১.
ঢাকা শহরের অন্যতম গরম এলাকা সচিবালয়ের চারদিক। টাকার গরম শুধু নয়, তাপমাত্রারও। বহুবার এই সচিবালয়ের পাশের তপ্ত ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভেবেছি, এই বিশাল উঁচু দেয়ালটাকে যদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতোই লোহার মোটা গ্রিল দিয়েও ঘিরে রাখা হতো, তাহলে বাতাস চলাচল করতে পারত, জায়গাটা এমন অগ্নিকুণ্ড হয়ে থাকত না। পল্টন, প্রেসক্লাব, গুলিস্তান এলাকার তাপমাত্রাই হয়তো দুই এক ডিগ্রি কমে আসত। নান্দনিকভাবেও তা হতো আনন্দের। যতবার সচিবালয়ের দেয়ালে চোখটা বাড়ি খেয়ে ফিরে আসে, ততবার বোধ করি এই দেয়াল নিরাপত্তার জন্য নয়, একটা কিছুকে আবডালে রাখবার জন্য।
জনগণের সঙ্গে একটা মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব, একটা সমীহ, একটা ভীতি তৈরির কাজটা করে এই দুর্ভেদ্য বিশাল প্রাচীর। এই প্রাচীরটা যার শারীরিক রূপ, তারই আইনি রূপ হলো অতি সম্প্রতি বানানো ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, কিংবা ব্রিটিশ আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাকট। আড়াল, সেটা প্রাচীরের হোক, আইনের হোক, যেকোনো অস্বচ্ছ, জবাবদিহিহীন প্রক্রিয়ার একটা অনিবার্য মনস্তাত্ত্বিক অনুষঙ্গ। ব্যতিক্রমহীনভাবে দেখা যাবে, যার আড়াল করবার কিছু আছে, সে দেয়াল তোলে, অকারণ পাহারা বসায়, আইন বানায়। এটা একটা উদ্যান গায়েব করে দেওয়ার বেলাতে যেমন দেখা যাবে, তেমনি দেখা যাবে সরকারি সংস্থাগুলোর খাতাপত্রের গোপনীয়তায়। আড়াল ছাড়া জনগণের তহবিল লুণ্ঠন হতে পারে না।
২.
সচিবালয়ের নথি চুরি বিষয়ে লিখতে বসে কিংবদন্তি সাংবাদিক ফয়েজ আহ্মদের কথা মনে পড়ছে। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তিনি একটা স্মৃতিচারণামূলক লেখা লিখেছিলেন আশির দশকের শুরুতে ‘চার দিন ফাইলটা সেক্রেটারির টেবিলে’। ঘটনাটা ছিল আরও বহু পুরোনো, ১৯৬৪ সালের। একটা গোপন নথির সূত্র পেয়ে ফয়েজ আহ্মদ জানতে পারলেন পশ্চিম পাকিস্তানের আমলাদের সুবিধা দেওয়ার জন্য পূর্ব বাংলার আমলাদের বঞ্চিত করা হবে শতাধিক বৃত্তি থেকে। অতিশয় গোপন নথি। দৈবক্রমে সংবাদটা পেয়ে ফয়েজ যে কায়দায় নথি হস্তগত করেন, তা রোমাঞ্চ উপন্যাসতুল্য। সংগত কারণেই দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার পুরো পাতায় শিরোনাম আসে ‘শতাধিক বৃত্তি থেকে পূর্ব পাকিস্তান বঞ্চিত’।
তখনকার দিনে চুরিদারি এখনকার চাইতে বহুগুণ কম ছিল। সেই আমলে বুঝতেই পারছেন, এটাও তাই ছিল চাঞ্চল্যকর সংবাদ, পাকিস্তান রাষ্ট্রের মাঝে বৈষম্য কতটা তীব্র, তার স্মারক।
আজ পরিষ্কার করে বলতে পারি, এই বৃত্তিগুলো পশ্চিম বা পূর্ব কোনো পাকিস্তানের আমলাদেরই পাওনা ছিল না। এগুলো পাওনা ছিল অধ্যাপক, শিক্ষক ও গবেষকদের। যেকোনো সভ্য দেশে তারাই বৃত্তি পান, তারা অর্জিত জ্ঞান আরও হাজারো শিক্ষার্থীর মাঝে ছড়িয়ে দেন। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মতো ডক্টরেট সনদবিশিষ্ট, বিদেশ সফরের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ আমলাতন্ত্র মিলবে না। কিন্তু কার্যকারিতার দিক দিয়ে বলেন, এরা মহামারি ঠেকাতে, টিকা আনতে, মাস্ক বিতরণ করতে শতভাগ ব্যর্থ, যাকে বলে লেজে-গোবরে দশা।
কিন্তু যাহোক সেটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের আমলাদের পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের হাতে বঞ্চিত হওয়ার কাহিনি। ফলে এই সংবাদের একটা ন্যায্যতা তো ছিলই। রক্তক্ষয়ী একটা স্বাধীনতাযুদ্ধের পর, ফয়েজ আহ্মদের পথ ধরে এলেন রোজিনা ইসলামরা। ফয়েজ আহ্মদ চাকরিচ্যুত হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন, সত্য থেকে বিচ্যুত হননি। কিন্তু মনে হয় না রোজিনা ইসলাম যতটা বিরূপ, যতটা নিষ্ঠুর প্রতিকূলতা দেখছেন, সেটার মুখোমুখি ফয়েজ আহ্মদরা হয়েছিলেন।
৩.
