বর্তমানে পৃথিবীতে দুটি সংকট বড় আকারে দেখা দিয়েছে। একটি জ্বালানী সংকট, অন্যটি আমেরিকার কর্তৃত্ব সংকট। আমেরিকা তার কর্তৃত্ব অটুট রাখতে বিশ্ববাসীকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। আমেরিকা নিজেও সংকটে পড়েছে। সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে আমেরিকার কলোনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো -এক সময় আমেরিকা ছিল ইউরোপের কলোনি আর এখন ইউরোপ হচ্ছে আমেরিকার কলোনি। ইউরোপের ন্যায় এমন শান্ত, অনুগত কলোনি কোনো সময় ছিল বলে জানা নেই। লালনের এক গানে আছে, আমি ঐ চরণের দাসেরও যোগ্য নই। অথবা কবে সাধুর চরণ ধুলি পড়বে মোর গায়। লালন পরমের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। ইউরোপও তেমনি আমেরিকার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। ইউরোপের কাছে আমেরিকার চরণধুলিই সাধনার ধন। আমেরিকার কোনো কথায় ইউরোপের ‘না’ নেই। আমেরিকা শব্দ উচ্চারণ করতে না করতেই পশ্চিম ইউরোপের জি বা ইয়েস স্যার বলা সাড়া। নজরুল ইসলামের মোসাহেব কবিতার মতো। সাহেব বলেন চমৎকার, মোসাহেব বলেন, চমৎকার সে তো হতেই হবে, হুজুরের মতে অমত কার? আমেরিকার সবচেয়ে বড় মোসাহেব ব্রিটেন।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়, ১৫টি প্রজাতন্ত্রে বিভক্ত হয়। আমেরিকা খুশিতে গদ গদ হয়, সে একক পরাশক্তিতে পরিণত হয়, তার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে কেউ রইলো না। তার দাস- দাসীর অভাব হলো না। সে দাস-দাসী নিয়ে সুখেই ছিল। সে আরো কিছু দাস-দাসী বৃদ্ধি করতে চাইল। তার এ মাঝপথ থেকে বাধা হয়ে দাঁড়াল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। কথায় বলে, নদী শুকিয়ে গেলেও তার বাঁক থাকে বারো বছর। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও রাশিয়া একেবারে মরে যায়নি। তাই সে আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ইউক্রেন আক্রমণ করে বসে। কারণ, ইউক্রেন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ছাপোষা। সে ছাপোষা যাচ্ছে আমেরিকার দাসত্ব জোটের সদস্য হতে।
এক কর্তৃত্ববাদী আরেক কর্তৃত্ববাদীকে সহ্য করে না। পৃথিবীর বড় কর্তৃত্ববাদী দেশ হচ্ছে আমেরিকা। সে জানত, ভবিষ্যতে রাশিয়া তার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। রাশিয়ার সাথে কেউ লেনদেন, ব্যবসা বাণিজ্য বা বন্ধুত্ব করুক- এটা সে পছন্দ করত না। আমেরিকা মুক্ত বাজার অর্থনীতির কথা বলে, অথচ কেউ রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় করলে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। আমেরিকার কাছ থেকে ক্রয় করলে সাধুবাদ আর রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রয় করলে নিন্দাবাদ। এ হচ্ছে আমেরিকার মতবাদ। রাশিয়া হচ্ছে আমেরিকার সতীনস্বরূপ। সতীনকে এক হাত নেওয়া স্বভাবজাত বিষয়। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের উছিলায় আমেরিকা মওকা পেয়ে যায়। তাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক হাত নিতে আমেরিকা ও তার কলোনিগুলো উঠে পড়ে লাগে। তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকে। রাশিয়ার রিজার্ভ জব্দ করা হয়েছে, সুইফট থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।
রাশিয়ার রপ্তানি আয়ের বড় উৎস হচ্ছে তেল, গ্যাস। রাশিয়ার অর্থনীতি ধ্বংস করতে আমেরিকা ও তার কলোনিগুলো মিলে রাশিয়ার তেল, গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। বাস্তবতা হচ্ছে আমেরিকার ইউরোপীয় কলোনি রাশিয়ার তেল, গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। কলোনির দাসগুলো কর্তার ইচ্ছায় জি হুজুর বলে পড়ছে বিপদে। দাসগুলো রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও গ্যাসের ওপর এখনো দেয়নি। বিকল্প খুঁজছে। বিকল্প পেলেই তারা রাশিয়ার গ্যাস ক্রয় বন্ধ করে দিবে। রাশিয়া তা টের পেয়ে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, যেকোনো সময় বন্ধও করে দিতে পারে। এ জন্য মার্কিন ইউরোপীয় কলোনিগুলো তেল-গ্যাসের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। যেকোনো উপায়ে তাদের তেল-গ্যাস চাই। এ সুযোগে মধ্যপ্রাচ্য তেল-গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ইউরোপের চাহিদার তুলানায় তারা সরবরাহ দিতে পারছে না। বিপদে পড়ছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকার ন্যায় দেশগুলো। উচ্চমূল্যেও মিলছে না তেল-গ্যাস। অথচ তেল-গ্যাস ছাড়া গাড়িও চলে না, কলও চলে না, বিদ্যুৎও মেলে না। এখন উপায় কী?
আমার মনে হয় উপায় একটা আছে। আর তা হচ্ছে ভারতের কাছ থেকে তেল ক্রয়। যদিও ভারত তেল আমদানি নির্ভর দেশ। ভারত ও চীন আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে তেল ক্রয় কয়েকগুণ বাড়িয়েছে। ভারত ও চীন ডিসকাউন্টে রাশিয়ার তেল ক্রয় করে পাহাড়সম মজুত গড়ে তুলেছে। সব দেশে তেলের দাম বেড়েছে। আর ভারত তেলের দাম কমিয়েছে। রাশিয়ায় তেল, গ্যাসের অভাব নেই। কয়েক দিন আগেও রাশিয়া আর্কটিক অঞ্চলে পেচোরা সাগরে আরেকটি বড় তেল খনির সন্ধান পেয়েছে। রাশিয়ার তেলের মানও ভালো। সৌদি আরব পৃথিবীর বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক দেশ। সে-ও রাশিয়া থেকে তেল ক্রয় দ্বিগুণ করেছে। সৌদির বিদ্যুৎ উৎপাদনে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল ব্যবহৃত হয়। এই মুহুর্তে বাংলাদেশ ভারত থেকে তেল ক্রয়ের তদবির করতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারেন। আমার মনে হয়, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ করলে নরেন্দ্র মোদি বিষয়টি বিবেচনা করবেন। যদিও আমেরিকা বিষয়টি ভালো চোখে দেখবে না। না দেখলেও আমেরিকা ভারতকে কিছু বলবে না। রাশিয়ার নিকট থেকে যে দেশই আকাশ নিরাপত্তা এস ৪০০ ক্রয় করেছে, যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ন্যাটোর সদস্য তুরস্কও সেই নিষেধাজ্ঞা থেকে রেহাই পায়নি। শুধু ভারতকে রেহাই দিয়েছে। ভারতকে রেহাই দেওয়ার জন্য মার্কিন কংগ্রেস গত সপ্তাহে বিল পাস করেছে।
কেউ বলতে পারেন, বাংলাদেশ সরাসরি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করলেই তো পারে। না, তা পারে না। কারণ বাংলাদেশ, পাকিস্তানের ন্যায় দেশগুলো রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার কলোনিগুলো সাথে সাথে নিষেধাজ্ঞা দিবে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে চাইলে আমেরিকার কুটচালে তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। তবে আমেরিকা চীন বা ভারতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিবে না। কারণ তারা বড় দেশ, বড় শক্তি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তারা রাশিয়ার পক্ষে যোগ দিতে পারে। তাহলে পৃথিবীর ভারসাম্য অন্য রকম হয়ে যেতে পারে।
ব্রিটিশ বা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কর্তৃত্ববাদী, সুবিধাবাদী, নীতিহীন ও প্রতিহিংসাপরায়ন। তাদের নিজ দেশে গণতন্ত্র আছে। কিন্ত বাইরে গণতন্ত্রের ধারেকাছেও না। ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোই তো সারা বিশ্বে মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে কলোনি স্থাপন করেছে, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ইংরেজরা এদেশের শত শত মানুষকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ভিক্টোরিয়া (বর্তমানে বাহাদুরশাহ) পার্কে ঢাকঢোল পিটিয়ে মানুষ জড়ো করে প্রকাশ্যে বিদ্রোহীদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার পাঞ্জাবের জালিওয়ানাবাগের জনসভায় গুলি করে ৪০০ লোককে হত্যা করে, অগণিত লোককে আহত করে। আজ তারা শেখায় মানবাধিকার, গণতন্ত্র!
ইউরোপীয়ানরা সারা পৃথিবীর সম্পদ লুন্ঠন করে আজ তারা সাধু সেজেছে। ভাবটা এমন যেন -বারো খোপের কবুতর খেয়ে বিড়াল হয়েছে বৈষ্ণব। ইউরোপ আমেরিকার ইতিহাস হচ্ছে রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস। তারা আমেরিকার আদিবাসীদের হত্যা করে তাদের দেশ দখল করে আছে। তারা জাপানে পারমানবিক বোমা ফেলে নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, ভিয়েতনামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বোমা মেরে হত্যা করেছে। তারা ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তানে রক্তপাত ঘটিয়েছে। তারা ধর্মান্ধ জঙ্গি তৈরি করে, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে জঙ্গিদের হত্যা করে। তারা গণতন্ত্রের কথা বলে আর মধ্যপ্রাচ্যের অগণতান্ত্রিক সরকারের রাজা বাদশাহদের সঙ্গে মাখামাখি করে বেড়ায়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান, সিরিয়া ও লেবাননে স্বল্প মাত্রায় হলেও গণতন্ত্র আছে। অথচ সেসব দেশগুলোকে পশ্চিমারা শত্রু মনে করে।
পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করতে গিয়ে নিজেরাই পঙ্গু হতে চলেছে। বিশেষ করে, আমেরিকার অনুগত দাস পশ্চিম ইউরোপ ধরাশায়ী হয়েছে। ইউরোর মান হ্রাস পেয়ে ডলারের নিচে নেমে গেছে। ইউরোপে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে গেছে। ইউরোপের গ্যাসের চাহিদার ৪০% সরবরাহ করে রাশিয়া। রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এতে পশ্চিমাদের কপালে কালো রেখার ছাপ পড়েছে। ইউরোপের দশা হচ্ছে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা। রাশিয়া শুধু তেল-গ্যাস রপ্তানি করে তাই-ই নয়, রাশিয়া বিশ্বে গম, ভুট্টা, সূর্যমুখী তেল রপ্তানি করে। ইউক্রেনও এসব রপ্তানি করে। গম ও সার রপ্তানিতে রাশিয়া প্রথম। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বে জ্বালানী সংকটের সাথে সাথে খাদ্য সংকটও দেখা দিয়েছে। উৎপাদন ব্যবস্থা জ্বালানীর ওপর নির্ভরশীল। জ্বালানীর দাম বৃদ্ধি মানে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন হ্রাস পাওয়া, বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া, সমাজে অস্থিরতার আবির্ভাব ঘটা। রাশিয়া ও ইউক্রেন খাদ্য রপ্তানি না করতে পারলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। আফ্রিকার অনেক দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে। আশার কথা যে, জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের গম রপ্তানির ব্যবস্থা হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে জ্বালানী সংকটের জন্য দায়ী আমেরিকা ও তার কলোনী পশ্চিম ইউরোপ। তারা আজ রাশিয়ার তেল, গ্যাসের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিক, আগামীকালই তেলের দাম অর্ধেকে নেমে আসবে। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার খেসারত সারা বিশ্বকে দিতে হচ্ছে। এটা কি মানবাধিকার লংঘন নয়? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থ বলেছেন যে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কোনো সমাধান নয়, বরং এটি মানবাধিকার লংঘনের শামিল।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।
দ্রষ্টব্যঃ প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।