৭১-এ তেমনটাই করেছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন, তখন বাংলাদেশের সর্বত্র ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ধ্বংসলীলা। মানুষের মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের অভাব ছিল তীব্র। কলকারখানায় উৎপাদনও বন্ধ। সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থা পুরোপুরি চালু করা এবং এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করাসহ সমস্যা ছিল অগণিত। ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে এক বৈঠকে দেশের অবস্থার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ঠিক এভাবে ‘আমি সাড়ে সাত কোটি মানুষ পেয়েছি, যাদের কিছুই নেই। আমি ৫ হাজার ৩০৩টি রান্নাঘর বসিয়েছি। প্রতিদিন এক লাখ লোককে খাবার দিই। দুর্ভাগ্যবশত আমার বহু লোক প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। এর জন্য অংশত দায়ী পাকিস্তান। কারণ তারা আমার কাছ থেকে সবকিছুই নিয়ে গেছে।’ সে সময় বিদেশি গবেষকদের ধারণা ছিল ‘বাংলাদেশের পঞ্চাশ লাখ মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাবে। দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।’ কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। অসংখ্য বাধা মোকাবিলা করেও সাফল্য আনার সক্ষমতা যে এ দেশের মানুষের রয়েছে, এটি বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত পথে সবাইকে নিয়েই এগোনো সম্ভব। জনগণের প্রতি এই অবিচল বিশ্বাসই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনার মূল শক্তি।
১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচনা করা হয়, সেখানেও আমরা দেখতে পাই তার অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির দর্শনের প্রতিফলন। সংবিধানে বলা হলো ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। এর মাধমে এটা স্পষ্ট হয় যে তাঁর দর্শন ছিল সোনার বাংলার স্বপ্ন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন, শোষণ-বঞ্চনা-দুর্দশামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সে অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ প্রমাণ করে, বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রাথমিক অনিশ্চয়তা কাটিয়ে একটি নিশ্চিত সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য অর্জন করেছিল। ফলে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার অনেকটাই বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলেন। ওই সময় আমাদের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর রিজার্ভে তখন কোনো বৈদেশিক মুদ্রাও ছিল না। শতকরা আশি ভাগের মতো মানুষ দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কল্যাণে সত্যিকার অর্থে কোনো নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান না থাকা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে তখন খাদ্যশস্যের ভয়াবহ সংকট চলছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যের সংকটের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হয় সরকারকে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশ বৈরী অবস্থানে ছিল। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু স্বল্প দেশজ সম্পদ এবং কিছু আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়েই দেশের অর্থনীতিকে তুলে আনার চেষ্টা করেছিলেন।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি কৃষি ও শিল্পায়নকে অগ্রাধিকার দেন। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, কৃষি শুধু যে মানুষের খাবারের জোগান দেবে তাই নয়, বরং আরও দীর্ঘদিন এ দেশের মানুষের আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে তা থেকে যাবে। এছাড়া শক্তিশালী কৃষি খাত দেশের বর্ধিষ্ণু শিল্প খাতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের জোগানও দেবে। তাই তার অন্যতম প্রধান মনোযোগের জায়গা ছিল কৃষির উন্নয়ন। স্বাধীনতা লাভের পরপরই তিনি কৃষির বিকাশের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত কৃষি অবকাঠামো দ্রুত পুনর্নির্মাণ, হ্রাসকৃত মূল্যে বা বিনা মূল্যে কৃষি যন্ত্রাদির সরবরাহ, বীজের যথেষ্ট সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, পাকিস্তান আমলে কৃষকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার, কৃষিপণ্যের জন্য সর্বোচ্চ ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য রেশন সুবিধা প্রদান ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন কৃষি উন্নয়ন হলো টেকসই উন্নয়ন। তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দারিদ্র্য বিমোচনে বঙ্গবন্ধুর অনুসরণীয় কৌশলকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কৃষি ও শিল্প খাতের পারস্পরিক নির্ভরতার বিষয়েও ছিলেন সচেতন। যেমন সার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ। তাই বঙ্গবন্ধু সারা দেশে সারকারখানা স্থাপন ও সেগুলো চালু করাকে দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