সমতুল্য একটা ভারতীয় ঘটনার কথা বলি। বিষয়ের দিক দিয়ে সমতুল্য হলেও ভারতের ঘটনাটি আরও বেশি সংবেদনশীল ছিল। কেননা, তাতে যুক্ত ছিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। ভারতে একটা হইচই ফেলে দেওয়া ঘটনা হয়েছিল রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার দুর্নীতির সংবাদ ‘দ্য হিন্দু’ ও ‘স্ক্রল’ এই দুটি পত্রিকায় প্রকাশ নিয়ে। এই বিমান ক্রয় ভারতে একটা জাতীয়তাবাদী স্বস্তির আবেশ তৈরি করেছিল, বিমানবাহিনীকে তা চীন ও পাকিস্তানকে মোকাবেলার উপযুক্ত স্বস্তি জুগিয়েছে এই প্রচারের আড়ালেই ঘটেছিল কথিত বিপুল দুর্নীতি। তো এই প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হলে আদালতে একটি মামলা হয়, রাফাল বিমান কেনায় দুর্নীতি বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ দাবি করে। কিন্তু ‘দ্য হিন্দু’তে প্রকাশিত নথিগুলোকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করবার বিরুদ্ধে অ্যাটর্নি জেনারেল উচ্চ আদালত তিনটি যুক্তি প্রদর্শন করেন, সেগুলোর সারমর্ম মোটামুটি এই যে:
ক. এই নথিগুলোর ওপর আদালতের নির্ভর করা উচিত হবে না, কারণ সেগুলো অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের লঙ্ঘন।
খ. এই নথিগুলো তথ্য অধিকার আইনের আওতায় পাওয়া যেত না।
গ. সাক্ষ্য আইনের অধীনে সরকারি কর্মচারীরা এই জাতীয় নথি প্রকাশ না করার অধিকার সংরক্ষণ করেন।
খেয়াল করবেন, ফাঁস করা নথির তথ্যগুলোতে অসংগতি আছে, এমন কোনো যুক্তি সরকার দেয়নি। বরং আইনের ফাঁকফোকরে আত্মরক্ষার চেষ্টাই করেছে। আপাতদৃশ্যে সরকারের গোপনীয়তার অধিকার আর জনগণের জানবার অধিকারের মাঝে যখন বিরোধ দেখা দিয়েছে, আদালত তখন গণমাধ্যমের তথ্য প্রকাশ করবার অধিকারের পক্ষেই মত দিয়েছেন। ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলোর ওপর ভিত্তি করে রাফাল বিমান ক্রয় নিয়ে হস্তক্ষেপ দাবি করা মামলাটি আদালত শেষ পর্যন্ত আমলে না নিলেও (রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ইত্যাদি নানাবিধ কারণ দেখিয়ে এবং সেগুলোরও বিপুল সমালোচনা হয়েছে), ভারতীয় উচ্চ আদালত অন্তত দুর্নীতি প্রকাশ করবার গণমাধ্যমের অধিকার ও জনগণের জানবার অধিকারকে শিরোধার্য করেছেন।
বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, এই কথা বলে আসলে আমরা তুলনা করতে চাই সামরিক ক্রয়ের মতো অতি স্পর্শকাতর বিষয়ে ভারতীয় এই মামলাটির সঙ্গে বাংলাদেশের রোজিনা ইসলামের পরিস্থিতির।
৪.
