‘মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস
মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।’
আজ বিজয়ের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে যাকে প্রথমেই স্মরণ করতে হয়; যাকে ছাড়া অধরাই থেকে যেত বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন, মুক্তির স্বপ্ন; তিনি হলেন বাঙালি জাতির কাণ্ডারি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিশ্বের চিরবিস্ময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে ইতিহাস, সৃষ্টি হয়েছে গাঙ্গেয় বদ্বীপের একটি বিশাল জাতির জন্মগাথা।
এই একটি মানুষ যার কর্মজীবনের প্রতিটি স্তরে রচিত হয়েছে এক মহান মুক্তিসংগ্রামের অমর পঙ্ক্তিমালা। বাঙালির হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে কখনো তার আত্মপরিচয়ের সন্ধান ছিল না, কখনো তার আত্মপরিচয়ের ইতিহাস ছিল না। এই মহান মানুষটি এ জাতির অপ্রাপ্তির যাতনার অবসান ঘটিয়েছেন।
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ভেবেছিল বাংলাদেশের হৃদয় থেকে তার নাম চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেবে; ৭১-এ পরাজিত শক্তির করতলে আবার দেশটাকে নিপতিত করবে। কিন্তু সত্য এটাই যে, যতই সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে ততই তিনি অধিকতর ঔজ্জ্বল্য নিয়ে পরিব্যাপ্ত হচ্ছেন। তার দেশপ্রেম, তার দূরদর্শিতা, তার জাদুকরী সাংগঠনিক ক্ষমতা, তার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য সারা জীবনের সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে একটি জাতিকে শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, সেই ইতিহাস, সেই অমর কীর্তিকে ঘাতকরা কি মুছে দিতে পেরেছে? বরং তার বিশ্বাসের এই দেশ আজ পৃথিবীর বিস্ময়, অর্ধশতাব্দীতে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পুরো বিশ্বকে সম্মোহিত করে এগিয়ে চলেছে দোর্দণ্ড প্রতাপে।
আজ স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে যদি একটু ফিরে দেখি কেমন ছিল দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ ও ব্যবচ্ছেদ, তাহলে সহজেই দেখা যাবে—এ দেশটি তার বেশিরভাগ সময়ই অতিবাহিত করেছে সামরিক ফন্দিবাজ, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি, সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় মৌলবাদ আর ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতাপ মোকাবিলা করে। বিশেষ করে ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরেই এ জাতির জীবনে নেমে এসেছিল এক দীর্ঘ অমানিশার কৃষ্ণবিবর। যারা পরবর্তীকালে দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে নেতৃত্ব দেবেন, আমরা সেই জাতীয় চার নেতাকেও হারিয়ে ফেললাম। নির্মমভাবে জেলখানার মধ্যে তাদের হত্যা করা হলো। বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয়কে দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি, বিদেশেও পরিচয় গোপন করে ভাড়াটে গুপ্তঘাতকের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করতে হয়েছে। সেখানেও তাদের হত্যার নানা পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আমরা দেখেছি ‘বিশ্ব বেহায়া’র দীর্ঘ সামরিক স্বৈরশাসন। পাকিস্তানের চর রাজনীতিকে যিনি জটিল করে দেওয়ার মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন; দেশটাকে আবার পাকিস্তানের আদলে তৈরি করে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়ার মিশন নিয়েছিলেন; শত শত মুক্তিযোদ্ধা আর্মি অফিসারকে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করেছিলেন, সেই জিয়াউর রহমানের নির্মমতা ও অমানবিকতারও সাক্ষী আমরা। আমরা এ-ও দেখি, এ স্বাধীন বাংলাদেশে ৭১-এ পরাজিত মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে নানাভাবে পুনরুজ্জীবিত করা, তাদের বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত করা, সরকারের অংশীদার করা। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও জামায়াত-হেফাজতের তাণ্ডব দেখেছি দেশব্যাপী। অর্থাৎ দেশটাকে যারা মেনে নেয়নি, সেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতেই দেশটি পরিচালিত হয়েছে সুদীর্ঘকাল। এরপরও, আজ আমরা যে দেশটিকে নিয়ে গর্ব করছি, সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি, যে অভাবিত উন্নতির জন্য পুরো বিশ্ব উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তাকে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পথটি কি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের জন্য এত সহজ ছিল?
অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত যে দেশটিকে বঙ্গবন্ধু ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তুলতে দিন-রাত পরিশ্রম করে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করলেন; জাতিসংঘ, ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সদস্যপদ অর্জন যখন বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিল তখনই বঙ্গবন্ধুকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হলো। তারপর দীর্ঘকাল দেশটি কানাগলিতে ঘুরপাক খেয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে চড়ে। তা সত্ত্বেও সময়ের পরিক্রমায় যখন আবার দুষ্টচক্রের হাত থেকে মুক্ত করে দেশটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির হাতে এসে পৌঁছেছে, তখন বঙ্গবন্ধুর দেওয়া রূপরেখা ও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আজকের বাংলাদেশকে পেয়েছি; যেই দেশটি দুর্বার গতিতে নিরলস ছুটে চলেছে জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তয়নের লক্ষ্য নিয়ে।
অর্ধশতাব্দীর পথচলার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আসলে কী? সুদূরপরাহত বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার, রাজাকারের বিচার এ বাংলায় দেখে যেতে পারবে বলে অনেকেই আশা ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর—সেটা সম্ভবপর হয়েছে; যা বাঙালি জাতিকে তার ইতিহাসের দায় ও কলঙ্কে কিছুটা হলেও মোচন করেছে। যে দেশটিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে পরিহাস করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, সেই দেশটিই আজ তাদের কপালে ভাঁজ ফেলে দেওয়ার মতো সফলতা অর্জন করেছে। আধুনিক কৃষি, তৈরি পোশাক, দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনীতি, রেমিট্যান্স, গড় আয়ু, আমদানি, রপ্তানি, রিজার্ভ, মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, নারী শিক্ষা, কলকারখানায় উৎপাদনসহ অনেক সূচকে এখন বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। দেশে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। একসময় বৈদেশিক অর্থ তথা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির অর্থ ছাড়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কল্পনাও করা যেত না।
এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভবপর হচ্ছে। সারা দেশের হাজার হাজার মাইলের মহাসড়ক নির্মাণ-সংস্কার, মেট্রোরেল, ট্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, রূপপুর পারমাণবিক প্ল্যান্ট, ওভার ব্রিজ, ফ্লাইওভার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবন, রেল উন্নয়ন, নৌপথ তৈরি, নাগরিকদের জন্য প্রায় শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত ছাড়াও সীমাহীন উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দেশ। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সুবিধা পাওয়া যায়। সামাজিক অনেক সূচকে বাংলাদেশ পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। কীভাবে দেশের এই অভাবিত উন্নতি ঘটেছে তা শেখ হাসিনার বিগত বছরগুলোর কর্মযজ্ঞের দিকে তাকালেই চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
জাতির পিতাকে হত্যা করে বাংলাদেশকে অভিভাবকশূন্য করে মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও শোষণহীন চেতনার যে রাষ্ট্র দর্শন তাকেও হত্যা করার অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। দেশটাকে সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় রাজনীতির আখড়ায় পরিণত করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তার বিষদাঁত আজও বাংলাদেশকে খুবলে খাচ্ছে! বঙ্গবন্ধু তার স্বল্প সময়ের শাসনকালে যেসব বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন, এত বছর পেরিয়েও দেশ-বিদেশে আজও অনুরূপ ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করে যেতে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যাকেও।
জাতির পিতা ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল জনসভায় বলেছিলেন— “আজকে আমার একটিমাত্র অনুরোধ আছে আপনাদের কাছে—আমি বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যুদ্ধ করতে হবে শত্রুর বিরুদ্ধে। আজকে আমি বলব বাংলার জনগণকে—এক নম্বর কাজ হবে দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে।... আমি গ্রামে গ্রামে নামব। এমন আন্দোলন করতে হবে যে, যে ঘুষখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিস বিদেশে চোরাচালান দেয়, তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।... আপনারা সংঘবদ্ধ হন। ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে। সে দুর্গ করতে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করার জন্য, বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখমোচন করার জন্য।”
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে বিধ্বস্ত করা, বাঙালি চেতনাকে বিনষ্ট করা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বোধকে মূলোৎপাটন করার যে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের সূচনা করা হয়েছিল, যেই অন্ধকার গ্রাস করেছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্নের দেশ-মাতৃকাকে ঘিরে, সেই ষড়যন্ত্র কিন্তু আজও থেমে যায়নি। তারা যে আজও সোচ্চার এবং সময় ও সুযোগ পেলেই যে ঘাড় মটকাবে—তা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। তারপরও এত বছর পর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এই ক্ষণে এ কথা জোর দিয়েই বলা যেতে পারে—বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নের পথেই আছে বাংলাদেশ; যার জন্য তিনি জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন। তিনিই বলেছিলেন, ‘রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব!’ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ‘দেশ থেকে সর্বপ্রকার অন্যায়, অবিচার ও শোষণ উচ্ছেদ করার জন্য দরকার হলে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করব।’ রক্ত দিয়েই ঋণ শোধ করেছিলেন তিনি।
আজ জাতিকে তার এ আহ্বান মনে রেখে এগোতে হবে। একই সঙ্গে লড়তে হবে কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা, অন্যায়-অবিচার আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে। মনে রাখতে হবে, আমরা পৃথিবীর বুকে সেই পরম সৌভাগ্যবান জাতি যার স্বাধীনতা দিবসের পাশাপাশি একটি বিজয় দিবসও আছে। যে জাতির একটা বিজয় দিবস থাকে সেই জাতি কখনো পরাজিত হয় না, হতে পারে না।
লেখক ● সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ ও প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা