আইপিএল মিশন শেষ করে কেবলমাত্র দেশে ফিরেছিলেন সাকিব আল হাসান। স্বাভাবিকভাবেই চেয়েছিলেন কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বিশ্বকাপের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে। নিয়ে তাকে নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কের সৃষ্টি হলো, বলা বাহুল্য তৈরি করা হয়েছিল।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশ নিতে যাওয়া বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের নতুন জার্সি পরিহিত অবস্থায় অফিসিয়াল ফটোসেশনে সাকিবের অনুপস্থিতি নিয়ে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন হতাশা প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে পাপনের করা নানা মন্তব্যের পর অনেকের মতো সাংবাদিকদের অনেকেই সাকিবকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় তৈরি করেন।
বিষয়টি নিয়ে জল এতটাই ঘোলা হয়েছিল যে, রীতিমতো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সাকিবের স্ত্রী উম্মে আল হাসান শিশির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের স্বামীর সমালোচনায় মুখর সাংবাদিকদের এক হাত দেখে নিতে বাধ্য হন।
শিশির সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন,বিশ্বকাপের জন্য হওয়া ফটো সেশনে সে কেন গেল না তা নিয়ে সবাই তাকে ভুল বুঝছে। কিন্তু সে মোটেও অন্যায় করেনি কারণ তাকে মুঠোফোনে পাঠানো বার্তা সে ভুল করে পড়েইনি! বিষয়টি নিয়ে সে অফিসিয়ালদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে, এটার কোনো ভিডিওসহ প্রমাণ দিতে পারবো না বলে দুঃখিত!
পরবর্তীতে দলের সঙ্গে আয়ারল্যান্ড সফরে গিয়ে ভালোই ফর্মে ছিলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। সাইড স্ট্রেইনের ইনজুরিতে পড়ার কারণে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে খেলতে না পারলেও বিশ্বকাপের আগে ঠিকই ফিট হয়ে ওঠেন এবং ব্যাট-বল হাতে ক্রিকেট বিশ্বকে মাতিয়ে রাখেন।
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ জেতা সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক রিকি পন্টিং তো বিশ্বকাপ শুরুর আগে ভবিষ্যৎবাণী দিয়েই রেখেছিলেন- এবারের বিশ্বকাপে মাঠেও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবেন সাকিব। জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফ তো রীতিমতো ঘোষণাই দিয়ে ফেলেছিল , সাকিব যে অবিসংবাদিতভাবে ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়; তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
গোটা টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে কতটা অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা দেখিয়েছেন সেটি বোঝার জন্য পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। ৮ ম্যাচে ৮৬.৫৭ গড়ে ৯৬.০৩ স্ট্রাইক রেটে ২ সেঞ্চুরি এবং ৫টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৬০৬ রান তার ব্যাট থেকে এসেছে। যে তিনটি ম্যাচ বাংলাদেশ জিতেছে, তার সবকটিতেই ম্যাচ সেরার পুরস্কার উঠেছে সুপার-৭৫'র হাতে। সেমিফাইনালের আগে বাংলাদেশ বিদায় না নিলে তার রান সংখ্যা আরও উপরের দিকেই থাকতো, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচে একই সঙ্গে হাফসেঞ্চুরি ও ৫ উইকেট শিকারে ভারতের সাবেক তারকা অলরাউন্ডার যুবরাজ সিংয়ের পর আরেক বাঁ হাতি অলরাউন্ডার হিসেবে এবার ইতিহাসে নিজের নাম লিখিয়েছেন টাইগার সাকিব। মোট ৮ ম্যাচে নিয়েছেন ১১ উইকেট। শুধু কি তাই? কোনো এক বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে ছয় শতাধিক রান ও কমপক্ষে ১০ উইকেট পাওয়া প্রথম ক্রিকেটারটির নাম বাংলাদেশের প্রাণ সাকিব আল হাসান।
সাকিবের এমন অতিমানবীয় পারফরম্যান্স আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার (আইসিসি) চোখ মোটেও এড়িয়ে যায়নি। নিজস্ব ওয়েবসাইটে আইসিসি মঙ্গলবার (৯ জুলাই) বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সের বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের রিপোর্ট কার্ড প্রকাশ করে। আর তাতে সাকিবকে নিয়ে যা লেখা হয়েছে, তা জানামাত্র একজন বাংলাদেশি হিসেবে গর্বের সীমা থাকার কথা নয়।
আইসিসি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে- গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেট মানেই সাকিব আল হাসান। এই বিশ্বকাপ প্রকৃত অর্থেই সাকিবের বিশ্বকাপ। ঈর্ষণীয় ধারাবাহিকতার পরিচয় দিয়ে ৮ ম্যাচের ৭টিতে তিনি পঞ্চাশের উপর রান করেছেন। তার সর্বনিম্ন স্কোর ৪১। বল হাতেও কম সফল নন, ৮ ম্যাচে পেয়েছেন ১১টা উইকেট। গুরুত্বপূর্ণ সব উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের দিকে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছেন একাধিকবার।
আইসিসি সাফ জানিয়ে দিয়েছিল- বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার সাকিব নিঃসন্দেহে ২০১৯ বিশ্বকাপের প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট খেতাবের অন্যতম দাবিদার। যদিও দল সেমিফাইনালে না যাওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্টের জন্য বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
বিশ্বকাপ চলাকালীন ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গে সর্বাধিক রান সংগ্রাহকের দৌড়ে পরস্পরকে বারবার টপকে যাচ্ছিলেন। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন রোহিত শর্মাও। বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম কোনো ব্যাটসম্যান হিসেবে সাকিব বিশ্বকাপে এক হাজার রানও পূর্ণ করেছেন। পেছনে ফেলেছেন কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান মার্ক ওয়াহ, সৌরভ গাঙ্গুলী এমনকি স্যার ভিভ রিচার্ডসকেও।
সাকিব সবসময়ই বলেন, বোলিংটা তার সহজাত আর ব্যাটিংটা তার প্রচেষ্টার ফসল। সেই ফসলকে নিজের অধ্যাবসায় দিয়ে এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন তিনি, যেখানে তাকে নিয়ে এক চুল প্রশ্নও তোলার অবকাশ নেই !
দল ভালো না করলেও তাই বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের দৌড়ে অনেক তারকা ক্রিকেটারের তুলনায় তাই এগিয়ে ছিলেন বাংলাদেশের সাকিব। অন্তত মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গালফ নিউজ এমন খবরই প্রকাশ করেছিল। গালফ নিউজের করা বিশ্লেষণে অংশ নিয়েছেন ৫ সদস্যের বিশ্লেষক প্যানেল। নির্বাচক প্যানেলের ৫ সদস্যের সবার ভোট পেয়ে সেরা অলরাউন্ডার নির্বাচিত হয়েছেন সাকিব।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির পাঠকদের দ্বারা নির্বাচিত একাদশেও জায়গা পেয়েছেন বাংলাদেশের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তারপরেও বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠতে না পারায় সাকিবের ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হওয়া নিয়ে সংশয় তো ছিলই। কিন্তু পারফরম্যান্সের বিচারে সাকিবের ধারের কাছেও কেউ ছিলেন না। যদিও পুরষ্কার তার হাতে ওঠেনি।
কাউন্টি খেলতে গিয়ে যে খেলোয়াড়টি ইংল্যান্ড দলে খেলার অফার পাওয়ার পরেও বলেছিলেন, লাল-সবুজের জার্সি গায়ে খেলার জন্যই তার জন্ম হয়েছে। সেই জার্সি পরেই ইংল্যান্ডের মাঠ কাঁপিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটের বড় মঞ্চে তিনি সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত না হয়েও সবার হৃদয়ের মণিকোঠায় শ্রেষ্ঠই হয়ে রইলেন। তার এমন অর্জনে যেন মর্যাদার সোপান বেয়ে আরও উপরে উঠে গেল বাংলাদেশ!
আরআইএস