শীতের সকাল। ঘনকুয়াশায় মোড়ানো সকালের রাজধানী। যাচ্ছি রমনা বটমূলে। পথেই মুঠোফোন বেজে ওঠে। অচেনা নাম্বার। ঘড়ির দিকে তাকাই, নয়টা বাজতে বিশ মিনিট বাকি। ফোন রিসিভ করি।
‘আজ কি তরুপল্লবের গাছ চেনানোর অনুষ্ঠান হবে? আমরা কয়েকজন চলে এসেছি।’
বললাম, আমরাও এসে প্রায় চলে এসেছি। একটু অপেক্ষা করুন।
দেখতে দেখতে শতাধিক প্রকৃতিপ্রেমী এসে জড়ো হলেন রমনা বটমূলে। প্রথমেই এলেন কথাসাহিত্যিক ও নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া এবং পাখি বিশেষজ্ঞ শরীফ খান। তারপর বৃক্ষসখা অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। এঁরা এসেছেন গাছ ও পাখি চেনাতে। মূল কার্যক্রম শুরুর আগে সবাই বৃত্তাকার হয়ে দাঁড়ালেন। শুরুতেই অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা স্বরণ করলেন প্রয়াত নিসর্গী ড. নওয়াজেশ আহমদকে। তিনি তরুপল্লবের প্রথম অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। এরপর তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হলো তরুপল্লবের তৃতীয় গাছ চেনানোর অনুষ্ঠান। মূলত রমনা পার্ককে কয়েকটি অংশে ভাগ করে গাছ চেনানো শুরু হয় ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে। বটমূল থেকে বৃক্ষপ্রেমীরা দলবদ্ধভাবে এগিয়ে গেলেন রমনার নির্ধারিত গাছপালার দিকে। এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। মিছিলের অগ্রভাগে প্রকৃতির কয়েকজন নির্মোহ ভালোবাসার মানুষ, তাঁদের পেছনে বর্তমান প্রজন্ম। একেকজন একেক বয়সী, পরস্পর অচেনা, পেশায়ও আলাদা। কিন্তু সবার উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন।
তরুপল্লব মূলত বৃক্ষপ্রেমিদের সংগঠন। সংগঠনটির অনেকগুলো উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম হলো উৎসাহী মানুষদের গাছ চেনানো। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে তরুপল্লব অনানুষ্ঠানিকভাবে আরো বেশ কিছু গাছ চেনানোর অনুষ্ঠান করেছে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকায়, পরে বিভাগীয় শহরগুলোতেও পর্যায়ক্রমে এধরনের আয়োজন বিস্তৃত করেছে সংগঠনটি। ইতিমধ্যেই ঢাকার বাইরে কয়েকটি গাছ চেনানোর অনুষ্ঠানও করেছে তরুপল্লব। শুধুমাত্র ই-মেইল, ফোন, এসএমএস ও পত্রিকায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গাছ চেনার আহ্বান জানানো হয় সবাইকে। তাতেই বিপুল সাড়া মেলে।
গাছ চেনানোর সুবিধার্থে পার্কটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে প্রতিটি অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি করা হয় একটি ছোট্ট নির্দেশিকা। নির্দেশিকায় বর্ণিত গাছগুলোই মূলত উপস্থিত সবাইকে চিনিয়ে দেওয়া হয়। কালভার্ট পেরিয়ে সবাই এসে জড়ো হলো অঞ্জন গাছের নিচে। একজন সদস্য হাত মাইকটি এগিয়ে ধরলেন। গাছের পরিচিতি বর্ণনা শুরু করলেন বিপ্রদাশ বড়ুয়া। তারপর মিছিলটি গিয়ে দাঁড়াল আরেকটি গাছের নিচে। কাছেই ছিল রুদ্রপলাশ। এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অনেক কথা হলো। ততক্ষণে চারপাশের কুয়াশা কমেছে। দ্বিজেন শর্মা এবার সবাইকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করান। ‘এই হচ্ছে প্রকৃত মাধবী। আপনারা এতদিন যাকে মাধবী ভেবেছেন তা মাধবী নয়, মধুমালতী।’
উপস্থিত সকলেই দুষ্প্রাপ্য মাধবী চিনল বেশ আগ্রহ নিয়ে। তরুপল্লবের ছোট্ট নির্দেশিকায় যে ত্রিশটি গাছ চেনানোর কথা, ধীরে ধীরে সবগুলো গাছই চিনিয়ে দেওয়া হলো সেদিন। অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ দিকে তরুপ্রেমিকদের দলটি চলল রমনার শতোর্ধ্ববর্ষী আদি মহুয়ার সন্ধানে। গাছটির অবস্থান পার্কের প্রায় মধ্যিখানে। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা বারটায় গড়াল। সবুজ পৃথিবীর ডাকে যারা এসেছিলো তাদের দীর্ঘ মিছিল একটি নান্দনিক বৃক্ষের তলায় থামল। বৃক্ষটির নাম বিলেতী গাব। উপস্থিত সবাইকে গাছটি চিনিয়ে দেয়া হলো। অবশেষে তরুপল্লবের সাংগঠনিক সম্পাদক ইংরেজির অধ্যাপক দেবাশিষ বিশ্বাস গেয়ে শোনালেন ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ গানটি। তারপর উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ হলো অনুষ্ঠান।
তরুপল্লব কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে
দেখতে দেখতে অনেক সময় পেরিয়ে গেল। ২০২২ সালের মার্চ মাসে মুন্সিগঞ্জের সরদার পাড়ায় হয়ে গেল সংগঠনটির ৩১তম গাছ দেখা গাছ চেনা অনুষ্ঠান। কেন এই আয়োজন?
শুধুমাত্র বই-পত্রিকা পড়ে কিংবা টেলিভিশন দেখে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি যাওয়া যায় না। ভালোভাবে চেনা যায় না ফুল, পাখি বা প্রকৃতিকে। একারণে কয়েকজন প্রকৃতিপ্রেীম লেখক ও গবেষক (অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা, ড. নওয়াজেশ আহমদ, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, সুজন বড়ুয়া, মোকারম হোসেন প্রমুখ) তরুপল্লব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। শুধু তা-ই নয়, শহরে বেড়েওঠা প্রজন্ম পাখি চেনে না। গাছ চেনে না। ফুল চেনে না। নতুন প্রজন্মকে নিসর্গ চেনানোর জন্য তাঁরা লিখছেন, কিন্তু সবাইকে আরো নিবিড়ভাবে প্রকৃতির সান্নিধ্যে পৌঁছে দেবার জন্য এমন একটি সংগঠন খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে শুধুমাত্র গাছ চেনানোই নয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে আরো কিছু সেবামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করছে তরুপল্লব।
তরুপল্লব কী কাজ করে
সবুজে শ্যামলে বাঁচুক প্রাণ এ প্রতিপাদ্য নিয়ে তরুপল্লব প্রকৃতি ও পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে তৃণমূল পর্যায় থেকে কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে সরকারি নিবন্ধনের কাজ। তরুপল্লবের এই বৃক্ষ ও পরিবেশ সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানটি সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কেউ চাইলে তরুপল্লবের নিজস্ব ওয়েবসাইটে গিয়ে www.tarupallab.org তথ্যপত্র পূরণ করে অথবা ফেসবুকে tarupallab গ্রুপে অন্তর্ভূক্ত হয়ে তরুপল্লবের সকল খোঁজখবর জানতে পারেন। তবে স্থায়ী সদস্য হতে হলে আরো কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়।
উদ্যানকর্মীদের নিয়ে কর্মশালা
বিভিন্ন নার্সারীতে যারা গাছের চারা তৈরি করে, তাদের নিয়ে তরুপল্লব কর্মশালা করে থাকে। উদ্যানকর্মীরা যেন দেশিয় ভাল গাছের চারা বেশি পরিমাণে তৈরি করে এবং পরিবেশের সঙ্গে বৈরি এমন ধরনের বিদেশি গাছের চারা উৎপাদন থেকে বিরত থাকে সে বিষয়ে ব্যাপক ধারণা দেওয়া হয়। পাশাপাশি কিভাবে সেসব গাছের বীজ সংগ্রহ করবে, চারা তৈরি করবে, সেসব কলাকৌশলও হাতেকলমে শেখানো হয়। কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দেবার জন্য উপস্থিত থাকেন দেশের কৃতি উদ্ভিদ ও পরিবেশবিদগণ।
মুখপত্র ‘প্রকৃতিপত্র’ প্রকাশ
তরুপল্লবের মুখপত্র হিসেবে প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক সাময়িকী প্রকৃতিপত্র প্রতি তিনমাস পরপর নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এপর্যন্ত প্রকৃতিপত্রের ২৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।
বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি
দেশে যেসব গাছ বিপন্ন এবং দুর্লভ, তরুপল্লব সেসব গাছ সংগ্রহ করে নিরাপদ স্থানে রোপণের ব্যবস্থা করে থাকে। এছাড়া সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে এপর্যন্ত গাজীপুর জেলার পুবাইল খিলগাঁও মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়, রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, গাজীপুর আরণ্যক, শেরপুর জেলা প্রশাসন চত্বর, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, এবং রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনায় বৃক্ষরোপণ করেছে।
রঙিন উদ্যান তৈরি
গ্রীষ্মে জারুল, সোনালু এবং কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটে। জারুলের রং বেগুনি, সোনালু ফুল হলুদ-সোনালি রংয়ের আর কৃষ্ণচূড়ার রং লাল। এ তিন রংয়ের বর্ণবৈচিত্র কাজে লাগিয়েই আইডিএলসির অর্থায়ন এবং গ্রিন ক্যাম্পাসের সহযোগিতায় দেশে প্রথমবারের মতো ত্রিশাল কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩.৬ কিমি সংযোগ সড়কে তৈরি করা হয়েছে একটি কালার গার্ডেন। সেখানে ভবিষ্যতে পুষ্প উৎসব করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিতে শিক্ষামূলক কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান
২০১১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সরকারের MATT 02, STAGE 02, BATCH 10, GROUP C কর্তৃক পরিচালিত পরিবেশ সচেতনতা ও জাতীয় সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অপচয় রোধকল্পে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে তরুপল্লব নানাভাবে সহযোগিতা প্রদান করে।
পরিবর্তিত জলবায়ু বান্ধব বৃক্ষের ধারণা
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের উপকুলীয় ১৪টি জেলায় প্রাকৃতিক বৃক্ষ-বেস্টনির ক্ষেত্রে যে হুমকি তৈরি হয়েছে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য তরুপল্লব দুর্যোগ সহিষ্ণু গাছপালা রোপণের জন্য একটি রূপরেখা প্রদান করেছে। বিভিন্ন নার্সারী যেন এধরনের গাছের চারা তৈরি করে সেজন্যও তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে অতি দ্রুত আরো কিছু বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ
বৃক্ষ নিধন, বন উজাড় ও পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে তরুপল্লব সব সময় সোচ্চার থেকেছে। মানববন্ধনসহ নানামুখী সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে জনমত গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া বিভিন্ন পার্ক ও উদ্যানে গাছের নামফলক স্থাপনেও সহযোগিতা করছে তরুপল্লব।
তরুপল্লব দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ পুরস্কার প্রবর্তন
তরুপল্লবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মাকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০১৮ সাল থেকে প্রবর্তন করা হয়েছে ‘তরুপল্লব দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ পুরস্কার’। এই পুরস্কারের মূল্যমান ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা। পুরস্কারটি নিয়মিতভাবেই দেওয়া হচ্ছে।
মাধবীবরণ উৎসব
প্রতি বছর প্রকৃত মাধবী ফুল চেনানোর জন্য ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহে রমনা পার্কে মাধবীবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বিশেষ সম্মাননা অর্জন
প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে চ্যানেল আই- প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন বিশেষ সম্মাননা পেয়েছে তরুপল্লব। ৩১শে জানুয়ারি ২০১৫, রাজধানীর তেজগাঁওয়ে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত প্রকৃতি মেলায় এ সম্মাননা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের অতিথি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তরুপল্লবের উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য বিপ্রদাশ বড়ুয়া ও সাধারণ সম্পাদক মোকারম হোসেনের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন। উত্তরীয় পরিয়ে দেন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু।