পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেস প্রত্যাশিতভাবেই জয়ী হয়েছে। নির্বাচন শেষে যতগুলো এক্সিট পোল রিপোর্ট মিডিয়ায় এসেছে, তার বেশির ভাগ মমতার দলের জয়ের পূর্বাভাস দিয়েছিল। তবে অপ্রত্যাশিত হলো, যে মার্জিনে মমতা জিতেছেন তা। গোটা পশ্চিমবঙ্গে এমন এক মমতা-ঝড় বয়ে গেছে, যার ফলে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির রাজ্য ক্ষমতায় বসার স্বপ্ন একেবারে গুঁড়িয়ে গেছে। আর মমতার আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী বাম-কংগ্রস জোট, অন্তত বিধানসভা থেকে, একবারে ধুয়ে-মুছে গেছে।
রাজ্যটির বিধানসভায় মোট আসন ২৯৪। করোনায় দুজন প্রার্থী মারা যাওয়ার পর দুটি আসনে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। অর্থাৎ নির্বাচন হয়েছে মোট ২৯২ আসনে। এর মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ২১৩ আসন। বিজেপি পেয়েছে ৭৭ আসন বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট, যার নাম দেওয়া হয়েছিল সংযুক্ত মোর্চা, পেয়েছে মাত্র একটি আসন।
পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের শুধু নিকট প্রতিবেশীই নয়, প্রায় সব অর্থে ভাই বা বোনের মতো। ব্রিটিশের কুটিল রাজনীতির শিকার হয়ে বিভক্ত হওয়ার আগে হাজার হাজার বছর এ দু ভূখণ্ডের মানুষ একসাথে বসবাস করেছে। বলতে গেলে, একই সংসারে থেকেছে হাজার বছর। সর্বশেষ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ খেয়ে না খেয়ে সীমাহীন যে অবদান রেখেছে তা দুই ভূখণ্ডের মানুষের সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে।
আবার দুই ভাই বা বোনের মাঝে শুধু প্রীতির ভাবই থাকে না, অনেক বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বও থাকে। যেমন গঙ্গা-তিস্তাসহ আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি বণ্টন উভয়ের মধ্যে একটা বড় সমস্যা। ভারতের দু-দুটি কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ণ সম্মতি দেওয়ার পরও শুধু পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের বাধার কারণে বাংলাদেশকে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির জন্য এগারো বছর যাবৎ অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
অর্থাৎ বাংলাদেশের কোনো ঘটনা যেমন পশ্চিমবঙ্গে প্রভাব ফেলে পশ্চিবঙ্গে বড় কোনো ঘটনা ঘটলে তা-ও এখানে নাড়া দেয়। তাই পশ্চিবঙ্গের নির্বাচন আমাদের কাছে নিছক ভারতের একটা প্রাদেশিক নির্বাচন নয়। ওখানকার ক্ষমতায় কে এলো আর কে গেল, এ নিয়ে আমাদের জনগণের মাঝে একটু বেশিই কৌতূহল থাকে। তাই পশ্চিবঙ্গের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে আমাদের এখানে চর্চা হবে এটা স্বাভাবিক।
মমতা ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০১১ সালে বাম ফ্রন্টের টানা ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে। এজন্য, অবশ্য, তাঁকে প্রথমে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি রক্ষার আন্দোলনের নামে বেশ ভালোভাবেই জল ঘোলা করতে হয়েছে। তারপর মাছ শিকার করেছেন তিনি।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনকে মাছ শিকারের আগে জল ঘোলার সাথে তুলনা করায় অনেকেই হয়তো আপত্তি করতে পারেন। কিন্তু এগুলো যে এ রকমই কিছু ছিল, তা এবারের নির্বাচনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রথমত, নন্দীগ্রাম মমতাকে ক্ষমতায় বসালেও মমতার দশ বছরের শাসনে তার উন্নয়ন তেমন হয়নি। সিঙ্গুরে টাটাদের তাড়িয়ে গুজরাটে পাঠিয়ে দেওয়ার পর বলা হয়েছিল, এখানে বিকল্প জায়গা দেখে শিল্প গড়া হবে, মানুষ কাজ পাবে। কিন্তু এর কিছুই হয়নি।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলাকালে মমতা নিজেই বলেছেন, নন্দীগ্রামের আন্দোলন ছিল সেখানকার অত্যন্ত প্রভাবশালী অধিকারী পরিবারের একটা খেলা। অধিকারী পরিবার বংশপরম্পরায় পূর্ব মেদিনিপুরে-নন্দীগ্রাম যেখানে অবস্থিত, প্রথমে কংগ্রেস, পরে তৃণমূলের হয়ে আধিপত্য চালিয়েছে। নন্দীগ্রামে সিপিএম শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য অনেকটা গায়ের জোরেই জমি অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেখানকার মানুষ তা মানতে চায়নি। অধিকারী পরিবারের কাছে এ ছিল নিজেদের আধিপত্য পুনরুদ্ধারের এক বিরাট সুযোগ। তা তারা কাজে লাগিয়েছে।
আর অধিকারী পরিবারের সবাই—নন্দীগ্রাম আন্দোলনের নেতা শুভেন্দু অধিকারী, তাঁর বাবা, দুই ভাই—যেহেতু মমতার দলে যোগ দিয়েছিল তাই ওই আন্দোলনের পর অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে মমতার ক্ষমতা দখল সহজ হয়েছে। এবার অবশ্য গোটা অধিকারী পরিবার বিজেপির হয়ে মমতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে। শুধু তা নয়, শুভেন্দু বিজেপির হয়ে নির্বাচন করে নন্দীগ্রাম আসনে মমতাকে হারিয়েও দিয়েছেন।
এবারের নির্বাচন মমতা শুরু করেছিলেন প্রায় বিপর্যস্ত এক অবস্থা থেকে। দশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ শাসন করছেন তিনি। সমাজের পিছিয়ে পড়া নানা গ্রুপকে কিছু দান-খয়রাত করা ছাড়া বলার মতো কোনো কাজ নেই তাঁর। শিল্পায়ন হয়নি বললেই চলে। অতএব কর্মসংস্থানের সুযোগও খুব একটা তৈরি হয়নি। বাম ফ্রন্ট আমলে কৃষির যতটুকু উন্নতি ঘটেছিল, তা আর এগোয়নি, বরং কিছু ক্ষেত্রে খারাপ হয়েছে। সরকারি চাকরির পরীক্ষাও নিয়মিত হয়নি। সরকার বলেছে, কোর্টেও নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা তা করতে পারেনি।
আবার কোর্ট এসব পরীক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। গোটা নির্বাচনজুড়েই বিরোধী দলগুলো মমতার ভাইপো, যাঁকে তাঁর উত্তরসূরি বলে মনে করা হচ্ছে, অভিষেক এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে গরু পাচার, কয়লা পাচার, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ত্রাণের টাকা মেরে দেওয়া ইত্যাদি দুর্নীতির অভিযোগ করে গেছে। সাথে নারদা-সারদা ইত্যাদি কেলেঙ্কাকারির কথা তো ছিলই, যেসব কেসে মমতার প্রায় সব শীর্ষ সহযোগীর নাম জড়িত। আর সরকার পক্ষ এসবের কোনো জবাব না দিয়ে স্বাস্থ্য সাথী, খাদ্য সাথী, কন্যাশ্রী ইত্যাদি প্রকল্পের কথা বলে গেছে।
স্থানীয় বিশ্লেষকরদেও মতে, বিশেষ করে শেষ পাঁচ বছর, মমতার শাসন ছিল অপশাসনের নামান্তর। শাসক দল কর্তৃক বিরোধী মত দলন, বিরোধী দল দমন ছিল এ সময়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এসবের বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভও ছিল প্রচুর যাকে পুঁজি করে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সবাইকে চমকে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ৪২টার মধ্যে ১৮টা আসন পেয়ে যায়।
২০১৯-এর সেই মমেন্টাম ধরে রেখে রাজ্য ক্ষমতা দখলের জন্য বিজেপি এবার সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে অতিদক্ষ মমতাও বসে থাকেননি। তিনি নিয়ে আসেন প্রশান্ত কিশোরের আইপ্যাককে। প্রশান্তকে বলা হয় ভোট কুশলী। বলা হয়ে থাকে ২০১৪ সালে মোদির দিল্লি দখলের অন্যতম প্রধান কারিগর এই প্রশান্ত কিশোর এবং তাঁর আইপ্যাক। এরপর ২০১৫ সালে বিহারে ক্ষমতায় আসেন নিতীশকুমার ও লালু প্রসাদের জোট। এ জয়ের পেছনেও কৃতিত্ব দেওয়া হয় প্রশান্তকে।
এবার পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি তামিলনাড়ুতেও ভোট হয়েছে। সেখানেও প্রশান্ত কাজ করেছেন জয়ী দলের পক্ষে। আরও মজার ব্যাপার হলো, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যখন তারস্বরে কোরাস তুলে বলছিল, তারা এবার ২০০+ আসন পেয়ে সরকার গড়বে, তখন প্রশান্ত চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলেন, মমতা বরং ২০০+ পাবে আর বিজেপি থাকবে ১০০-এর নিচে। যদি তা না হয় তাহলে তিনি ভোটকুশলীর কাজ ছেড়ে দেবেন।
এই প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শে কিনা জানি না মমতা ভোটের প্রচার শুরুর আগে আগে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তুলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু করলেন আর বিজেপির যেসব নেতা বাইরে থেকে নির্বাচনী প্রচারে এলো তাদের সবাইকে বহিরাগত বলে চেপে ধরলেন। এতে বেশ কাজও হয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হাওয়া ঘুরে যেতে লাগল। বিজেপিও ডিফেন্সিভ হতে বাধ্য হলো।