তাঁর দর্শন ছিল শিল্পে উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা। সদ্য স্বাধীন দেশে তিনি তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্প খাতের বিকাশের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সব পাকিস্তানি উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপকরা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকা-পয়সা ও অন্যান্য উপকরণ সঙ্গে করে নিয়ে চলে যাওয়ায় স্বাধীনতার পর পর বঙ্গবন্ধু বড় বড় ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান, পাট ও চিনিকল এবং টেক্সটাইল কারখানা রাষ্ট্রীয়করণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সামাজিক সুবিচারে বিশ্বাসী ছিলেন। আর তাই এসব ব্যাংক-বীমা ও শিল্পকারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে নেওয়ার ন্যায়সংগত সিদ্ধান্তটি তিনি নিতে পেরেছিলেন। এর ফলে সুফলও আসে। স্বাধীনতার প্রথম বছরেই দেশের পাটকলগুলো তাদের সক্ষমতার ৫৬ শতাংশ উৎপাদন করতে শুরু করেছিল। সব কারখানাতেই পাকিস্তান আমলের চেয়ে বেশি বেশি উৎপাদন শুরু হয়। টেক্সটাইল মিল, কাগজকল এবং সারকারখানাগুলোর জন্য উৎপাদনের অনুপাত বেড়ে দাঁড়িয়েছিল যথাক্রমে ৬০ শতাংশ, ৬৯ শতাংশ ও ৬২ শতাংশ।
আবার বঙ্গবন্ধুর মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল ব্যক্তি খাতের বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনাগুলোর দিকে তাকালেই এর প্রমাণ মেলে। যেমন ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ২৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা হয় এবং ব্যক্তি খাতের উদ্যোগে শিল্পকারখানা স্থাপনের সুযোগ রাখা হয়। এছাড়া তার সরকারের আমলেই পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া ১৩৩টি কারখানা ব্যক্তি খাতে হস্তান্তর করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু প্রকৃত অর্থেই ছিলেন একজন বাস্তববাদী নীতিনির্ধারক।
বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ছিল ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরী মনোভাব নয়’। স্বাধীনতা লাভের প্রথম তিন মাসের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ ৬৩টি দেশের স্বীকৃতি লাভ করে বাংলাদেশ। ৩ মাস ২১ দিনের মধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানও স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় ২ বছর ২ মাসের মধ্যে। সর্বমোট ১২১টি দেশ স্বীকৃতি প্রদান করে। যা ছিল বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতিরই প্রতিফলন। এ ছাড়া তাঁর দূরদর্শিতার কারণেই ভারতীয় বাহিনী ১২ মার্চ ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেছিল। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চে, যা সেই সময়ে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এ ছাড়া যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণের সূচনা করেন বঙ্গবন্ধু। জাতিসংঘের অধিকাংশ সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সদস্যপদ গ্রহণ, ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলাদেশের ১৩৬তম সদস্যপদ লাভ ও ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণ প্রদান, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ, ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে বঙ্গবন্ধু তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বের ছাপ রাখতে সমর্থ হন। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা রোধ এবং বিশ্বশান্তির প্রতি ছিল তাঁর দৃঢ় সমর্থন। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাঁকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তিপদক প্রদান করে।
জাতির জনক নগর ও গ্রামের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ৫০০ ডাক্তারকে গ্রামে নিয়োগ করেছিলেন। তাঁর নির্দেশেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আইপিজিএমআর শাহবাগ হোটেলে স্থানান্তরিত হয়। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর ‘থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প’ গ্রহণ বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আজও স্বীকৃত। তিনি কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। শিল্প-সংস্কৃতিঋদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশ গঠন এবং বাঙালির হাজার বছরের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ধরে রাখা ও আরও সমৃদ্ধ করা লক্ষ্যে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি গঠন করেন।
মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন জাতির জনক। এর মধ্যেই বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তিনি। একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় এমন কোনো বিষয় নেই, যা তিনি স্পর্শহীন রেখেছেন। বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছেন সব উন্নয়নের শক্ত ভিত হিসেবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধুর সাফল্যময় শাসনামল ও তাঁর দর্শন নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়নি এবং নতুন প্রজন্মের কাছে এ বিষয়গুলো তুলে ধরার যথোপযুক্ত উদ্যোগও নেই। ফলে একটি চক্র আজও জাতির জনকের শাসনামল নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়ায়। তাঁর শাসনামলের ব্যর্থতা তুলে ধরে তারা মূলত জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার ঘৃণ্য চেষ্টা চালায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু কখনোই কারও সঙ্গে আপস করেননি। নিজের পরিবারের দিকে লক্ষ না করে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। ব্যক্তি মুজিবের মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু তাঁর আদর্শের মৃত্যু নেই। তাই জাতির জনকের জীবন-ইতিহাস, শাসনামল ও দর্শন নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও লেখক