• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৫, ২০২৪, ০৭:৪৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৫, ২০২৪, ০৭:৪৪ পিএম

কারা করবে রাজনীতি

কারা করবে রাজনীতি

রাজনীতি করবে তারা যাদের পরিবার রাজনীতি করেছে। উত্তরাধীকারসূত্রে।

-না। মেনে নিতে পারলাম না। বাপ-মা রাজনীতি করেছে বলে তাদের সন্তানরাই কেবল রাজনীতি করবে কেন? আর মানুষের হক নেই দেশসেবা করার?

 তাহলে ছাত্ররা করবে।

-কী যে বলেন! ছাত্ররা রাজনীতি করলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে।

শিক্ষকরা করবে। তারা যেহেতু ছাত্রদের ভবিষ্যৎ গড়তে পারে, দেশ গড়তে তারাই সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত।

-উঁহু! তাতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে কারা?

মিডিয়া জগতের লোকজন করবে। সাংবাদিক, লেখক, সম্পাদক, পত্রিকার মালিকেরা করবে।

-তাহলে মিডিয়া দলকানা লোকজনে ভরে যাবে।

নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, টিক-টকার, ফেবুর মোটিভেশন স্পীকার, প্রযোজক, পরিচালকরা করবে।

-কী যে বলেন! ওদের কী যোগ্যতা আছে রাজনীতি করার? মানুষে চিনলেই রাজনীতি করা যায় নাকি?

ব্যবসায়ীরা করবে।

-তাহলে অর্থনীতির বারোটা বাজবে। ব্যবসায়িক স্বার্থে পলিসি তৈরি হবে। লুটপাট হবে।

আমলারা করবে।

-আরও বেগমপাড়া তৈরি হবে তাতে।

প্রতিরক্ষার লোকজন করবে।

-তাতে বিদ্রোহের আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

আইনপেশার সাথে জড়িত উকিল-ব্যারিস্টাররা করবে রাজনীতি।

-আইনপেশার লোক হলেই কি ভালো আইন তৈরি করতে পারবে? তাদেরই একজন আমাদের সংবিধান লেখায় কাজ করেছেন। সেখানে সাংসদ হবার একটা সাধারণ শিক্ষাগত যোগ্যতার বাধ্যবাধকতাও রাখেননি।

কৃষক, মুদি দোকানদার, চা-বিক্রেতা, দারোয়ান, ঝাড়ুদার, রিকশাওয়ালা, সবজিওয়ালা, দিনমজুর, বুয়া, রাঁধুনী, বাবুর্চি-এরা যদি করে?

-একটা মিনিমাম যোগ্যতা তো থাকবে।

যোগ্যতা? রাজনীতি করতে যোগ্যতা লাগে? সাংসদ হতে যোগ্যতা লাগে? কী সেই যোগ্যতা?

সংবিধানের ৬৬(১) ধারায় যোগ্যতা বলতে কেবল বাংলাদেশী নাগরিকের পঁচিশ বছর বয়স হতে হবে এমন বলা হয়েছে।

৬৬(২) ধারায় কিছু অযোগ্যতার বর্ণনা আছে। যেমন-পাগল বা অপ্রকৃতস্থ নয়, দেউলিয়া নয়, বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিক নয় এবং দন্ডপ্রাপ্ত আসামী নয়-এমন বলা আছে।

উত্তরাধিকার সূত্রের কথা বলা নেই। কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার দরকার নেই। সকল পেশার লোকের জন্য উন্মুক্ত। এখানে নারী ও পুরুষ উভয়েই সমান যোগ্য বলে আমরা ধরে নিতে পারি।

এখন বিভিন্ন দলের কাছে যাই।

কোনো দলের কোনো কমিটিতে জায়গা পেতে আপনার কী যোগ্যতা লাগবে-কোনো পলিসি তৈরি হয়নি। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে একজন ডক্টরেট ডিগ্রীধারীকে জেলা এমনকি উপজেলা কমিটিতে সদস্য পদেও জায়গা দেয়া হয়নি। হয়ত পলিসি নেই। শিক্ষার মূল্য নেই। কিংবা কোনো নীতি থাকলেও সেটার প্রয়োগ নেই।

এখানে সবকিছুই ‘রিলেশন বেজ্ড‌’, ‘রুল বেজ্ড‌’ নয়।

সাংসদদের মোটামুটি সবারই রাজনীতিবিদ আত্মীয়স্বজন রয়েছে। এর বাইরে হাতে গোনা লোকজনকে আমরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে খুঁজে পাই।

কোথাও ‘এক তৃতীয়াংশ নারী’ অন্তর্ভুক্তির কথা লেখা আছে। তবে বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। তবে কমিটিগুলোতে নারীদের জন্য ‘মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা’ নামে একটি আজব পদ আছে। এ পদের কাজ কি কেবল শোভা বর্ধন করা করা কি না কে জানে? কারণ সেখানে পুরুষবিষয়ক সম্পাদকের কোনো পদ নেই। দল নারী শাসিত হলেও সিস্টেম পুরুষ শাসিত। তাই নারী হলে তার মাতা-পিতা, স্বামী, ভাই, মামা, চাচা এমনকি সন্তান রাজনীতিবিদ হলেও সেটা মূল্যায়িত হয় তার বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তিন ওয়ার্ডের ভোটাররা সম্মিলিতভাবে যে নারীকে নির্বাচিত করে মিউনিসিপ্যালটিতে পাঠায় তারা তিন, সেই তিন ওয়ার্ডের তিন পুরুষ কাউন্সিলরদের কাছে প্রায়ই নিগৃহিত হন সংরক্ষিত আসনের ‘নারী’ কাউন্সিলর বলে (অথচ ভোটের হিসেবে তারা তিন কাউন্সিলরকেই টেক্কা দিতে পারেন নির্বাচিত বলে)। এই সংরক্ষিত আসন নারীদের জন্য অপমানজনক এবং একইসাথে বৈষম্যমূলক একটি ব্যবস্থা। এতে মানসিকভাবেও তারা পঙ্গু‌; ওয়ার্ডভিত্তিক আসনে প্রতিদ্বন্দিতা করার কথা তারা ভুলেও মাথায় আনে না। কেন? কারণ তারা পুরুষ কাউন্সিলরদের ‘ভয়’ পায়।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনশো আসনে মাত্র বিশজন নারী বিজয়ী হয়েছেন, যা সাত শতাংশের কম। আবার মোট প্রার্থীর ভিত্তিতে নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ পাঁচ শতাংশেরও (৯৬/১৯৬৯) কম-যা নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে এক হাস্যকর পরিসংখ্যান।

নারীদের জন্য পঞ্চাশটি সংরক্ষিত আসন রয়েছে। হিজরা এবং ট্রান্সজেন্ডাররাও চাচ্ছেন এই সংরক্ষিত আসনের অংশ। এবারের নির্বাচনে সাধারণ আসনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পাচ্ছে ৩৭টি আসন এবং জাতীয় পার্টি ২টি। নারীদের এতে কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে বাছাই (সিলেকশন‌; নির্বাচন হবার নজির নেই) করা হবে, তার কোনো পলিসি নেই। তাছাড়া এবারে ৬২জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জোট গঠন সাপেক্ষে যে ১০ বা ১১টি আসন পাচ্ছে, তারাই বা নারীদের কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে মনোনয়ন দেবেন, তাও পরিষ্কার নয়। স্বতন্ত্র বিজয়ীদের মধ্যে মাত্র তিনজন নারী ব্যতিরেকে বিষয়টি দাঁড়ায় প্রতি ছয়জন পুরুষের বিপক্ষে একজন নারী। সমাজ ও রাজনীতিতে নারীর অবস্থান ও সমানোধিকারের প্রেক্ষাপটে এটি নারীদের জন্য একটি চরম অপমানজনক অগ্নীপরীক্ষা।

দ্বাদশ সংসদে ব্যবসায়ী সাংসদ অনেক। মোটামুটি জাতীয় সংসদ একটি বিজনেস ক্লাব হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।  ‘সুজন’-এর হিসাবমতে প্রায় ৬৭% (২০০/২৯৯) ব্যবসায়ী রয়েছে। যেহেতু আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল। গড়ে প্রতিটি আসনে প্রায় তিন কোটির বেশি টাকা ব্যয় করেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এর মধ্যে একক প্রার্থীর সর্বোচ্চ ব্যয় আটত্রিশ কোটি সাতাত্তর লাখ টাকা (টিআইবি গবেষণা)।  সুতরাং কোটিপতি ৯০% (‘সুজন’ প্রতিবেদন) দেখে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তার মানে জনপ্রতিনিধি হতে আপনার টাকা থাকতেই হবে।

যে কোনো অফিসে একজন পিয়ন নিয়োগ করতে হলেও আমরা নূন্যতম অষ্টম শ্রেণি পাস যোগ্যতা চাই।  সেখানে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ব্যয়ে চালিত একটি অফিস যেখানে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে আইন প্রণিত হয়, যেটি পরিচালনা করতে মিনিটে দুই লক্ষ টাকা ব্যয় হয় -সেখানকার সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কেমন, সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করি। আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে যদি স্নাতক ধরা হতো, তাহলে পঞ্চাশ শতাংশ হয়তো শুরুতেই বাদ পড়ে যেত। তবে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ৮২.৬০ শতাংশ স্নাতক (সুজন প্রতিবেদন)। এটি আশার ও সম্ভাবনার কথা যে মানুষ শিক্ষিত ব্যক্তিত্বকে তাদের জন্য নির্বাচিত করার সুযোগ পেয়েছে। এর সাথে সাথে আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ-এরকম ইনটেলেকটুয়াল্চদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া উচিত। সরাসরি নির্বাচন না হলে সংরক্ষিত আসন তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ে এলে দেশের নৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় উন্নয়ন সাধিত হবে বলে আমার ধারণা।

পরিশেষে আমরা কী পেলাম? কারা হবে সংসদ সদস্য? কারা হবে জনগণের প্রতিনিধি? সৎ, যোগ্য, নির্লোভ, দেশপ্রেমিক, দায়িত্বশীল ও দূরদর্শী একজন প্রার্থী-সামগ্রিক একটি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া আমাদের থাকা উচিত। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সংবিধানে যদি নতুন ধারা সংযোজন করা যায়-ভাল। যারা বর্তমানে প্রতিনিধি হিসেবে আছেন তাদের এ বিষয়ে আরও সচেতন এবং সক্রিয় হতে হবে। তাতে দলীয় মূল্যায়ন আরও স্মার্ট এবং যুগোপযোগী হবে। আর জনগণ তাদের জন্য চৌকস জনপ্রতিনিধি বা স্মার্ট পার্লামেন্টারিয়ান বা সাংসদ নির্বাচনের সুযোগ পাবে।

 

লেখক : নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক, লেখক ও সমাজকর্মী

 

দ্রষ্টব্যঃ প্রকাশিত নিবন্ধটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-​দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।