
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণকে আবারো এক সুতোয় গাঁথতে পেরেছিল ক্রিকেটীয় সাফল্য। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফির প্রথম সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। ক্ষুধা, দারিদ্রতা, রাজনৈতিক হানাহানি, বন্যার মতো নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হওয়া বাংলাদেশ বিশ্বে ক্রিকেট নিয়ে গর্ব করার মতো একটা জায়গা পাওয়ার আনন্দে প্রকম্পিত হয়েছিল।
বৃষ্টিবিঘ্নিত ফাইনালে কেনিয়াকে শেষ বলে হারানোর মুহূর্তটি যেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের বাঁক ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার কয়েকদিন পরেই জুটে গিয়েছিল ওয়ানডে স্ট্যাটাস। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়ে তো লাল-সবুজের দল টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার জন্য আইসিসির দরজায় জোরালভাবে কড়া নাড়তে থাকে। ক্রিকেট কূটনীতি, আইসিসির সার্বিক সহযোগিতা, দর্শকদের মাঠমুখী হওয়ার প্রবণতা এবং ক্রিকেটের প্রতি তাদের প্রবল আকর্ষণ- এসব কারণে আকরাম-বুলবুল-দুর্জয়দের সাদা পোশাকের ক্রিকেটে খেলতে নামার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষার প্রহর গুণতে হয়নি।
২২ বছরের পথচলায় ক্রিকেটে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা, সফলতা, ব্যর্থতা সবকিছুই ক্রিকেট বিশ্ব অবলোকন করেছে। ওয়ানডে ক্রিকেটে টাইগাররা পরাশক্তি হলেও টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে তাদের পারফরম্যান্স একেবারেই অনুজ্জ্বল। চলতি বছর টেস্ট ক্রিকেটের অতি নবীন সদস্য আফগানিস্তানের বিপক্ষে মিরপুরের মাঠে ২২৪ রানের বিশাল ব্যবধানে হারায় সাদা পোশাকের ক্রিকেটে বাংলাদেশের অতীতের যৎসামান্য অর্জনকেও সমর্থকদের কাছে তুচ্ছ মনে হতে থাকে। ভারত সফরে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে পা রাখা বাংলাদেশ যেন দুইটি টেস্টেই তিনদিনে ইনিংস ব্যবধানে হেরে প্রমাণ করে ছাড়লো অনেকটা সাত সাগর পাড়ি দিয়ে সৈকতে পড়ে থাকার মতোই তারা ১৯ বছরেও টেস্ট ক্রিকেট বুঝতেই চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
তিন ফরম্যাটের আলাদা দল গঠনে নির্বাচকদের ব্যর্থতা নিয়ে বারবার আলোচনা করেও মিলছে না কোনো সুফল। দুর্বল ক্রিকেট কাঠামো, খেলোয়াড়দের উপযুক্ত পাইপলাইন গড়ে না তোলা, দল গঠনে অনেকের অযাচিত হস্তক্ষেপ নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক কথাই উঠে আসে। একইসঙ্গে দেশের ক্রিকেটের নীরব ঘাতক হয়ে উঠেছে খেলাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড় এবং কর্তা-ব্যক্তিদের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য।
খুব বেশি পেছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন নেই। ইডেন টেস্টে টসে জিতে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মুমিনুল হকের আগে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েই হেড কোচ সেল ডমিঙ্গো এবং বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের পরস্পরবিরোধী মন্তব্যই তাদের বিপরীতমুখী অবস্থান টিম ম্যানেজমেন্টের ভেতর সমন্বয়হীনতার অভাবকেই পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। যা সত্যিকার অর্থেই দেশের ক্রিকেটের জন্য অশনি সংকেত। মতের ভিন্নতা থাকা অসম্ভব নয়, তবে তা যদি গণমাধ্যমের সামনে চলে আসে এবং তাদের মাধ্যমে দেশবাসীও বিষয়টি জেনে যায়, তাহলে এটি কোনো শুভ বার্তা বহন করে না। বরং, প্রাধান্য বিস্তারের মানসিকতাই প্রকাশ পায়।
