
মহামারিতে প্রতিদিন যা মানুষ শুনতে চায়, তা মৃত্যুর সংখ্যা, অন্তত গণমাধ্যম আমাদের ফলাও করে সেটাই জানায়। দেখবেন টিভির স্ক্রলে, পত্রিকার বক্সে, অনলাইন পোর্টালের কাউন্টারে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সরকারি প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে দায়িত্বটি গুরুত্বের সঙ্গেই পালন করে যাচ্ছে গণমাধ্যম। যেন মৃত্যু নয়, খেলার স্কোর জানছি আমরা, মরণখেলার প্রতিদিনকার ফলাফল। ৮৫ ভাগ মানুষ সেরে উঠলেও, তাদের খবর খুব একটা পত্রপত্রিকায় আসে না। আসে উল্টো খবর। যেমন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর ১৪২৮ সনের পয়লা বৈশাখ সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছে বাংলাদেশ, ৯৬ জন! অথবা মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১০ হাজার! এগুলো ফলাও করে প্রচার করা হয়। গোটা দুনিয়াতেই এমন ভীতিকর খবরের কাটতি বেশি। এটাই রীতি। খারাপ খবর মানেই ভালো খবর। আমরাও খারাপ খবরটাই আগে শুনতে চাই। প্রস্তুত থাকতে চাই। তাই ছুটতে থাকি খারাপ খবরের পেছনে।
করোনাসংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রতিদিনই প্রকাশ হচ্ছে, জানানো হচ্ছে হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের অভাবের কথা, এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীদের অসহায় ছুটে বেড়ানোর কথা। পরিস্থিতি খারাপ তাই সরকার বলছে: বাসায় থাকুন। দরিদ্র দিনমজুর বা ভিক্ষুকদের কথা বাদ দিলাম, তারা করোনা ছাড়াই একপ্রকার মরেই ছিল, করোনা এসে তাদের নতুন করে আর কী মারবে? তারা জীবন-জীবিকার ব্যাপারে বেপরোয়া। করোনা তাদের কাছে রূপকথার রাক্ষসের মতোই। কিন্তু বাকি যারা—মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত—তারা বাসায় থেকে কী করবে? তারা গণমাধ্যমে মৃত্যুর খবরটাই গুরুত্ব দিয়ে দেখবে, পড়বে। এরপর ভয় আর স্বস্তি মিশ্রিত এক অনুভূতি কাজ করবে তাদের ভেতর। যেকোনো বিয়োগান্তক ঘটনাতেই মন্দভাগ্য স্পর্শ না করা মানুষের এই মিশ্র অনুভূতি হয়। ট্র্যাজেডির মনস্তত্ত্বটাই এমন, অন্যের কষ্ট দেখে দুঃখ হবে, কিন্তু সেটা নিজের কষ্ট নয় বলে আনন্দও হবে।
গ্রিক কবি ও দার্শনিক লুক্রেশিয়াস একবার বলেছিলেন, দূর সমুদ্রে তুফানকবলিত উথালপাতাল জাহাজ দেখতে আমাদের ভালো লাগে। দুই বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ দেখতেও আমাদের মন্দ লাগে না। অস্বস্তি লাগে অবশ্য। তবে আমরা তো জানি বাস্তবে সেসব ঘটলেও, তার শিকার আমরা হচ্ছি না, আমরা নিরাপদ দূরত্বে আছি। যতক্ষণ না আমরা আক্রান্ত হচ্ছি, বিপদে না পড়ছি, ততক্ষণ দুর্ভাগাদের কষ্ট আমরা বুঝব না। একইভাবে বলা যায় মহামারির কথা। মহামারি তো সমুদ্রের ঘূর্ণিঝড় বা মহাযুদ্ধের মতোই। যতক্ষণ না ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে, ততক্ষণ আমরা আনন্দ-বেদনার দোলাচলে থাকি। এর ভেতরেই আমরা অতিমারি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখছি গণমাধ্যমে। বাস্তবে যা ঘটছে তার পুনঃউৎপাদন হচ্ছে টেলিভিশন, বেতার ও পত্রিকায়। আমরা স্মার্টফোনের স্ক্রিন ঘষতে ঘষতে দেখে চলেছি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও, তথ্য ও পরিসংখ্যান। যে দৃশ্য তারা তুলে ধরছেন তা বাস্তবের দৃশ্যই, তবে তা কি আসলেই বাস্তব? এই প্রশ্নের জবাব দার্শনিক ধারণা সিম্যুলেইক্রায় (simulacra, যার অর্থ কোনো জিনিস বা ঘটনাকে পুনঃউপস্থাপন করা) খোঁজা যেতে পারে। সাধারণ অবস্থাতে তো বটেই, যুদ্ধাবস্থার মতো পরিস্থিতিতে মানুষ আসলে নিজেদের আরও বেশি হারিয়ে ফেলে তথ্যের সাগরে, একটু ঘুরিয়ে বললে, মোবাইল ফোনের ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অথবা টিভির স্ক্রিন রিয়েলিটির ভেতর, যেখানে অনবরত আপডেট জানতে ঢুঁ মারে মানুষ। দুনিয়ার বাস্তবতা আর পুনঃউৎপাদিত বাস্তবতার ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ একবার এদিকে, একবার ওদিকে পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে। এতে তারা অনেকটাই বাস্তব থেকে ছিটকে পড়ে, পুরোটা আবার পুনঃউৎপাদিত বাস্তবতাতেও থাকতে পারে না।
ফরাসি তাত্ত্বিক, উত্তরাধুনিক চিন্তাবিদ হিসেবে খ্যাত, জঁ বদ্রিয়ার (Jean Baudrillard) এই বাস্তবতাকে একটু ভিন্ন করে দেখেন। তিনি বলেন, সিম্যুলেইক্রা আসলে বাস্তবের হুবহু নকল নয়, মানে ‘কপি অব রিয়েল’ নয়, বরং এটি হাইপার রিয়েল। অর্থাৎ বদ্রিয়ারের মতে আসল ঘটনা বা বাস্তবতাকে কখনোই আসলে পুনঃউপস্থাপন করা সম্ভব নয়। এ জন্য আসলের নকল কখনোই আসল নয়, এমনকি নকলও নয়। ভুলে গেলে চলবে না বাস্তব ঘটনার সঙ্গে ‘সময়’ একটা বড় মাত্রা হিসেবে হাজির থাকে। তা ছাড়া ঘটনার পুরোটা কোনোভাবেই ক্যামেরাবন্দী বা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। একটি ঘটনার নকল পরে যখন হাজির করা হয়, তখন সেই সময় আর হাজির থাকে না। স্থানও পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই যতই ভিডিও করা হোক বা অবিকল বর্ণনা দেওয়া হোক, সেটা আসলে আসল নয়, নকলও নয়। সে এক বিকল বাস্তব। এই বিকল বাস্তব যখন আমাদের সামনে নানা মাধ্যমের ভেতর দিয়ে আসতে থাকে, বেনোজলের মতো, আমরা তখন শামিল হই ভিন্ন যাত্রায়, তৈরি হয় ভিন্ন বাস্তবতা। আধুনিক এই তথ্যপ্রযুক্তির সাগরে, স্মার্টফোন-স্মার্টটিভি-গুগল নেস্টের জঙ্গলে আমরা আর সাধারণ থাকি না, আমাদের আশপাশটাও স্বাভাবিক থাকে না। প্রচুর তথ্য আমরা জেনে ফেলি নিমেষে, না চাইলেও এই জানা থেকে আমাদের রেহাই নেই। এমন বাস্তবের নামই বদ্রিয়ার দিয়েছেন হাইপার রিয়েল। হাইপার রিয়েলের বাংলা করা যেতে পারে অধি-বাস্তব।
করোনায় মৃত্যু, চিকিৎসাব্যবস্থার ব্যর্থতা, আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের অকার্যকারিতা ইত্যাদি তথ্য শুধু একবারই আমাদের কাছে আসে না। প্রতিমুহূর্তে নানা মাধ্যম থেকে স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের গুলির মতো আমাদের দিকে ছুটে আসতে থাকে, মাথার ওপর বোমার মতো করে পড়তে থাকে—তথ্য, পরিসংখ্যান, কারণ, বিশ্লেষণ—টেক্সট, ভডকাস্ট, পডকাস্ট—আরও কত কী! আমাদের মাথা ঘুরাতে থাকে, আমরা বাস্তব ঘটনা থেকে নিরাপদে থাকি বটে, কিন্তু অধি-বাস্তব আমাদের গ্রাস করে ফেলে। এ জন্যই আজকাল মনোচিকিৎসকরা পরামর্শ দেন করোনার ভেতর লকডাউনে আছেন মানে এই না শুধু করোনার খবর জানতে থাকবেন। যদ্দুর পারা যায় এসব সংবাদমাধ্যম থেকে দূরে থাকার কথা বলেন তারা। এতে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। এখন যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম দিয়েই আমাদের কাছে খবরগুলো আসে, তাই হাওয়াই (ভার্চুয়াল) যোগাযোগটি কম করাই শ্রেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দৈনিক আধা ঘণ্টার বেশি সামাজিক যোগাযোগের সাইটে থাকা যাবে না। তবে ২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা যায় মানুষ প্রতিদিন চার ঘণ্টারও বেশি সময় ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, উইবো, টুইটার, টিকটক ইত্যাদি নিয়ে থাকে। এতে ঘুম কমে যায়, মানসিক উদ্বেগ বাড়ে, বিষণ্ণতার মতো সমস্যা এসে হাজির হয়। কথা হলো তাহলে মানুষ ঘরবন্দী হয়ে করবেটা কী? করোনা থেকে বাঁচতে মানুষ ঘরবন্দী হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তারা পড়ে যাচ্ছে অন্য দুই ঝুঁকির মুখে। একদিকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোতে বেশি সময় কাটানো মানে স্ক্রিন টাইম বেড়ে যাওয়া, এতে মানসিক ও শারীরিক, দুইভাবেই অসুস্থ হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। আরেকটি হলো— অধি-বাস্তবতার খপ্পরে পড়ে তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাগুলো এখন পণ্য বিক্রি ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। আপনার রুচি, পছন্দ ও ভালোলাগা নিয়ে সে তথ্যভান্ডার তৈরি করে, তারপর সেই অনুযায়ী আপনার সামনে পণ্য বিক্রির ধান্দা করে। এই ধান্দা করতে গিয়ে সে ভোগবাদী মানসিকতাকে তো উস্কে দেয়ই, পাশাপাশি বাস্তব বর্জিত দ্বিমাত্রিক দুনিয়ার বাসিন্দা বানিয়ে ফেলে, মানবিক সম্পর্ক থেকে দূরে সরিয়ে এই কৃত্রিমতা আপনার ভেতর একধরনের শূন্যতা তৈরি করে। আপনি ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকেন, অ্যালিয়েনেশন বলে একেই।
একা বিচ্ছিন্ন মানুষ যখন অনবরত খারাপ খবর, অন্যদের ভালো থাকার খবর, পণ্য কেনার পীড়াপীড়ি ইত্যাদি সংবলিত অধি-বাস্তবতায় খাবি খেতে থাকে, তখন সেই মানুষ এমনিতেই খাদের কিনারে এসে দাঁড়ায়। করোনা মহামারিতে মানুষ মরছে, এটা যেমন সত্যি, তেমনি প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষ সেরে উঠছে, এটাও সমান সত্যি। তাহলে করোনায় মৃত্যুর আগেই অধি-বাস্তবতার চাপে মরে যাওয়ার মানে হয় না। তা ছাড়া মানবিক সজীব সম্পর্কের ভেতর থাকলে মানুষ এমনিতেই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। মানসিক জোর বেঁচে থাকার বড় হাতিয়ার। প্রাথমিক পর্যায়ে সেটি দিয়েই মহামারি মোকাবেলা করতে হবে। যারা স্ট্যানলি কুব্রিকের ‘২০০১: আ স্পেস অডিসি’ ছবিটি দেখেছেন, তারা জানেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধে কী করে একজন মানুষ অদম্য স্পৃহা ও সাহস দিয়ে জয়ী হয়েছিলেন। আমরা মহামারিকে জয় করব, নিজেদেরও বাঁচাব অধি-বাস্তবতার হাত থেকে। মানবসভ্যতার ওপর যুগে যুগে নানা বিপর্যয় আঘাত হেনেছে, তাতে সেটি কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি।
দোহাই
১. রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, পোস্টমর্ডানিজম, (কলকাতা: ধ্যানবিন্দু, ২০১৮)
২. ড. স্বপ্নিল পারিখ, মাহিরা দেসাই ও ড. রাজেশ পারিখ, দ্য করোনা ভাইরাস: হোয়াট ইউ নিড টু নো অ্যাবাউট দ্য গ্লোবাল প্যানডেমিক, (নয়াদিল্লি: পেঙ্গুইন, ২০২০)