রাত না পোহাইতেই মন্ত্রীর বাসগৃহের দরজায় উপর্যুপরি করাঘাত। ধড়ফড় করিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিল মন্ত্রী এবং মন্ত্রীর পত্নী উভয়েই। কিন্তু কেহই নড়ে না। চুপচাপ উৎকণ্ঠ হইয়া খেয়াল করিতেছে। এই কাকভোরে কার কী প্রয়োজন হইয়া পড়িল কে জানে! কটা-ঘটা নয়তো! কিংবা বিটু-মিঠু? কিন্তু ওদের কাহারও তো এভাবে হৈচৈ করিয়া হাঁকডাকের কথা নয়। তবে কি শত্রুপক্ষের কোনো চর! এরকম সাতপাঁচ ভাবিতে ভাবিতে মন্ত্রী সোজা খাটের তলায় ঢুকিয়া পড়িল, আর মন্ত্রিপত্নী হতভম্ব হইয়া খাটের উপর চাদর মুড়ি দিয়া বসিল।
বেশ কয়েকবার করাঘাতের পর কোনো প্রকার সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না, তখন শব্দ থামিল দীর্ঘক্ষণের বিরতি দিয়া। ঠিক এই সময় মন্ত্রিপত্নী দরজা সামান্য ফাঁক করিয়া দেখিল এক চেনা শরীর দূরে চলিয়া যাইতেছে। সে তখন খাটের তলায় নতস্বরে বলিল,
— ওগো শুনছো, মনে হচ্ছে আর কেউ নয়, দেখলাম গোপালের মতো একজন চলে যাচ্ছে। বোধহয় গোপাল দাদাই এসে ধাক্কাধাক্কি করছিল—
— কী বলো, গোপাল আসবে কোত্থেকে! গোপাল তো গত দুই-তিন সপ্তাহ নিখোঁজ হয়েই আছে। তুমি বোধহয় ভুল দেখেছো কিংবা হয়তো গোপাল ভূত হয়ে এই ভোরবেলায় আমাদের দরজায় ধাক্কাধাক্কি করছিল। তুমি তো জানো না যে, গত তিন সপ্তাহ ধরে গোপালের পাত্তা নেই, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রও নিখোঁজ। এমনকি বিজ্ঞানী, রাজকবি, সেনাপতিসমেত রাজদরবারের অনেকেই গা-ঢাকা দিয়েছে!—
— আরে না না, আমি দেখলাম তো গোপাল দাদা মাঠ পেরিয়ে নিজের বাড়ির দিকেই যাচ্ছে!
— না, গিন্নি, আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে!
— তা’হলে তুমি বরং যাও না গোপাল দাদার বাড়িতে, নিজে গিয়েই যাচাই করে এসো!
— কী বলো তুমি! ও যদি গোপাল না হয়ে গোপালের ভূত হয় তখন কি আমি বাঁচতে পারব, বলো তুমি। একদম ধরে ঘাড় মটকে দেবে না। বরং তুমি একটা কাজ করো না, তুমি একটা অজুহাত তুলে গোপালের বাড়ি গিয়ে গোপালের বউকে নিয়ে পুকুরঘাটে যাও না হয়। তার সঙ্গে কথাবার্তা বললে তো বুঝতেই পারবে গোপাল বেঁচে আছে, না ভূতের হাতে প্রাণ হারিয়েছে! হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও না গিন্নি, তাড়াতাড়ি যাও, আমার খুব অস্থির লাগছে।
অগত্যা মন্ত্রিপত্নী বিষণ্ন বদনে জলের কলস লইয়া গোপালের গৃহাভিমুখে যাত্রা শুরু করিল। গোপালের বাড়ির সামনে দেখা হইয়া গেল গোপালের সঙ্গে।
— এ কি আপনি এখানে! আমি তো একটু আগেই আপনাদের বাড়ি থেকে এলাম, আপনারা কেউ দরজাটাও তো খুললেন না!
— সে কী, আপনি গিয়েছিলেন বুঝি!
— হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো!
— খুব জরুরি কাজ আছে মন্ত্রীমশাইয়ের সঙ্গে।
— তাই নাকি, আমি মন্ত্রীমশাইকে কি বলব আপনার কথা?
— হ্যাঁ, বলবেন তো বটেই, আমিই তো বলতে গিয়েছিলাম আজ ভোরে আপনাদের বাসায়।
— আপনি কি আসবেন এখন আমাদের বাসায় গোপাল দাদা?
— না, এখন আর যাবো না। আপনি বরং মন্ত্রীমহোদয়কে গিয়ে বলুন, খুব তাড়াতাড়ি আজ রাজদরবারে আসতে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অধীর হয়ে আছেন আজ সবার সঙ্গে বসার জন্য।
—ওমা তাই বুঝি! আমি তাহলে গোপাল বৌদিকে নিয়ে ঘাট থেকে এক ঘড়া জল নিয়ে ফিরেই মন্ত্রীমশাইকে জানাচ্ছি।
মন্ত্রিপত্নী তড়িঘড়ি করিয়া পুকুর হইতে এক কলসি জল লইয়া ঘরে ফিরিতেই উদগ্রীব স্বামীর দেখা পাইল।
— কী দেখলে গিন্নি, ওটা কি আসল গোপাল, না গোপালের ভূত! আমার মনে হয় তুমি ভুলই দেখেছিলে।
মন্ত্রীর বউ এবার মন্ত্রীর দিকে তাকাইয়া বলিল,
— কী দেখলাম সেটা বলতে গেলে তো এমনি এমনি বলা যাবে না।
— তার মানে?
— মানে আবার কী! আমি তো তোমারই বউ, কত বছর ধরে ঘরসংসার করছি তোমার সঙ্গে। তোমার কাছ থেকে তো অনেক কিছু শিখেছিও। কী দেখলাম, সেটা বলতে গেলে তো এমনি এমনি বলা যাবে না! অমূল্য স্যাকরার কাছ থেকে যদি সোনার বিছে এনে দেবে বলো, তাহলে কী দেখেছি, বলব।
— সে কি গিন্নি তুমিও দেখছি কটা-ঘটার মতো আমার কাছ থেকে গয়না বাগানোর চেষ্টা করছ?
— তোমার কাছ থেকেই শেখা, মন্ত্রীমশাই! এখন তাড়াতাড়ি যদি রাজি না হও তাহলে কিন্তু তোমারই অসুবিধা! যা জেনে এসেছি, সেটা যদি এখন না বলি তবে কিন্তু তোমার বিপদ হবে!
গবুমন্ত্রী হতবাক হইয়া নিজের স্ত্রীর দিকে তাকাইয়া রহিল। অতঃপর ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলিল,
— গিন্নি, তুমি কিছু চাইলে কি আমি না করেছি কখনও! দেবো দেবো, যা চেয়েছ তা-ই দেবো। শুধু বলো কী দেখলে আর কী শুনলে!
— আচ্ছা, ঠিক আছে, এক্ষুনি সোজা যাও মহারাজের দরবারে, গোপাল দাদা বলেছে, একটু পরেই রাজসভা বসবে আর তোমাকে অবশ্যই সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।
—সে কি! মহারাজও জীবিত, গোপালও জীবিত! হায় ভগবান, আমার কৃষ্ণনগরের সিংহাসনে বসার কী হবে!
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ এবং প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা