ইংল্যান্ডের মাটিতে ক্রিকেট বিশ্বকাপের দ্বাদশ আসর শুরুর দিকে অনেকেই ভুল আম্পারিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন! তারা বলার চেষ্টা করেছিলেন, ভুলে ভরা আম্পারিংয়ের এ বিশ্বকাপে চোখ রাখার আর কোন কারণ নেই! কেন? কারণ, সেমিফাইনালের চারটি দলকে বেছে নেয়ার লক্ষ্যে রাউন্ড রবিন লীগ পর্বেই চলে ‘ভুল আম্পারিংয়ের নামে নির্লজ্জভাবে ক্রিকেটের তিন মোড়ল ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডকে সেমিতে নেয়ার প্রক্রিয়া।
সেমিফইনালের তিনটি দল ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার জায়গা পাকাপোক্ত রাখার পরিকল্পনা নিয়েই যেন বিশ্বকাপের আসর এগোতে থাকে। চতুর্থ দল হিসেবে তাদের প্রয়োজন ছিল একটি দল। সেমিফাইনালের এ চতুর্থ দলটি ঠিক করতেই মূলত বাংলাদেশ, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্থানের মধ্যে মঞ্চস্ত করতে থাকে মাঠের লড়াই!
তিন এলিট দলের বিপক্ষে বাংলাদেশসহ অন্য ৭টি দল যখন খেলেছে তখন প্রায় প্রতিটি ম্যাচে একাধিক ভুল সিদ্ধান্ত এসেছে আম্পায়ারদের কাছ থেকে। কেন? সবই কি ছিল আম্পায়ারদের অনিচ্ছাকৃত ভুল? ঘটনাক্রম কিন্তু তা বলে না। ফাইনালের আগে ১১ জুলাই একজন টুইটারে লিখেছেন, ইংল্যান্ড বিশ্বকাপটা বৃষ্টি আর আম্পায়ারের। প্রতিপক্ষের চেয়ে এই দুটি বিষয়ই বেশি ভুগিয়েছে দলগুলোকে। কথাটা একবিন্দুও ভুল নয়। চারটি ম্যাচ পণ্ড হয়েছে। আর ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে কয়েকটি ম্যাচের ফলাফল বদলে দিয়েছেন আম্পায়াররা।
দ্বাদশ বিশ্বকাপে বাজে আম্পায়ারিংয়ের উদাহরণ ভুরিভুরি। গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর ম্যাচে আম্পায়ার রুচিরা পালিয়াগুরুগে ও ক্রিস গাফানি মিলে বেশ কয়েকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দেন। নিজেদের বাঁচাতে এক ম্যাচেই চার রিভিউ নেয় ক্যারিবীয়রা। বিতর্কিত সিদ্ধান্তের দুটিই ছিল গেইলের বিপক্ষে। দু'বার গেইলকে ভুল আউট দেন গিফানি। তৃতীয়বার লেগ বিফোরের সিদ্ধান্ত সঠিক থাকলেও গিফানি নো বল এড়িয়ে যান।
আম্পায়ারের ভুল হয় পাকিস্তান-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচেও। কুমার ধর্মসেনা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের জোয়েল উইলসনের ভুলে এক ওভারে ৭ বল করতে হয় পাকিস্তানকে। সপ্তম বলে কোনো রান বা উইকেট পড়লে কিন্তু বিতর্ক আরও বাড়ত।
বাজে আম্পায়ারিংয়ের শিকার হয় বাংলাদেশও। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ব্যাটিং করার সময় দুটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দেন আম্পায়াররা। সেদিন মুজিব উর রহমানের করা ৩২তম ওভারের শেষ বলটি সৌম্য সরকারের প্যাডে লাগে। তাতেই জোর আবেদন জানায় আফগানিস্তান। ফিল্ড আম্পায়ার আঙুল তুলে দেন। রিভিউ নেন সৌম্য সরকার। রিভিউ দেখে সবারই মনে হয়েছে ব্যাট স্পর্শ করার পর বলটি প্যাডে লাগে! তবে থার্ড আম্পায়ার আলিম দারের মনে হলো অন্য কিছু। আফগানিস্তানের পক্ষে রায় দিলেন তিনি! সেদিনই লিটন কুমার দাসের আউটটিও ছিল বিতর্কিত। ১০ বলে তিন রানে আউট হন সৌম্য সরকার। বলটি মাটিতে পড়ার পর ক্যাচ ধরেন আফগান ফিল্ডার হাশমতউল্লাহ শাহেদি। তবুও আউট ঘোষণা করেন আলিম দার।
আম্পায়ারের ভুলে কারণেই নিশ্চিত জেতা ম্যাচ হাতছাড়া হয় আফগানিস্তানের। সেবার হারিস সোহেল জীবন পেয়েছেন আম্পায়ারের নাইজেল লংয়ের ভুলে। হারিসের ব্যাটে লেগে বল জমা পড়ে উইকেটকিপারের গ্লাভসে কিন্তু লং আউট দেননি লং। পাকিস্তানকে ম্যাচ জেতানো ইমাদ ওয়াসিম জীবন পান মাত্র ১ রানে থাকতে। রশিদ খানের বল ইমাদের প্যাডে লেগেছিল। আফগানরা জোরালো আবেদন করলেও আম্পায়ার পল উইলসন সাড়া দেননি।
সেমিফাইনালেও বজায় ছিল ভুল আম্পায়ারিং। এদিন বাজে আম্পারিংয়ের শিকার হন ইংলিশ ব্যাটসম্যান জেসন রয়। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ২২৪ রানের লক্ষ্যে খেলছিল ইংল্যান্ড। ইনিংসের ২০তম ওভারে প্যাট কামিন্সের বলটা হুক করতে চেয়েছিলেন রয়। বলটা তাকে ফাঁকি দিয়ে জমা হয় অ্যালেক্স ক্যারির গ্লাভসে। অজি ফিল্ডাররা আবেদন করলে আঙুল তুলে দেন শ্রীলংকান আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনা। ভুলে রিভিউ চেয়ে বসেন রয়, তার হয়তো মনে ছিল না দুই ওভার আগে একমাত্র রিভিউটা নষ্ট করে বসেন জনি বেয়ারস্টো। ৬৫ বলে ৮৫ রান করা রয় ফিরে গেলেন আম্পায়ারের ভুলের কারণে।
রাগে ক্ষোভে অনেকক্ষণ উইকেটে দাঁড়িয়ে থাকেন জেসন রয়। শেষ পর্যন্ত মরিস এরাসমাসের অনুরোধে মাঠ ছাড়েন ইংলিশ ওপেনার। তবে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে তিনি যে মোটেও খুশি নন সেটা প্রকাশ্যেই জানান দেন রয়।
অথচ, আসর শুরুর আগে বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং যাতে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকে, সে জন্য কত উদ্যোগই না নিয়েছিল আইসিসি! শুধু এলিট প্যানেলের আম্পায়ারদের বিশ্বকাপে দায়িত্ব দেয়ার নাটক করে তারা। চালু করে ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম (ডিআরএস)। সিদ্ধান্ত পরিশীলিত করতে স্নিকোমিটার, আলট্রা এজ, হক আইসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি যোগ করা হয়। আম্পায়ারদের সুবিধার জন্য জিং বেল প্রযুক্তিও যোগ করা হয়। কিন্তু তাতে কাজ হলো কই! বিশ্বকাপ ফাইনালেই যে ভুলে ভরা আম্পায়ারিং হলো ১৪ জুলাই রাতে।
বহু বিতর্কের পরও সেমিফাইনালে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই আম্পায়ারের হাতেই ফাইনালের দায়িত্ব তুলে দেয় আইসিসি। আগের ম্যাচগুলোর ভুল সিদ্ধান্ত শুধরে নিয়ে তারা ফাইনালে ‘ভালো’ আম্পায়ারিং উপহার দেবেন, দর্শকদের এমনটাই হয়তো বিশ্বাস করাতে চেয়েছিল আইসিসি। সেই আশায় গুড়েবালি। ফাইনাল ম্যাচের তৃতীয় ওভারেই ভুল সিদ্ধান্ত দেন কুমার ধর্মসেনা। ক্রিস ওকসের বলে ভেতরের দিকে আসতে বলটি ব্যাট দিয়ে ঠেকাতে ব্যর্থ হন নিকোলস, বোলার ওকস আবেদন করলেন, আম্পায়ার ধর্মসেনা আঙুল উঁচিয়ে আউটের ইঙ্গিত দিয়ে দেন!
নিকোলস রিভিউ নেয়ার পর দেখা যায়, বল উইকেটের অনেক ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। তৃতীয় আম্পায়ার রড টাকার ধর্মসেনার সিদ্ধান্ত বদলে দেন।
নিকোলস রিভিউ নিয়ে বেঁচে গেলেও রস টেলরের সেই ভাগ্য ছিল না। সতীর্থ গাপটিল আগেই রিভিউ খোয়ানোর ফলে আম্পায়ার ইরাসমাসের দেওয়া আউটের ভুলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেননি। ৩৩তম ওভারের প্রথম বলে মার্ক উডের বল ঠিকভাবে খেলতে পারেননি টেলর। বল প্যাডে লাগলেও খালি চোখেই মনে হচ্ছিল, বল স্টাম্পের অনেক ওপর দিয়ে যাবে। কিন্তু আম্পায়ার ইরাসমাস কী দেখলেন, কে জানে! সোজা তর্জনী উঁচিয়ে জানিয়ে দিলেন আউটের সিদ্ধান্ত। পরে রিপ্লেতে দেখা যায় বলটি লেগ স্টাম্পের অনেক ওপর দিয়ে চলে যেত।
এই দুই ভুল আউটের মাঝে ২২তম ওভারে ধর্মসেনা আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। লিয়াম প্লাংকেটের গুড লেংথে পড়ে বাঁক খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথে কেন উইলিয়ামসনের ব্যাটের ছোঁয়া পেয়ে উইকেটরক্ষক বাটলারের হাতে ঠাঁই পায় বল। কিন্তু সেটি ধর্মসেনার নজর এড়িয়ে যায়। পরে রিভিউ নিয়ে উইলিয়ামসনের গুরুত্বপূর্ণ উইকেটটি বুঝে নেয় ইংল্যান্ড।
সব মিলিয়ে নির্ধারিত ৫০ ওভারের ম্যাচ টাই হওয়ায় খেলা গড়ায় সুপার ওভারে। সুপার ওভারেও ম্যাচের ফল হয় ‘টাই’! ফলে ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের চেয়ে বেশি বাউন্ডারি-ওভার বাউন্ডারি হাকানোয় দ্বাদশ আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড। তবে দর্শকরা বলতে শুরু করেছেন, এবারের আসরের আসল চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড নয় ‘আসল’ চ্যাম্পিয়ন ‘ভুল আম্পারিং’!
এইচএস/এসএইচএস