• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল, ২০২৫, ১৮ চৈত্র ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৪, ২০২৩, ০৭:৩৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৫, ২০২৩, ০১:৪৭ এএম

তমসাভেদী প্রত্যুষের এই প্রতিজ্ঞা

তমসাভেদী প্রত্যুষের এই প্রতিজ্ঞা

বছরটা একাত্তর, মানে উনিশশো একাত্তর। মাসটা এপ্রিল, চৌদ্দ তারিখ। দেশটার নাম বাংলাদেশ। শহরটার নাম ঢাকা। স্থান—রমনা পার্ক। সময়—সূর্যোদয়ের প্রথম প্রহর, ভোর। কী ছিল সেই পলাশফোটা সকালের রমনা পার্কে? মানুষের পদচারণা ছিল না, পাখির কলকাকলি ছিল না, কোকিলের কুহুধ্বনি ছিল না, দখিনা সমীরণ ছিল না; ছিল বাতাসে বারুদ আর লাশের গন্ধ, মাঝেমধ্যে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক আর অস্ত্রসজ্জিত কনভয়ের ভারী চাকার ভয় জাগানো শব্দ, স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের হুঙ্কার। বেয়নেট গুলি আর রক্ত ঝরিয়ে দখল করা নগরী ছিল, সান্ধ্য আইনের তর্জনীতোলা নিষেধাজ্ঞার হিংস্র শাসন নিয়ে।

প্রত্যুষে পার্কের গায়ে লেপ্টে থাকা মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে পার্কের ভেতরে সন্তর্পণে পা রাখলেন এক প্রৌঢ়। পার্কের ভেতর দিয়ে গাছের আড়াল-আবডালে শরীর লুকিয়ে কোনোমতে রাস্তাটাকে পেরোতে পারলেই তার বাড়ির গলি। গলিও জনমানবহীন, তবু ওটুকু পার হতে হবে সাবধানে। সারা রাত লুটপাট ও খুনখারাবির পর খুনিরা ডেরায় ফেরে। আর তখন এ ভোরবেলাটায় ফাঁকা থাকে গলি। ঘরে ঢুকে পড়ার এটাই প্রকৃষ্ট সময়।

প্রৌঢ় কোনোমতে গা বাঁচিয়ে চললেন পার্কের মাঝ বরাবর দিয়ে। অনেকটা যেন কোনো এক বেঁচে যাওয়া সৈনিক ধ্বংসস্তূপের ফাঁক দিয়ে সন্তর্পণে অথচ ত্বরিত পায়ে এপাশ-ওপাশ করে চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। ছোট ছোট গাছের ঝোপ, কোথাও কোথাও কৃষ্ণচূড়া শিমুল মেহগনি গাছের সারি, চারদিকে কোনো মানুষের চিহ্ন নেই এ সাতসকালে। এ অবস্থায় একটি চলমান কোনো প্রাণী সহজেই নজরে পড়ে। প্রৌঢ় সেটা বোঝেন। বোঝেন বলেই এ সতর্কতা। মসজিদের কেউ কেউ বলেছিলেন, এ অবস্থায় বেরোনো কি ঠিক হচ্ছে? কারফিউটা উঠে গেলে না হয় যেতেন।

তবু প্রৌঢ় বেরোলেন। এক দুর্নিবার আকর্ষণ তাকে যেন প্রবলভাবে টেনে বের করে দিচ্ছিল অবরুদ্ধ উপাসনালয়ের চৌহদ্দি থেকে। বাড়ি ফেরার তাগিদ তো আছেই। উৎকণ্ঠিত পরিবারের সদস্যরা যদি ঘুম থেকে জেগে ওঠে দেখে, তিনি মসজিদে গিয়ে আর ফেরেননি, তখন কী একটা বিশ্রী কাণ্ড হবে! কিন্তু তার চাইতেও আরও কিছু একটা ব্যাপার যেন রয়ে গেছে! লেকটাকে বাঁয়ে রেখে প্রৌঢ় এগিয়ে যাচ্ছেন, অদূরে ছোট্ট একটা গোলচত্বর। তার ওপর ছাতার মতো ছড়িয়ে রয়েছে একটা বিশাল পাকুড়গাছ। ওই গাছটি পরিচিতি পেয়েছে বটবৃক্ষের। সেই হিসেবে সেই সাতষট্টি সাল থেকে আজ অবধি ওই স্থানটির নাম রমনার বটমূল। মাত্র একটি বছর আগেও এ স্থান, এ রমনা পার্ক, এই প্রত্যুষকাল ছিল বর্ণিল উৎসবে মুখর। প্রৌঢ় ওই চত্বর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছেন আর ভাবছেন, আহা কী পবিত্র এ স্থান, এ রমনা পার্ক! এ পহেলা বৈশাখের সকাল প্রতিটি বাঙালির। এখানেই বাংলা, এখানে রবীন্দ্রনাথ, এখানেই নজরুল, বঙ্কিম, জীবনানন্দ দাশ, একুশে ফেব্রুয়ারি। আর এখন? এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার?

হঠাৎ তার চোখ পড়ল বৃক্ষের মূলের দিকে। প্রশস্ত বেদিটির ঠিক মাঝখানে, কী আশ্চর্য, একগুচ্ছ গোলাপ আর রক্তজবা! শুধু তাই নয়, সবুজ পাতা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন স্বাধীন বাংলার পতাকা। বাংলাদেশের মর্মমূলে যেন এ পতাকা প্রোথিত করে গেছে কোনো এক লড়াকু যুবক।

সমস্ত ভীতি-শঙ্কা, দানবের রোষকষায়িত লোচন—সবকিছুকে উপেক্ষা করে সেই প্রৌঢ় সেখানে সূর্যপ্রণামের ভঙ্গিতে চক্ষুমুদ্রিত করে কিয়ৎকাল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালেন। অস্ফুট কণ্ঠে গাইলেন—‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’

সেই প্রৌঢ়, যিনি ফজরের নামাজের শেষে টুপি মাথায় মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরছেন; সেই প্রৌঢ়, যিনি সময়মতো না ফিরলে ঘরে কান্নার রোল উঠবে এবং সেই প্রৌঢ় কোনো এক অদৃশ্য আকর্ষণে যিনি রমনার সেই পবিত্র বেদির সামনে বিনম্র শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছেন।

এটা সেই একাত্তরের কথা। একাত্তরের পলাশফোটা পহেলা বৈশাখের কথা, যখন অবরুদ্ধ দেশ শৃঙ্খলমোচনের জন্য প্রাণপণ লড়ছে। ঘটনাটি সেই প্রৌঢ় বর্ণনা করেছিলেন কোনো এক বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছিল বিভিন্ন সময়। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সেই প্রৌঢ়কে আমরা পেয়েছি, কিন্তু পাইনি সেই সাহসী বাঙালি সন্তানটিকে, যিনি একটি হিংস্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিঃশব্দে একক শক্তিতে যুদ্ধ করে অন্তর্হিত হয়ে গেছেন। একাত্তরের বাংলা নববর্ষে রমনায় সেই পাকুড়বৃক্ষতলে পুষ্পস্তবকটি নিবেদনের দাবি নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি অদ্যাবধি। সাধারণত এ ধরনের কৃতিত্বের দাবিদারের অভাব হয় না। এমনও হতে পারে, সেই সাহসী তরুণ ফেরার পথেই গুলির ঘায়ে ঝাঁজরা হয়ে গেছে!

আজ এ বায়ান্ন বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে একাত্তরের সেই ঘটনার কথাই মনে পড়ছে। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এখনো সক্রিয়। সুযোগ পেলেই তারা রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত করছে বাংলাদেশের মুক্তচিন্তা অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে।

যে তরুণ প্রজন্ম একাত্তরের ঘাতকদের বিচার দাবি করেছিল মুক্তিযুদ্ধের অবিনশ্বর চেতনা পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, দলে দলে রাস্তায় নেমেছিল; ধর্মের নামে ফতোয়া জারি করে তাদের একে একে হত্যার মাধ্যমে জঙ্গিবাদের এদেশি নিয়ামকরা দেশটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল পাকিস্তানের আদলে। কিন্তু তা হতে পারেনি। জঙ্গিবাদের প্রশ্রয়দাতারা আপাতত পশ্চাদপসারণ করেছে বটে কিন্তু পরাভূত কিংবা বিপর্যস্ত হয়নি। বরং তারা আঘাত করার জন্য গোপন প্রস্তুতিই নিচ্ছে হয়তোবা।

তবে যেহেতু দেশটার নাম বাংলাদেশ, এ দেশের মানুষরা যে কতখানি লড়াকু, ইতিহাসে বারবার তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। আর বাঙালির বৈশিষ্ট্যই হলো, আঘাত বাঙালিকে জাগায়। দুর্বৃত্তরা ভাষা কাড়তে গিয়ে পারেনি, কাড়তে পারেনি ভূখণ্ডকে, কাড়তে পারেনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে। তাই এবারও বাংলা নববর্ষ দানব-দমনের মন্ত্র নিয়ে আসবে এ বাংলায়। একাত্তরের অবরুদ্ধ নগরীকে রমনার নববর্ষের সেই বেদিমূলে যে পুষ্পার্ঘ্য প্রবল প্রতিরোধের নিঃশব্দ ঘোষণা দিয়েছিল, আজ তা লক্ষগুণ শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াবার জন্য তৈরি হচ্ছে।

 

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ এবং প্রধান সম্পাদক দৈনিক কালবেলা