দূরন্তপনার শৈশব। এর গাছের আম তো ওর গাছের জাম পারা, এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে বেড়ানো আর সঙ্গীদের সাথে খেলাধুলা— গ্রামের শিশুদের এমন করেই দিন কেটে যায়। রিনা আক্তারের শৈশবও কেটেছে দুরন্তপনা আর চঞ্চলতায়, উদ্দাম আর উচ্ছলতায়। কিন্তু জীবনের বাঁকে বাঁকে এমন উচ্ছলতা তার সঙ্গী হয়নি। বরং মন্দ, বন্ধুর পথ ছিল তার প্রতিটি পদক্ষেপ। তৃণমূল নারী রিনা আক্তারের গল্পই শুনব আজ আমরা।
১৯৮১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার কালীগঙ্গা নদীর তীরবর্তী গিলন্ড গ্রামে জন্ম রিনা আক্তারের। ব্যবসায়ী বাবা আব্দুর রশিদ মোল্লা, গৃহিণী মা রাফিজা বেগমের ৫ ছেলে ২ মেয়ে সন্তানের মধ্যে তার অবস্থান পঞ্চম। ভাইয়েরা রিনা আক্তারের বড় হওয়ার কারণে এবং পরিবারেরর জন্য উপার্জন করতে পারার ফলে পরিবারে রিনা আক্তারের দিন হেসে-খেলে ভালোই কেটেছে। শৈশবে তেমন অভাব বা কোনো অনটনের মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়নি।
গিলন্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পর স্থানীয় জয়নগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন রিনা আক্তার। স্কুলে অধ্যয়নকালে খেলাধুলার প্রতি তার বিশেষ ঝোঁক ছিল। দৌড় ও লংজাম্প প্রতিযোগিতায় রিনা আক্তার বরাবর তার ক্যাটাগরিতে প্রথম হয়ে অনেক পুরস্কার জিতেছেন। শৈশবের এমন পুরস্কার তাকে বিভিন্ন কাজের প্রতিযোগী হতে উৎসাহিত করেছে।
দুরন্তপনা আর উচ্ছল জীবন চারদেয়ালে আটকা পড়ে ‘বিবাহ’ নামক শৃঙ্খলের মাধ্যমে। ১৯৯৩ সালে পার্শ্ববর্তী দিঘী ইউনিয়নের কোটাই গ্রামের মোহাম্মাদ আলী পবনের সাথে রিনা আক্তারের বিয়ে হয়। কিশোরী বধুর ওপর শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবারের একটা ভার এসে পড়ে। প্রথমে একটু কষ্ট হলেও ক্রমেই ঠিক সামলে নেয় ছোটবেলা থেকে প্রতিযোগী মানসিকতার রিনা। সময়ের ব্যবধানে কোল আলো করে জন্ম নেয় তার প্রথম সন্তান। বর্তমানে তার দুই মেয়ে এক ছেলে।
বিবাহিত জীবনের শুরুতে সংসারে কোনো অভাব-অনটন না থাকলেও ক্রমে সংসার বড় হয়ে যায়। সবার খাবার, সন্তানদের লেখাপড়া ও চিকিৎসার খরচ বেড়ে যাওয়ায় একটু হিমসিম খেতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে রিনার শ্বশুর তাদেরকে পরিবার থেকে পৃথক করে দেয়। নতুন বাড়িতে নতুনভাবে ঘর তৈরি করে সংসারের কারণে তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। শ্বশুরের কাছ থেকে প্রাপ্ত সামান্য কৃষিজমি, স্বামীর ছোট চাকরির অল্প আয়, এরমধ্যে দিয়েই পরিবারের ভরণপোষণ আর ঋণের টাকার ক্রমপরিশোধ, এভাবে খুব কষ্টের মধ্যে দিয়েই সংসারের চাকা কোনো মতে এগিয়ে চলছিল। কিন্তু সেই সংকটকালে তার পরিবারের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে। তার স্বামী স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। দীর্ঘ সময় চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও তার শরীরের একপাশ অকার্যকর হয়ে পড়ে। উপার্জনকারী পরিবারের একমাত্র সদস্য এখন কর্মহীন একজন নির্ভরশীল ব্যক্তিতে পরিণত হন। রিনা তার চারদিকে যেন একটা অনিশ্চয়তার কালো মেঘ দেখতে পান। নানাভাবে পরিবারের জন্য আয় করতে চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু কোনো দিক থেকেই কিছু করে উঠতে পারছিলেন না। বাবার বাড়ির সহযোগিতায় কোনো মতে দিন চলছিল তার।
এমনই এক জটিলতম সময়ে রিনা আক্তার ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের পরিচালনায় ২২০০ তম ব্যচের উজ্জীবক প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হন।দিঘী ইউনিয়ন পরিষদে অনুষ্ঠিত এ প্রশিক্ষণের প্রায় প্রতিটি আলোচনায় তিনি নতুনভাবে সব কিছু শুরু করার প্রয়াস খুজে পান। কালোমেঘের ফাঁক গলে যেন সূর্যরশ্মিও আভা আসে। রিনা নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার সাহস পান। উজ্জীবক প্রশিক্ষণ এবং এর পরপরই গণগবেষণা প্রশিক্ষণ শেষে রিনা আক্তার নিজ গ্রামের প্রান্তিক জনগণকে নিয়ে গড়ে তোলেন ভাইবোন গণগবেষণা সমবায় সমিতি। এ সমিতির মধ্যে দিয়ে কোটাই গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ আজ স্বাবলম্বী।
রিনা স্থানীয় মালিকদের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে সেই জমিতে আবাদ করতে আরম্ভ করেন। ধান, আখ, সরিষা, ভুট্টা প্রভৃতি চাষ করে তিনি এলাকায় একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। রিনা আক্তারই তার গ্রামের প্রথম নারী কৃষক। এছাড়া তিনি গরু, ছাগল প্রভৃতি পালন আরম্ভ করেন। এসব কাজের মধ্য দিয়ে তার পরিবার আর্থিক অনিশ্চয়তার কালো মেঘকে পেছনে ফেলে উজ্জ্বল দিনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
রিনা আক্তার ২০১৩ সালে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের পরিচালায় ঢাকার পদক্ষেপ ট্রেনিং সেন্টারে অনুষ্ঠিত ১০৬ তম ব্যাচের নারী নেতৃত্ব বিকাশ বিষয়ক ফাউন্ডেশন কোর্সটি সম্পন্ন করেন। এ কোর্সটির মধ্যে দিয়ে তিনি নারীদের দুর্দশার করুণ চিত্র জানতে পারেন এবং এতে ব্যথিত হন। তিনি মনে মনে স্থির করেন যে, তার গ্রামের নারীদের করুণ চিত্র দূরীকরণে তিনি কিছু একটা করবেন। প্রশিক্ষণ থেকে ফিরে রিনা আক্তার তার গ্রামের বাল্যবিবাহ বন্ধে ও মেয়েদের উত্যক্তকরণ প্রতিরোধে জনপ্রতিনিধিসহ এলাকাবাসীকে নিয়ে একটি সভা করেন। এ সভায় গ্রামের উপস্থিত সবাই বাল্যবিবাহ না দেওয়া ও না করানোর বিষয়ে সম্মত হন। এরপর থেকে কোটাই গ্রামবাল্য বিবাহমুক্ত হয়।
রিনা আক্তারের লক্ষ্য তার গ্রামের নারীরা যাতে আত্মমর্যাাদা ও আত্মনির্ভরশীল হয়। এ কাজের জন্য তিনি ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছেন। রিনা আক্তার তরা জনতা উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, কোটাই কমিউনিটি ক্লিনিকের সদস্য, কোটাই গ্রাম উন্নয়ন দলের সহসভাপতি, দিঘী ইউনিয়ন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সদস্যসহ অন্য সংগঠনে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমানে তার নিজের এবং ছেলের আয়ে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। শুধু নিজের স্বচ্ছলতায় তিনি তৃপ্ত নন। তিনি চান তার মতো অন্য নারীরা যেন এমন হঠাৎ ঝড়ে মুখ থুবরে পড়ে না থেকে নিজেকে জয় করতে পারেন। স্বাবলম্বী হয়ে সংসারের হাল ধরতে পারেন। তাই তিনি বাল্যবিয়ের অপকারিতা বোঝানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি নারীর মনের দরজায় পৌঁছে দিচ্ছেন যে, তাদের স্বাবলম্বী হতে হবে। নারীরা হাতে-কলমে তার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে উঠানে সবজি চাষ এবং হাঁস-মুরগি পালনের মতো ছোট ছোট কাজ করে তাদের স্বাবলম্বী করে তুলছেন, যার স্বপ্নে বীজ পেয়েছেন তারা রিনা আক্তারের কাছে।