একটা ভিডিও দেখলাম, রোজিনা ইসলামের গলার ওপর চাপ দিয়ে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী হুমকি দিচ্ছেন। অকল্পনীয়! মাঠপর্যায়েই কিন্তু এই প্রশিক্ষণ চলছে। এই করোনাকালেই সংবাদিক নিপীড়ন মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনে। মনে আছে সংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে মাঝরাতে তুলে এনে নিপীড়ন এবং আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ এনে ওই রাতেই এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে জেলে পাঠানো জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের কথা? এমন ঘটনা অজস্র ঘটেছে গত দুই বছরে।
সরকারের আসল লক্ষ্য কিন্তু কোনোভাবেই রোজিনা ইসলামকে কারাদণ্ড দেওয়া নয়। বরং এই যে স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে হয়রানি, দুর্গতি, পরিবারের হেনস্তা, কারাগারে বা হাজতে থাকতে হবে, এই ভীতি তৈরি করে বাকি সব গণমাধ্যমকর্মীর জন্য আতঙ্কের একটা পরিবেশ তৈরি করা। এই আতঙ্কের দেয়ালও, পূর্বে কথিত আইনের প্রাচীর ও ইটের প্রাচীরের মতোই, অসৎ লোকদের অন্যতম সুরক্ষা। গৃহস্থকে আতঙ্কিত দেখলে দস্যুরা যেমন স্বস্তি পায়।
৫.
আমরা সবাই যা চাই, তা হলো যে নথিটি প্রকাশ করতে গিয়ে রোজিনা ইসলাম এত বড় হুমকি তৈরি করলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে, তাতে কী রোমহর্ষ তথ্য ছিল, তা সব নাগরিকের সামনে উন্মুক্ত করা। রোজিনা এরই মধ্যে আলোড়ন তৈরি করেছেন স্বাস্থ্যের নিয়োগ কমিটির সদস্যদেরই কোটি কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাবসংক্রান্ত প্রতিবেদন করে। তিনি আমাদের জানিয়েছেন বিপুল দুর্নীতির সাগরে পুরো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিমজ্জিত। করোনার মতো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে দুই-দুইজন স্বাস্থ্যসচিবকে বদলি করাটা জনগণের সেই ধারণারই একটা স্বীকৃতি। এগুলোর চাইতেও বড় কোনো তথ্যের সন্ধান রোজিনা ইসলাম পেয়ে গিয়েছিলেন? সে কারণেই কি তাকে এইভাবে লাঞ্ছনা, নিপীড়ন এবং শেষ পর্যন্ত হাজত ও কারাবাস করতে হলো?
রোজিনা ইসলামকে অভিনন্দন। বিশেষ করে এই কারণে যে কিংবদন্তি ফয়েজ আহ্মদের দেখানো পথ ধরে রোজিনা সাম্প্রতিক সময়ের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদনগুলো করছিলেন। বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয় এই কথাটুকু যে একজন নারী হিসেবে রোজিনার এই ভূমিকা আমাদের সামাজিক অগ্রগতিরও একটা বিরাট সূচক।
বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত একজন আমলা আকবর আলি খান একটা আস্ত গ্রন্থ লিখেছেন, কীভাবে এমন একটা আমলাতন্ত্র আমরা তৈরি করেছি, যেখানে কাঠামোগতভাবেই সৎ ও নিষ্ঠাবানদের ক্রমাগত কোণঠাসা করবে অসৎ ও ক্ষমতাঘনিষ্ঠরা। এই পুরো পদ্ধতির আমূল বদল ছাড়া আসলে জনগণের সেবক সরকারি কর্মচারী পাওয়াটা অসম্ভব হয়ে পড়বে দিনকে দিন, চোখের সামনে সেই দ্রুত অধঃপতন আমরা দেখতে পাচ্ছি।
রোজিনা আমাদের বীর। তার দেখানো পথে গণমাধ্যম এগিয়ে যাক।
লেখক: রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন।