সারা বিশ্বজুড়ে যখন করোনাভাইরাসের প্রাণঘাতী মহামারি চলছে, তখন মানব জীবনের আরেক হুমকি সম্পর্কে যদি মানুষ ভুলে যায় তাহলে এর পরিণতি পরবর্তীতে কেমন হতে পারে তা নিয়ে কি ভাবার মত যথেষ্ট সুযোগ মিলছে? সেটি হলো রোবটের উত্থান।
ভাল বা খারাপ যাই বলা হোক না কেন, বিশ্লেষকরা বলছেন যে রোবট মানুষের অনেক কাজের ক্ষেত্র দখল করে নেবে। আর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এই প্রক্রিয়াকে আরো বেশি বেগবান করেছে।
"মানুষ সাধারণত বলে যে, তারা তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ বা মিথষ্ক্রিয়ার জন্য মানবিক ছোঁয়া চান। কিন্তু কোভিড-১৯ সেই ধারণাকে বদলে দিয়েছে," এমনটাই বলেন মার্টিন ফোর্ড। তিনি একজন ফিউচারিস্ট যিনি আসছে দশকগুলোতে অর্থনীতিতে রোবটকে কিভাবে সংযুক্ত করা হবে সে বিষয়ে লেখালেখি করে থাকেন।
তিনি বলেন, "কোভিড-১৯ ভোক্তাদের পছন্দের ধরণকে পাল্টে দিতে যাচ্ছে এবং এটি স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশনের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করবে।"
ছোট বা বড়- নানা ধরণের প্রতিষ্ঠান সামাজিক দূরত্ব বাড়াতে রোবটের ব্যবহার বাড়াচ্ছে এবং পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে আসতে হয় এমন কাজের কর্মী কমাচ্ছে। এছাড়া কর্মীরা যেসব কাজ বাড়িতে থেকে করতে পারবে না এমন কাজ করতেও রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে।
আমেরিকার সবচেয়ে বড় রিটেইলার ওয়ালমার্ট মেঝে পরিষ্কার করতে রোবট ব্যবহার করছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় তাপমাত্রা পরিমাপ করতে এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহ করতে রোবট ব্যবহার করছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা হুশিয়ার করেছেন যে, ২০২১ সাল পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হতে পারে। এমন অবস্থায় রোবট কর্মীর চাহিদা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইউভিডি-রোবটস নামে একটি প্রতিষ্ঠান যারা পরিষ্কার করার কাজে রোবট তৈরি করে, কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার তারা হাসপাতালগুলোর কাছ থেকে শত শত অর্ডার পেয়েছে। যেসব কোম্পানি পরিষ্কার এবং জীবাণুনাশক পণ্য তৈরি করে তাদের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গেছে।
ইউভিডি রোবটস নামে একটি ডেনিশ কোম্পানি যেটি আল্ট্রাভায়োলেট-লাইট-ডিসইনফেকশন রোবট তৈরি করে তারা চীন এবং ইউরোপের হাসপাতালগুলোতে শত শত মেশিন সরবরাহ করেছিল।
যেসব মুদি দোকান কিংবা রেস্তোরা টেকঅ্যাওয়ে বা খাবার কিনে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা দিয়ে থাকে সেগুলোতে এসব রোবটের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলবে, আশা করা হচ্ছে যে এসব প্রযুক্তির ব্যবহারও তত বাড়বে- হয়তো দেখা যাবে যে স্কুল কিংবা অফিস পরিষ্কার করছে রোবট।
কাস্টমার অব দ্য ফিউচার নামক বইয়ের লেখক ব্লেক মরগান বলেন, "ভোক্তারা এখন তাদের নিজেদের নিরাপত্তা এবং কর্মীদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার বিষয়টিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়"।
তিনি বলেন, "অটোমেশনের দিকে ঝোঁকাটাই তাদের সবাইকে সুস্থ রাখবে এবং ভোক্তারাও এতে সমর্থন দেবেন।"
তবে এখনো কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মিস মরগান বলেন, যদিও মুদি দোকানগুলোতে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার ব্যবহার মানুষের সাথে মানুষের মিথষ্ক্রিয়া কমিয়ে দেয়।
তারপরও সেগুলো যেহেতু খুব ভাল কাজ করে না এবং তেমন টেকসইও নয়, তাই ক্রেতারা সেগুলো এড়িয়ে ক্যাশিয়ার হিসেবে যেসব কর্মী কাজ করেন তাদের কাছেই যায়।
খাবার সরবরাহ হচ্ছে আরেকটি খাত যেখানে স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ থাকার কারণে রোবটের ব্যবহার বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
ম্যাকডোনাল্ডসের মতো ফাস্ট-ফুড চেইনগুলো খাবার প্রস্তুত ও সরবরাহতে পরীক্ষামূলকভাবে রোবট ব্যবহার করছে।
আমাজন এবং ওয়ালমার্টের মতো প্রতিষ্ঠানের গুদামে কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য রোবট এরইমধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কোভিড-১৯ এর মহামারির পর এই দুটি কোম্পানিই বাছাই, শিপিং এবং প্যাকেটজাত করার জন্য রোবটের ব্যবহার আরো বাড়ানোর চিন্তা করছে।
আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠান তাদের গুদামে রোবট ব্যবহার করে থাকে।
এর ফলে হয়তো গুদামে কাজ করা কর্মীদের অভিযোগ কমে যাবে। এসব কর্মীরা অভিযোগ করেন যে, বর্তমান অবস্থায় তারা সহকর্মীদের কাছ থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারছে না।
কিন্তু প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অনেকেই বেকার হয়ে পড়বে।
একবার যদি কোন একটি কোম্পানি নির্দিষ্ট কোন কাজের জন্য কর্মীর পরিবর্তে রোবটে বিনিয়োগ করে তাহলে সেটি আবার একই কাজের জন্য কর্মী নিয়োগ দেবে- এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
রোবট তৈরি করা এবং সেগুলো ব্যবসায়ে নিয়োগ করাটা বেশ ব্যয় সাপেক্ষ। কিন্তু একবার যদি সেগুলোকে সচল করা যায় তাহলে সাধারণত তা কর্মীদের তুলনায় সস্তা এবং অধিক সময় কার্যকর থাকবে।
এ বিষয়ে ফিউচারিস্ট মার্টিন ফোর্ড বলেন, কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে রোবটের ব্যবহার চালু হলে তা বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে সুযোগ তৈরি করবে।
"মানুষ সেসব স্থানেই যেতে চাইবে যেখানে মানুষের আনাগোনা কম থাকে এবং এ কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও কম হয়," তিনি বলেন।
যেসব ক্ষেত্রে কোন ধরণের শিক্ষা বা সেবার জন্য ব্যক্তির প্রয়োজন হয় সেখানে কিভাবে রোবটগুলো কাজ করবে?
এর জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটানো হচ্ছে যা স্কুলের শিক্ষক, শরীরচর্চার প্রশিক্ষক এবং ব্যবসায়িক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে পারবে।
বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়াচ্ছে। ফেসবুক এবং গুগলও আপত্তিকর পোস্টগুলো সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে থাকে।
তবে রোবট নিয়ে সংশয়বাদীরা বলছেন, এসব কাজের ক্ষেত্রে কোন না কোনভাবে মানুষ জড়িত থাকবে।
২০১৭ সালের নিজের এক গবেষণায় গ্লোবাল কনসালটেন্ট ম্যাককিনজি জানিয়েছিলেন যে, ২০৩০ সালের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়তা এবং রোবটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এক তৃতীয়াংশ কর্মী কাজ হারাবে। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে যে মহামারির মতো ঘটনা সব ধরণের সময় সীমার ধারণাকে পরিবর্তিত করে দেবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রযুক্তিকে মানুষ কিভাবে বিশ্বে সংযুক্ত করতে চায় তা মূলত নির্ভর করবে মানুষের সিদ্ধান্তের উপর। তবে কোভিড-১৯ এর মত মহামারির প্রকোট মানুষকে সচেতন বিবেচনার চেয়ে প্রাণরক্ষার তাগিদেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে ধাবিত করবে বেশি।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন, রোবো সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (ফিচারস)