দলটির স্থানীয় নেতারা, তারাও যে বাঙালি তা প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাইরে থেকে মোদি কিংবা অমিত শাহ যারাই এসেছেন সবাই বাঙালি মনীষীদের স্মৃতিসদন বা মনুমেন্টে গিয়ে তাঁদের ছবি বা মূর্তির সাথে ছবি তোলা, তাঁদের বিভিন্ন উক্তি আওড়ানো- অনেকাংশেই ভুলভাবে ইত্যাদি শুরু করলেন। আর এতে তাদের আরও সর্বনাশ হলো। কারণ এতে সেখানকার মিডিয়ার ভাষায় ‘বাঙালি অস্মিতায়’ ঘা লাগল।
শুধু বাঙালি অস্মিতাকে জাগানো নয়, মমতা খুব দক্ষতার সাথে তাঁর ভোট ব্যাংক বলে পরিচিত মুসলিম কার্ডও খেললেন। আর এ দুয়ে মিলে বিজেপির সমস্ত বিনিয়োগকে অসার করে দিল। এখানে বলে রাখা দরকার, রাজ্যে মুসলিম ভোট প্রায় ৩০ শতাংশ। তারা সরাসরি ৭০টি আসন নিয়ন্ত্রণ করে আর প্রভাবিত করতে পারে ১০০+ আসনে। বিজেপিকে তাই নির্বাচন শুরু করতে হয়েছে ৭০টি আসন বাদ রেখে। আর এ অবস্থা সামাল দিতে তার চিরাচরিত হিন্দুত্ব কার্ড খেলে সে হিন্দু ভোট সংহত করার চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু এতে বিধানসভার প্রধান বিরোধী দলের আসনটি নিশ্চিত হলেও আসল কাজ হয়নি।
মমতা-ঝড় যে শুধু বিজেপিকে বিপর্যস্ত করেছে তা নয়, বাম-কংগ্রেস জোটকে বিধানসভা থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। এ দুই দল ১৯৪৭ সালের পর (বাম ফ্রন্ট ৩৪ বছর, কংগ্রেস ২৭ বছর) ৬১ বছর রাজ্যটি শাসন করেছে। দীর্ঘ সময় নির্বাচনে এরাই ছিল মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। এবারই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা গঠিত হলো বাম-কংগ্রেস প্রতিনিধি ছাড়া। ২০১৯ সালে বলা হয়েছিল, বামের ভোট রামে অর্থাৎ বিজেপিতে চলে গেছে। এবার বলা হচ্ছে, তা তৃণমূলে গেছে। আর যে মুর্শিদাবাদ-মালদায় বহু দশক ধরে কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর গড় বলে পরিচিত ছিল, বহু মারপিট খুন খারাবি করেও প্রথমে সিপিএম, পরে তৃণমূল এত দিন সেখানে কোনো দাঁত বসাতে পারেনি। কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত এ অঞ্চল এবার পুরোপুরি মমতার দিকে চলে গেছে কংগেসকে একেবারে শূন্য করে দিয়ে।
ভারতের, এবং বাংলাদেশেরও বটে, মুসলিমদের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান বলে পরিচিত ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীকে সাথে নেওয়ার পরও কেন বাম-কংগ্রেস জোটের এ পরিণতি হলো তা নিয়ে প্রচুর বিশ্লেষণ চলছে। আমরাও নিশ্চয় অন্য কোনো লেখায় তা করব। কিন্তু আপাতত এটুকু হলফ করে বলা যায় যে, এ দুই ঐতিহ্যবাহী সেক্যুলার শক্তির এমন ক্ষয় পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই বাংলাদেশের জন্যও ভালো হবে না।
মমতা ব্যক্তিগতভাবে সৎ হলেও তাঁর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড থেকে শুরু করে একবারে মাঠপর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। ভালোবেসে মন জয় নয়, উৎপীড়নের মাধ্যমে মানুষের সম্মতি আদায়ই এদের রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। গোটা রাজ্যে ভোট-পরবর্তী ব্যাপক খুন-জখমের ঘটনা আমাদেরকে আবারও সেটাই দেখিয়ে দেয়।
বাঙালি অস্মিতা বারবার জাগবে না। এমনকি দুর্নীতি-দুঃশাসন যদি চলতে থাকে তা মুসলিম কার্ডেও কার্যকরতাকেও ভোতা করে দেবে। আর এর মধ্যে বাম-কংগ্রেস জোট যদি কোমর সোজা করে দাঁড়াতে না পারে তাহলে আগামী দিনে বিজেপিই পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে এ কথা বোঝার জন্য কোনো বিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষক হতে হয় না। মমতা দাবি করেন, তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু। এ যে কতটুকু ছেদো কথা, তা আমরা বুঝি তিস্তা চুক্তির ঝুলন্ত অবস্থা দেখে, এ দেশের জামায়াত-জঙ্গিদের এখানকার পুলিশের তাড়া খেয়ে পশ্চিমবঙ্গে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা দেখে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক