২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে, জনপরিসরে না হলেও, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বলা হচ্ছে, এ বাজেটের পুরোটাই ব্যবসায়ীদের জন্য তৈরি হয়েছে; মধ্যবিত্ত তো বটেই, এমনকি ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদেরও জন্য কিছুই নেই এ বাজেটে। কেউ কেউ বলছেন, করোনাকালে আমাদের মতো একটা বিকাশমান অর্থনীতি বাঁচাতে যেমন বাজেট হওয়া উচিত ছিল, এ বাজেট তার ধারেকাছেও নেই। আর কেউ কেউ তো বিশেষ করে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা, বাজেট নিয়ে তাদের চিরাচরিত প্রতিক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় এমনও বলছেন, এটি হলো ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে আরও গরিব করার বাজেট। ৩ জুন জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বাজেট প্রস্তাবগুলো কি আসলেই এতটা হতাশাজনক?
বাংলাদেশে প্রতিবছর মোটামুটি এপ্রিল মাস থেকে শুরু হয় বাজেট প্রণয়নের কাজ। মে মাসে এ কাজ চূড়ান্ত গতি পায়। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন ট্রেড বডি, নাগরিক সংগঠন এবং অর্থনীতিবিদরা সভা-সেমিনার করেন এবং গণমাধ্যমের আলোচনায় বাজেট বিষয়ে তাদের সুপারিশগুলো দিতে থাকেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সেগুলো থেকে বলা যায়, প্রায় সবাই এবার যে কথাটা বারবার বলেছেন তা হলো, বাজেটে করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক অর্থনীতিবিদ ঘাটতির কথা চিন্তা না করে এবার উদারভাবে খরচের পরামর্শ দিয়েছেন। কেউ কেউ এমনকি জিডিপির প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় ইত্যাদি হিসাব না করে করোনাযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন, তা-ই করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রীকে।
এসব কথা শুনেই হয়তো অর্থমন্ত্রী এবার শুধু রেকর্ডভাঙা ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করেননি, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রাও গতবারের মূল বাজেটের মতোই ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রেখে দিয়েছেন। ঘাটতির দিক থেকেও এ বাজেট রেকর্ড ভাঙবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাজেট প্রস্তাব অনুসারে অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) একসময়ে বাংলাদেশকে বাজেট সহায়তার জন্য নিয়মিত যার দ্বারস্থ হতে হতো, তারা মনে করে বাজেট ঘাটতি কখনোই জিডিপির ৫ শতাংশের ওপরে যাওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশ বরাবরই একান্ত বাধ্য ছাত্রের মতো তা মেনে এসেছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে আইএমএফের ওই নিয়মটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।
বাজেটে ঘাটতির ওই নিয়ম ভাঙতে গিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। অথচ তারপরও বলা হচ্ছে, বাজেটে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপানো হয়েছে।
করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানোর প্রসঙ্গ টেনে বলা হচ্ছে, বাজেটে লাভবান হয়েছেন শুধু বড় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এ পদক্ষেপ যে দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রণোদনা হিসেবে কাজ করতে পারে, তা বলা হচ্ছে না।
এ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসার পর থেকে দেশকে কৃষি ও শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে পলিসি সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। এবারের বাজেটে এটি আরও জোরদার হয়েছে। এর সুফল কি শুধু ব্যবসায়ীরা পাবেন? এর সুফল তো পাবে সমাজের সব অংশের মানুষ, বিশেষ করে তাদের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে। অথচ এ বিষয়টিকে চেপে গিয়ে বলা হচ্ছে, বাজেট মধ্যবিত্তকে হতাশ করেছে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, শুধু তথ্যপ্রযুক্তিতে এ বছর ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। এজন্য বিভিন্ন স্থানে হাই টেক পার্কসহ নানা ব্যবসায়িক কেন্দ্র গড়ে তোলার পাশাপাশি তরুণ-তরুণীদেরকে ফ্রিল্যান্সিংসহ বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার শিল্পের বিভিন্ন প্রোডাক্ট উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু এ খাতেই আগামী পাঁচ বছরে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব।
তথ্যপ্রযুক্তির পাশাপাশি আরেকটি বিকাশমান খাত হলো ই-কমার্স, যেখানে ইতিমধ্যেই কয়েক লাখ লোক কাজ করছে। এটাকে আরও বিকশিত করার লক্ষ্যে বাজেটে তরুণ-তরুণীদের ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হ্যাঁ, এ খাতে যে পণ্যের উপকরণ কেনার ওপর ১৫ শতাংশ আগাম কর বসানো হয়েছে, তা নিশ্চয়ই উদ্যোক্তদের নিরুৎসাহিত করবে। তাই চূড়ান্ত বাজেট প্রস্তাবে তা প্রত্যাহৃত হবে বলে আমরা আশা করি।
বলা বাহুল্য, তথ্যপ্রযুক্তি ও ই-কমার্স খাতের বিভিন্ন কাজে যারা যুক্ত হচ্ছে তাদের বেশির ভাগ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় থেকে ঝরে পড়া তরুণ-তরুণী, যাদের শেকড় প্রোথিত নিম্নধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারসমূহে। ফলে, এমনটা বলার সুযোগ একেবারেই নেই যে সমাজের পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোর জন্য বাজেটে কিছু নেই।
বাজেটে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, দেশীয় ভারী শিল্পকে যেসব যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট ও শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সেসব যন্ত্রাংশ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাত উৎপাদনের পর তা সরবরাহ করলে ভ্যাট দিতে হবে না। এ খাতের শুধু শ্রমিক নন, উদ্যোক্তাদেরও বড় অংশটা এসেছে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারসমূহ থেকে।