টস নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে রাসেল ডমিঙ্গো বলেছিলেন, আমরা অলআউট ছক কষেছিলাম। সেজন্যই টস জিতে ব্যাট করা, কিন্তু তা কাজে লাগলো না। অথচ পরদিন ইডেনে হাজির হয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বিসিবি সভাপতি বলেন, টসে জিতে ব্যাটিং নেয়াটা আসলেই আমি আশ্চর্য হয়েছি। সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছি কারণ আগের দিন দলের সঙ্গে আমি বসেছি। কোচ-অধিনায়ক দুজনই বলেছে যে টসে জিতলে ফিল্ডিং নেবো। তাদের কথা শুনে মনে হয়েছিল অবশ্যই তারা সেটাই করবে। এখানে আবার চিন্তা করার কী আছে। কিন্তু আমরা যখন দেখেছি টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছি, প্রথম ধাক্কাটা আসলে তখনই খেয়েছি। এটা অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে কি না, জানি না।
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় টস প্রসঙ্গে বোর্ড সভাপতি সত্য বলেছেন, তাহলে রাসেল ডমিঙ্গো এবং মমিনুল হককে প্রকারন্তরে তিনি সবার সামনে মিথ্যাবাদী বলেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে। এমনটি যদি হয়ে থাকে, তাহলে সেটি মোটেও দেশের ক্রিকেটের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। কোচ-অধিনায়ক দুজনই টস নিয়ে আসলে কোন সিদ্ধান্তের কথা বিসিবি বসকে জানিয়েছিলেন, সেটা এক রহস্যই বটে।
ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব পেয়ে তা গোপনের দায়ে ক্রিকেট থেকে সাকিব আল হাসান নির্বাসিত হওয়ায় তার পরিবর্তে টেস্ট অধিনায়কত্ব পাওয়া মুমিনুল হক যে বোর্ড সভাপতির কথায় চরমভাবে বিব্রত তা বুঝতে কারোর বাকি নেই। যদিও ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বলেছেন, উনি (বিসিবি সভাপতি) হয়তো বলেছেন, আমি তো সামনে ছিলাম না। এটা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারবো না। এটা বলার জন্য আমি সঠিক ব্যক্তি না।
টস নিয়ে সাংবাদিকদের বিব্রতকর প্রশ্ন হয়তো মুমিনুল ঠিকই এড়িয়ে জেতে পেরেছেন, তবে মানসিকভাবে কি আদৌ তিনি তা পেরেছেন? মুমিনুলের পুরো ক্যারিয়ার ঘেটে দেখা যাচ্ছে, এতোটা বাজে আগে কখনো তিনি খেলেননি! তাহলে তার স্বাভাবিক খেলাটা নষ্ট করে দেয়ার দায় কে নেবে?
এবার আরেকটু পেছনের দিকে ফেরা যাক। দেশের মাটিতে চলতি বছর সেপ্টেম্বরে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে সামর্থ্যের ৬০-৭০ দিলে ফাইনালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয় পাওয়া সম্ভব বলে মন্তব্য করে বসেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের তরুণ অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। তবে তার এমন কথার বিরোধিতা করে রাসেল ডমিঙ্গো ফাইনাল ম্যাচ পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা ৬০-৭০ ভাগ খেললেই জিতে যাবো এমনটা ভাবার কোনো কারণ আসলে নেই। তবে আফগানিস্তানকে যদি ৬০-৭০ ভাগ সামর্থ্যের ভেতর খেলে মধ্যে আটকে রাখতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য ভালো হবে।
ভারত সফরের আগে ক্রিকেটারদের ১১ দফা দাবিতে ডাকা ধর্মঘট নিয়েও পরস্পরবিরোধী মন্তব্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়ে বিসিবি পরিচালকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। বিসিবি পরিচালক জালাল ইউনুসের মত ছিল, ক্রিকেটারদের ধর্মঘটে যাওয়া নাকি ব্ল্যাকমেইলিং ছাড়া আর কিছুই নয়। মাহবুবুল আনাম বিষয়টিকে বিসিবির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
তবে আরেক বোর্ড পরিচালক ও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান ইতিবাচক সুরে বলেছিলেন, দাবি-দাওয়ার বিষয়গুলো সবসময় আন্দোলন দিয়েই শুরু হয়। যখন আপনি বোর্ডের সঙ্গে বসেন, তখন সেই আন্দোলন আর স্থায়ী হয় না। ক্রিকেটারদের প্রস্তাব পূরণের জন্য বোর্ড রয়েছে। বোর্ড পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি ক্রিকেটারদের বেশিরভাগ দাবি যুক্তিসঙ্গত বলে নিজের মত জানিয়েছিলেন।
পরে বিসিবি সভাপতি জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে ক্রিকেটারদের দাবি ও ধর্মঘটে যাওয়াকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সংকট সমাধানের রাস্তাকে আরও বেশি জটিল করে তোলেন। যদিও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ এবং বোর্ডের সঙ্গে ক্রিকেটারদের আলোচনা সাপেক্ষে সেই সংকট থেকে আপাতত মুক্তি মিলেছে বটে; তবে অস্বস্তির হাওয়া এখনো পুরোপুরি কেটে যায়নি।
পরস্পরবিরোধী তো বটেই, স্ববিরোধী মন্তব্য করার নজিরও বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রকটভাবেই রয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিটি হলেন খোদ বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। ২০১৬ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে হাতে মারাত্মকভাবে আহত চোট পান মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা। স্বাভাবিকভাবেই তাকে নিয়ে তখন গণমাধ্যমে আলোচনা চলছিল। অথচ সেদিন এক টিভি সাক্ষাৎকারে বোর্ড সভাপতি রীতিমতো এক বিস্ফোরক তথ্য জানান। তিনি জানান, টি-টোয়েন্টি থেকে নাকি মাশরাফী তাকে অবসরের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন! অথচ একই দিন তিনি আরেকটি টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানান, টি-টোয়েন্টি থেকে মাশরাফীর অবসর নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
তবে ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে নাটকীয়ভাবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে মাশরাফী তার অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেন। যা অনেক ভক্ত-সমর্থকরা মেনে নিতে পারেননি। তৎকালীন কোচ চণ্ডিকা হাথুরুসিংহের নেতিবাচক মনোভাবের কারণেই ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে তখন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও মাশরাফীর নিজের মুখে অবসর ঘোষণার পরই দেশে ফিরে অদ্ভুত এক কথা গণমাধ্যমের সামনে বলে বসেন পাপন। নড়াইল এক্সপ্রেসের পাশে বসেই তিনি বলেছিলেন, আমি একটা কথা বারবারই বলছি; মাশরাফী কিন্তু টি-টোয়েন্টি এখনও ছাড়েনি। আমরা এখন পর্যন্ত মাশরাফীকে বলিনি যে, মাশরাফী টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডে নেই। ও অধিনায়কত্ব ছেড়েছে। আমাদের তিনটা ফরম্যাটে তিনজন অধিনায়ক। সেটা আমি অনেক আগেই বলেছি। ও যদি ফিট থাকে খেলবে। সে যদি বলে খেলতে চায় না কিন্তু আমাদের দরকার হয়, তাহলে কি ছেড়ে দেবো নাকি!
পরস্পরবিরোধী মন্তব্যের এমন অসংখ্য ঘটনা দেশের ক্রিকেটে রয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব মাঠের খেলাতেও লক্ষ্য করা যায়। স্কোয়াড ঘোষণা, একাদশ নির্বাচন। টস জিতে আগে ব্যাটিং নাকি বোলিং কোনটা করা হবে- এসব বিষয়ে নেয়া সিদ্ধান্ত যখন নেতিবাচক ফল বয়ে আনে; তখনই শুরু হয় একে অন্যের প্রতি দোষারোপ। কখনো কখনো সেই কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে করে দেয়, যা সমাধানের রাস্তা থেকে সরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। মাঠের বাইরের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাবলির প্রভাব তো খেলোয়াড়দের মাঝে পড়াটাই স্বাভাবিক। এতে করে তারা না পারেন নিজেদের সেরাটা দিতে, না পারেন মন জয় করতে। এমন পরিবেশ দেশের ক্রিকেটের জন্য অশনি সংকেত। কারণ দায় এড়িয়ে অনিবার্য পতনকে প্রতিরোধ করা যায় না, বরং তা আরও সন্নিকটে দানবীয় রূপে এসে হাজির হয়।
আরআইএস