বেশ কিছু হোম অ্যাপ্লায়েন্সেস ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্সেস পণ্য এবং হালকা প্রকৌশল শিল্পের পণ্যের উৎপাদনকারী কোম্পানিকেও শর্ত সাপেক্ষে ১০ বছর মেয়াদি কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। এই দশ বছরের কর অব্যাহতির সুবিধা নেওয়ার জন্য দেশে শত শত শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে পারে।
বাজেটে একই লক্ষ্যে ব্যক্তি করদাতাদের ব্যবসায়িক টার্নওভার করহার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের কর আয়ের সীমা ৫০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০ লাখ টাকা করা হয়েছে। এসবের সুফলও যাবে মধ্যবিত্তের ঘরে।
বিদ্যমান ভ্যাট আইনটি আরও ব্যবসাবান্ধব ও যুগোপযোগী করতে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটের আগাম কর হার ৪ শতাংশের জায়গায় ৩ শতাংশ করা হয়েছে। ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা আগের দ্বিগুণ পরিমাণ থেকে কমিয়ে সমপরিমাণ করা হচ্ছে। এছাড়া সময়মতো ভ্যাট না দেওয়ার জরিমানাও মাসিক ২ শতাংশের জায়গায় ১ শতাংশ করা হচ্ছে।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমাজের মূলধারায় আনতে কিছুটা উদ্যোগ রয়েছে বাজেটে। কোনো প্রতিষ্ঠান মোট কর্মচারীর ১০ শতাংশ বা ১০০ জনের বেশি তৃতীয় লিঙ্গের শ্রমিক নিয়োগ দিলে কর রেয়াত সুবিধার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
ভ্যাট ছাড় দেওয়া হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত স্যানিটারি ন্যাপকিন, করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কোভিড-১৯ টেস্ট কিট, পিপি, ভ্যাকসিন আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়েও। এছাড়া অটিজম সেবার কার্যক্রম এবং ও মেডিটেশন সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
কৃষিভিত্তিক শিল্পেও বেশ কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে। শর্ত সাপেক্ষে দেশে উৎপাদিত সব ধরনের ফল শাক-সবজি প্রসেসিং শিল্প, দুধ ও দুগ্ধজাতপণ্য উৎপাদন, সম্পূর্ণ দেশীয় কৃষি থেকে শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী শিল্প এবং কৃষিযন্ত্র উৎপাদনকারী শিল্পের জন্য ১০ বছরের করমুক্ত সুবিধার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়াও কৃষি আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে কৃষি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। কৃষি খাতে সরবরাহ চেইনকে প্রভাবিত করতে কৃষি ও অকৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ১৩০টি গ্রোথ সেন্টার তথা হাটবাজার উন্নয়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে বাজেটে।
দেশে মেগা শিল্পের বিকাশ এবং আমদানির বিকল্প শিল্প উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করার স্বার্থে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যেই বাংলাদেশে বাজেটে অটোমোবাইল-থ্রি হুইলার এবং ফোর হুইলার উৎপাদনকারী কোম্পানিকে শর্ত সাপেক্ষে ১০ বছর মেয়াদে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন কিছু শর্ত সাপেক্ষে আরও ১০ বছর কর অব্যাহতি প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে যন্ত্রাংশ আমদানিতে আগাম কর দিতে হয়। এ বাজেটে সেটিও বাতিল করা হচ্ছে।
এ ছাড়া দেশে শিল্পায়নে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বেশ কিছু খাতের কর্মীদের পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রদানে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে ১০ বছরের জন্য কর অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।
অটোমোবাইল একটি মৌলিক শিল্প। একটি গাড়ি বানাতে অন্তত তিন হাজার উপকরণ দরকার। এখন এই শিল্প যদি গড়ে ওঠে, তাহলে এই তিন হাজার উপকরণ তৈরির কারখানা গড়ে উঠবে।
ইলেকট্রনিক শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ায় শিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এখন দেশেই বিশ্বমানের এয়ারকন্ডিশন ও রেফ্রিজারেটর উৎপাদন হচ্ছে। এমনকি বিদেশি ব্র্যান্ডও দেশে কারখানা স্থাপন করেছে এবং অনেক ব্র্যান্ড পরিকল্পনা করছে। এ দুই খাতে বিপুল বিনিয়োগের কারণে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। দেশীয় এ শিল্পকে সুরক্ষা দিতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
যারা বাজেটে করোনা মোকাবেলার কোনো রোডম্যাপ দেখতে পাননি, তাদের জানা থাকা দরকার যে বর্তমানে করোনা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো দেশের অন্তত ১২ কোটি মানুষকে দ্রুত টিকা দেওয়া। আর এ জন্য শুধু ১৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়নি প্রয়োজনে ‘ব্ল্যাংক চেক’ দেওয়ার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তাছাড়া স্বাস্থ্য খাতের জরুরি খরচের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দও তিনি রেখেছেন।
শুধু তা নয়, দেশের দরিদ্র জনগণ যাতে করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে পারে, সে জন্য এবার সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ গতবারের চেয়ে প্রায় ১৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।
এ কথা নিশ্চয়ই বলার কোনো সুযোগ নেই যে এবারের বাজেটটি যুগান্তকারী হয়েছে। তবে ওপরের আলোচনা থেকে এটা বলা যায় যে এ বাজেট দেশের শিল্প ও কৃষি খাতে যুগান্তর ঘটানোর একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারবে। এটি হয়তো বিদ্যমান ধনী-গরিবের বৈষম্যকে প্রত্যাশিত মাত্রায় কমিয়ে দেবে না, তবে তা যে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অংশের উঠে দাঁড়ানোর পথ করে দেবে, এমনটা আশা করা যায়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট